আজ- ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  রাত ১২:১১

প্রসঙ্গ রেমিট্যান্স :: অভিবাসীদের ঘামে আশার আলো

 

*মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল *

আজ ১৮ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। স্বদেশের নাগরিক যারা বিদেশে থাকেন তাদেরকে অভিবাসী বা প্রবাসী বলা হয়।প্রবাসে কর্মরত নাগরিকদের স্বদেশে প্রেরিত অর্থকে রেমিটেন্স বলা হয়। তাদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠায়। এই অর্থ কেবল তাদের পরিবারের প্রয়োজনই মেটানোর পাশাপাশি জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে এবং নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স থেকে অর্থনৈতিক প্রকবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। সেজন্য সহজেই বলা যায়, এই রেমিট্যান্স থেকে প্রবাসী কর্মজীবীর পরিবার এবং দেশ উভয়েই লাভবান হয়ে থাকে।

সখের বসে দেশের কেউ রেমিট্যান্সের বাহন হয়েছে- এমনটা নয়। প্রবাসীদের এই রেমিট্যান্সে মিশে থাকে সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট ও বেদনা। আত্মীয়-স্বজনদের ছেড়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে দিনরাত তাদের ঝড়ানো ঘামই আজকাল আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে।

দেশের অর্থনীতিতে রপ্তানি আয়ে অনেকদিন থেকে কমতি ধারা। বিদেশি মূদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে। রাজস্ব আদায়েও ভাটা। মূল্যস্ফীতি ঊর্ধমুখী। বেসরকারি ঋণ ও বিনিয়োগে মন্দা। এ অবস্থায় ভরসা করার জায়গা কেবলমাত্র প্রবাসীদের আয়। রেমিট্যান্স নামীয় এই আয় এখনো তেজোদীপ্ত। এ তাগড়া ঘোড়াটা রেস করাতে সরকারি প্রণোদনায় কিছু সুফল দেখা যাচ্ছে। ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে ব্যাংকিং চ্যানেলে এরইমধ্যে রেমিট্যান্সে বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ এক হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ (১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স আসে। এরপর প্রতিবছরই রেমিট্যান্স কমে যেতে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আড়াই শতাংশ কমে গিয়ে রেমিট্যান্স আসে এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা সাড়ে ১৪ শতাংশ কমে দাঁড়ায় এক হাজার ২৭৭ কোটি ডলারে- যা ছিল আগের ছয় অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে প্রবাসীরা ৭৪৮ কোটি ৮৪ লাখ (৭.৪৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৮০৪ কোটি ৯৪ লাখ ডলার।
রেমিট্যান্সের নিম্নগতি রোধ করে ঊর্ধমুখীতার জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহন করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা প্রদান, জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। ব্যাংকার ও খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে মূলত দুটি কারণে। হুন্ডি বন্ধ করতেও সরকার প্রধান সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন। এসব কারণে প্রবাসীরা দেশে বৈধপথে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এ বছর বৈধ চ্যানেলে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসবে বলে তাদের প্রত্যাশা।

২০১৪ সাল থেকে সম্মাননা পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রচলন করা হয়েছে ‘রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড’। পাঁচটি ক্যাটাগরিতে সাধারণ পেশাজীবী, বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংক ও রেমিট্যান্স প্রেরণকারী অনিবাসী বাংলাদেশি মালিকানাধীন এক্সচেঞ্জ হাউজকে অ্যাওয়ার্ড দেয়া শুরু হয়েছে।

এদিকে রেমিট্যান্সের প্রণোদনার অর্থ যেন সহজে প্রবাসীরা পান সেজন্য বিভিন্ন শর্ত শিথিল করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সার্কুলারে বলা হয়, দেড় লাখ টাকার রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার কাগজপত্র লাগবে না। আগে ১,৫০০ মার্কিন ডলার বা সমমূল্যের অন্যান্য বৈদেশিক মদ্রা পাঠালে বিনা প্রশ্নে প্রণোদনার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের বোঝার সুবিধার্থে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি দেড় লাখ টাকার ওপর রেমিট্যান্সের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিলের সময়সীমাও বাড়ানো হয়েছে। তবে দেড় লাখ টাকা বা দেড় হাজার ডলারের বেশি রেমিট্যান্স প্রেরণকারীকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করতে হয়। আগে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে রেমিট্যান্সের কাগজপত্রাদি দাখিলের সময়সীমা ছিল। তা বাড়িয়ে এখন ১৫ কার্যদিবস করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে এক হাজার ৬৪১ কোটি ৯৬ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স আসে। এই অঙ্ক আগের বছরের অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ৯.৬ শতাংশ এবং অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি ছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক বছরে এই পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে রেমিট্যান্সে বাড়তির ধারা চলছে।
এ অর্থবছরের জুলাইতে ১৫৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা- যা গত অর্থবছরের জুলাইতে ছিল ১৩১ কোটি ৮১ লাখ ডলার। এরপর গত আগস্টে ১৪৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স আসে- যা গত অর্থবছরের আগস্টে ছিল ১৪১ কোটি ১০ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৪৭ কোটি ৬৯ লাখ ডলার- যা গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ১১৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। অক্টোবরে আসে ১৬৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার- গত অর্থবছরের অক্টোবরে এসেছিল ১১৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। আর সর্বশেষ গত নভেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই মাসের চেয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের নভেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১১৮ কোটি ডলার। দিন দিন রেমিট্যান্সের এমন বৃদ্ধিতে আশার আলো দেখছেন বিশ্লেষকরা।

কেবল বাংলাদেশ নয়, আধুনিক বিশ্বের ধনী অনেক দেশও এখন রেমিট্যান্সের ওপর ভরসা করে। প্রতিবেশি ভারতের রেমিট্যান্স আমদানি প্রচুর। তাদের বাজারও অনেক বড়। ভারত চেষ্টা করে দক্ষ শ্রমিক বাইরে পাঠিয়ে বেশি রেমিট্যান্স নিশ্চিত করতে। পাকিস্তানেও রেমিট্যান্স বাড়ছে। এ লক্ষে দক্ষ শ্রমিক রপ্তানির পাশাপাশি তারা মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। এক হিসাবে জানা গেছে, ২০১৮ সালে গোটা বিশ্বে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার- যা তার আগের বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএমের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী প্রবাসী আয়ে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ভারত। বিভিন্ন দেশে বসবাসরত দেশটির নাগরিকরা সাত হাজার ৮৬১ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন নিজ দেশে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আয় করা দেশ পাকিস্তান। গত বছর তাদের প্রবাসীরা দুই হাজার ১০০ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। চীন, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, মিসর, ফ্রান্স, নাইজেরিয়া, জার্মানিও রেমিট্যান্স বাড়ানোর নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। নানা প্রণোদনা দিচ্ছে। বাংলাদেশও চেষ্টায় কমতি রাখছে না। বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের ভরসা হাতে গোনা কয়েকটি দেশ। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র- এই তিন দেশ থেকেই রেমিট্যান্সের প্রায় ৪৫ শতাংশ আসে। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকেই সবচেয়ে বেশি আসে। যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ওমান ও কাতার থেকেও রেমিট্যান্স আসার গতি আশান্বিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিট্যান্স এসেছে ৭৭১ কোটি ডলার। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে এসেছে প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার- যা এ পর্যন্ত পাঠানো মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৫৮ শতাংশ। আর ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলো থেকে এসেছে ৩২১ কোটি ডলার বা ৪২ শতাংশ। এ সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব থেকে সর্বোচ্চ ১৬১ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে।

এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১১০ কোটি ৪৬ লাখ, কুয়েত থেকে ৬০ কোটি ৯৯ লাখ, ওমান থেকে ৫২ কোটি ৭৯ লাখ, কাতার থেকে ৪৫ কোটি ৭৬ লাখ ও বাহরাইন থেকে ১৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। আর ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮৯ কোটি ৩৭ লাখ, যুক্তরাজ্য থেকে ৬০ কোটি ২৫ লাখ, মালয়েশিয়া থেকে ৫২ কোটি ৯৮ লাখ, ইতালি থেকে ৩৩ কোটি ৪২ লাখ ও সিঙ্গাপুর থেকে ১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। গত কয়েক বছর ধরে রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক বৃদ্ধি অনেকটাই ভাল।

প্রবাসীদের টাকার সিংহভাগ ব্যাংকিং চ্যানেলে এলে রেমিট্যান্সের অংকটা বিশাল হত। হুন্ডির কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এমনিতেই বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি পাঠানোয় অন্য দেশ থেকে পিছিয়ে থাকা, উন্নত বিশ্বে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়া এবং বিদেশে গিয়ে ভিসা-সংক্রান্ত নানা জটিলতায় পড়ে বাংলাদেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বাজারমূল্যের চেয়ে কম মজুরিতে কাজ করে থাকে। তাই অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের শ্রমিকদের গড় রেমিট্যান্স বাড়েনি। সেই রেমিট্যান্সকেও মার খাইয়ে দিচ্ছে হুন্ডি। হুন্ডিতে টাকা লেনদেন বন্ধ করা গেলে রেমিট্যান্সই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno