প্রথম পাতা / অপরাধ /
সবকিছু হারিয়ে জাহালমের পরিবার এখন নিঃস্ব!
By দৃষ্টি টিভি on ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯ ৯:১৩ অপরাহ্ন / no comments
দৃষ্টি নিউজ:
নিরক্ষর এক যুবক জাহালম মিয়া। বয়স ৩০ এর বেশি নয়। অভাব আর দারিদ্রের কারণে বিদ্যালয়ের বারান্দা পর্যন্ত যেতে পারেনি। বাবার আদর- ভালোবাসাও তেমন একটা পাননি তিনি। ছোট্ট বেলায় জাহালমের মাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেন তার বাবা ইউসুফ। সেই থেকে মায়ের কাছেই মানুষ। এলাকায়ও ভালো সুনাম তার। কখনো কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ নেই তার সাথে। মা, তিন ভাই ও তিন বোনের সংসার। ভাইদের মধ্যে জাহালম মেঝ। হঠাৎ কি যে হলো বুঝতেও পারেনি জাহালম ও তার পরিবারের সদস্যরা। বিনা অপরাধে কাটাতে হলো প্রায় তিন বছর হাজতবাস। তিন বছর পর জাহালমকে কাছে পেয়ে পরিবারের সদস্যরা সাময়িক খুশি হলেও দুঃশ্চিন্তার যেন শেষ নেই পরিবারটির। বিগত তিনটি বছর বাড়ি বাড়ি কাজ করে সর্বস্ব বিক্রি করে ছেলেকে হাজতবাস থেকে মুক্ত করার জন্য কতই না মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তার পরিবার। অন্যের কাছ থেকে সুদে টাকা এনে ছেলের জন্য খরচ করলেও এখন সে টাকা কিভাবে পরিশোধ করবে? এখন আর চলার মতো কিছুই নেই। সব কিছু হারিয়ে এখন তারা নিঃস্ব।
জানা যায়, সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে ২০১৪ সালে আবু সালেক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। এরপর সালেককে তলব করে দুদক চিঠি দিলে সেই চিঠি পৌঁছায় টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ধুবড়িয়া গ্রামের জাহালমের বাড়ির ঠিকানায়। কিন্তু এ বিষয়ে তার পরিবার ও জাহালম কিছুই জানেন না। তখন জাহালম নরসিংদীর ঘোড়াশালে অবস্থিত বাংলাদেশ জুট মিলে শ্রমিকের কাজ করেন। এ বিষয়ে জানার পর জাহালম তখন দুদকে গিয়ে বলেন, তিনি আবু সালেক নন- সোনালী ব্যাংকে তার কোনো অ্যাকাউন্টও নেই। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আবু সালেকের যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে সেটিও তার নয়। কিন্তু দুদকে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা সেদিন জাহালমকেই ‘আবু সালেক’ হিসেবে শনাক্ত করেন। পরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোড়াশাল থেকে জাহালমকে গ্রেপ্তার করে দুদক। পরে আদালতেও জাহালম দুদকের পরিচয় বিভ্রাটের বিষয়টি তুলে ধরে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। কিন্তু কেউ তার কথা কানে তোলেননি।
এ সময় জাহালমের বড় ভাই শাহানুর বিভিন্ন মিডিয়ার সহায়তা চান। তারই ধারাবাহিকতায় মিডিয়ার পরামর্শে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনে যান এবং আবেদন করেন তার ভাইকে বিনা অপরাধে হাজতবাস খাটতে হচ্ছে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে জাহালমের সঙ্গে কথা বলেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। পরে মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে, আবু সালেক আর জাহালম একই ব্যক্তি নন। এ মামলার অন্যতম আসামি নজরুল ইসলাম ওরফে সাগরের সঙ্গেও কাশিমপুর কারাগারে কমিশনের কথা হয়। পরে কমিশন জানতে পারেন এ ঘটনার প্রধান আবু সালেক মিরপুরের শ্যামল বাংলা আবাসন প্রকল্পের মালিক। এ সময় দুদকের মহাপরিচালক (আইন) মঈদুল ইসলাম দুদকের অধিকতর তদন্তে জাহালমের নির্দোষের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে বলে বক্তব্য দিয়ে তা আদালতকে তা জানান। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় ‘ভুল আসামির’ কারাগারে থাকার ব্যাখ্যা জানতে দুদক চেয়ারম্যানের মনোনীত প্রতিনিধিসহ চারজনকে তলব করেন হাইকোর্ট। এরপর আইনী জটিলতা কাটিয়ে দীর্ঘ তিনবছর হাজতবাস করে মুক্তি পায় জাহালম। রোববার(৩ ফেব্রুয়ারি) রাত ১২টা ৫৮ মিনিটে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে পাটকল শ্রমিক জাহালমকে মুক্তি দেয়া হয়। জাহালম টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ধুবুরিয়া গ্রামের মৃত ইউসুফ আলীর ছেলে। জাহালমরা তিন ভাই আর তিন বোন। কারামুক্তির পর জাহালম তার বড় ভাই শাহানুর মিয়ার সঙ্গে ভোররাত ৪টায় গ্রামের বাড়িতে আসেন।
জাহালমের আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত বলেন, জাহালমকে ২৬ মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে আরও ৭ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল না হওয়ায় সে বিষয়ে আদেশ দেননি আদালত। ফলে তার মুক্তিতে আর বাধা থাকছে না।
জাহালমের মা মনোয়ার বেগম বলেন, আমার ছেলে পড়ালেখা জানে না। সে কিভাবে ব্যাংকের এতো টাকা আত্মসাৎ করবে? আমার ছেলে বিনা অপরাধে তিন বছর হাজতবাস করেছে। আমার ছেলের এতো বড় ক্ষতি কেন করলো? যারা এ কাজ করেছে তাদের বিচার চাই। অনেক দেরি হলেও আমার ছেলে আমার কাছে ফিরে এসেছে আমি এতে অনেক খুশি। কিন্তু বিনা অপরাধে যে শাস্তি আমার ছেলে ভোগ করেছে এর বিচার চাই। আজ আমরা নিঃস্ব। আমাদের থাকার ঘর ছাড়া আর তো কিছুই নেই। প্রতিদিন পাওনাদাররা বাড়ি আসে তাদের টাকা ফেরত নেয়ার জন্য। আমরা তো সব কিছু হারিয়েছি এখন এই ক্ষতিপূরণ দিবে কে? সরকারের কাছে আমরা সহায়তা করার জন্য জোর দাবি জানাই।
জাহালমের বড় ভাই শাহানুর বলেন, আমার ভাইকে দুদক ৩৩টি মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে। তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য আমার ভাইকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। যারা এর সাথে জড়িত তাদের বিচার চাই। আজ বিনা অপরাধে আমার ভাই তিন বছর হাজতবাস করেছে। তাকে জেল থেকে মুক্ত করানোর জন্য আমাদের যা কিছু ছিল সব বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। এখন আমরা কি করবো। আমরা এর ক্ষতিপূরণ চাই।
এলাকাবাসী জানায়, জাহালম ছোট থেকে আমাদের সামনে বড় হয়েছে। তাকে কখনো কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ করতে দেখি নাই। কোন প্রকার খারাপ কাজে দেখি নাই। সে ছেলে কিভাবে এতো বড় অপরাধ করবে? আমরা এটা কখনো বিশ্বাস করি নাই। আজ সত্যের জয় হয়েছে। কিন্তু পাড়া- প্রতিবেশি হিসেবে কষ্ট এতটুকুই মিথ্যা মামলার কারণে একটি পরিবার আজ নিঃস্ব। সামাজিকভাবে ও আর্থিকভাবে জাহালমের পরিবার যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা কখনোই পূরণ হবে না। আমরাও চাই এ কাজের সাথে যারা জড়িত তাদের বিচার করবে সরকার। সেই সাথে এই পরিবারের পাশে থাকবে।
মিথ্যা মামলার শিকার জাহালম মিয়া বলেন, আমি তো ঘোড়াশালের পাটকলে শ্রমিকের কাজ করতাম। দিন আনতাম দিন খাইতাম। আমার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কনোমতে দিন কাটাইতাম। কিন্তু একদিন দুদক থেকে আমার কারখানায় কয়েকজন স্যার আমার সাথে দেখা করতে যায়। আর একটি ছবি দেখিয়ে বলে এটা আমি কিনা। কিন্তু আমি তাদের বার বার না করলেও তারা আমার কথা শোনেনি। তারা আমাকে অন্য একজনের সাথে ছবির মিল দেখিয়ে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠায়। এতোটা বছর জেলে আমার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমার পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য অনেক কষ্ট করেছে আমাকে জেল থেকে ছাড়ানোর জন্য। আজ আমার বাপের ভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। এখন আমরা কি করবো বুঝতে পারছি না। যারা আমাকে এইভাবে জেলে দিছে তাদের বিচার চাই। এতদিন অনেক কষ্টে ছিলাম। আজ বাবা-মা, ভাই বোন, স্ত্রী-সন্তানের কাছে আসতে পেরে আমি অনেক শান্তি পাইতাছি। আমি যে জেল থেকে ছাড়া পাবো তাও কখনো ভাবতে পারিনি। আমার জীবনের তিনটি বছর হারিয়ে গেছে। এর ক্ষতিপূরণ দিবে কে? সরকারের কাছে একটাই দাবি আমাদের পরিবারের পাশে থাকবে এবং এর কঠিন বিচার করবে।
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস
সর্বশেষ আপডেট
-
ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেনের সময়সূচি ও ভাড়ার তালিকা
-
এমপিরা কোনো প্রার্থীর প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না :: ইসি আলমগীর
-
টাঙ্গাইলে দুর্ঘটনায় রেললাইনের উপর বাস ॥ অল্পের জন্য যাত্রীদের প্রাণরক্ষা
-
ভারতের কোলকাতায় সবুজ পৃথিবীর কমিটি গঠন
-
ঘাটাইলে গরুসহ গাড়ি ফেলে পালিয়েছে চোরচক্র
-
টাঙ্গাইলে প্রচণ্ড দাবদাহে জনজীবন ওষ্ঠাগত ॥ হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর চাপ বাড়ছে
-
পুলিশের বাগড়া দেওয়া অসম প্রেমিক দুই ছাত্রীর জামিন মঞ্জুর
-
আ’লীগ কার্যালয়ের তালা ভাঙার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের বিক্ষোভ মিছিল
-
বংশাই নদীতে ব্রিজের অভাবে ২৫ গ্রামবাসীর ঝুঁকিতে পারাপার