আজ- ১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ মঙ্গলবার  দুপুর ১:০৬

ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি-৬ :: শীত-গ্রীস্মে ফ্যাশনেবল টাঙ্গাইল শাড়ি

 

বুলবুল মল্লিক:


টাঙ্গাইল শাড়ি শুধু টাঙ্গাইলেরই গর্বের বস্তুই নয়- এ নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করে। আর এর সুনাম ও চাহিদা শুধু দেশে নয়; প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ছাড়িয়ে ইউরোপ-আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ চিন-জাপানেও বিস্তৃত। টাঙ্গাইলের এই শাড়ির ঐতিহ্য প্রায় আড়াই শ’ বছরের।
একটি তথ্যে জানা যায়, এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তনের সময় ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে মসলিন শাড়ির কিছু শিল্পী এসে টাঙ্গাইলে বসতি স্থাপন করেন। তাদের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ কুটিরশিল্প হিসেবে তাঁতশিল্পের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সে সময় টাঙ্গাইলে মসলিন শাড়িও তৈরি হতো। টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ির বড় বৈশিষ্ট্য হলো অতি মিহি সুতায় নিপুণভাবে বোনা। তাঁতে এই শাড়ি বোনার সময়ই মাড় দেওয়ার কৌশলটিও লক্ষণীয় এবং বোনার পর তা বাজারজাত করার জন্য ইস্ত্রির প্রয়োজন পড়ে না। এই শাড়ি বোনার সময়ই নিপুণ শিল্পীরা এতে নানা রকম ফুল বা নকশা কাটেন। আর এই নকশা কাটা শাড়ির একটির নাম জামদানি।
‘জামদানি’ আরবি শব্দ, যার অর্থ ফুল-কাটা বা নকশা-তোলা। আর এ কারণেই নকশা তোলা শাড়ির নাম হয়েছে ‘জামদানি’। জামদানি শাড়ির আদি এলাকা মূলত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। কিন্তু টাঙ্গাইলের মিহি তাঁতের শাড়িতে ফুল তোলার মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইলের জামদানি শাড়ির যাত্রা শুরু হয় এবং এই শাড়ির ঐতিহ্য এখন টাঙ্গাইল দখল করে নিয়েছে। টাঙ্গাইলের জামদানি শাড়ির রঙেরও নানা বাহার। শুধু জামদানি নয়, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি মানেই চিরায়ত বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দ। জামদানি শুধু সুতিই হয় না- এখন সিল্ক এবং সিনথেটিক সুতাতেও এ শাড়ি বোনা হয়ে থাকে। এর নামও যেমন হরেক রকম, দামও তেমন অনেক রকম।
মুঘল শাসনামলে বাংলার বস্ত্রশিল্প বিশেষ করে জামদানি ও মসলিন ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করে। এরপর ব্রিটিশরা বাংলার এই ঐতিহ্যকে ধংস করার বহু চেষ্টা করেছে। অনেকখানি সফলও হয়েছে কিন্তু তারপরও এখনো হারানো গৌরব ধরে রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে টিকে আছে তাঁতশিল্প। ঢাকার জামদানি যেমন বিখ্যাত তেমনি টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িরও রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সুখ্যাতি। তাঁতের শাড়ির প্রসঙ্গ এলে চোখবুজে বাঙালি রমণীর সামনে প্রথমেই ভেসে ওঠে টাঙ্গাইল শাড়ি।
নরম, টেকসই, আরামদায়ক এবং শীত ও গ্রীস্ম ঋতুতে সমান সমাদৃত হওয়ায় এই শাড়ি এ দেশের নারীদের কাছে এতো জনপ্রিয়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় টাঙ্গাইলের শাড়িতে এসেছে অনেক বৈচিত্র্য। মিহি জমিন আর তুলনামূলক ভারি পাড়, সেই সাথে কারুকাজ করা আঁচলই তাঁতের শাড়ির বৈশিষ্ট্য। টাঙ্গাইলের শাড়ির বুননে রয়েছে নিজস্ব ডিজাইন ও নকশা। ফুল, জ্যামিতিক ডবি, জ্যাকার্ড, নকশা, কলকা বিভিন্ন মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয় শাড়ির জমিনে। টাঙ্গাইলের শাড়ির মোটিফ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভ্রমরা, তাবিজ, রাজমহল, অর্ধচন্দ্র, চাঁদমালা, রতনচোখ, নীলাম্বরী, বেনকি, তারা, ফুলপাতা। পেইন্ট, হ্যান্ডপেইন্ট, অ্যামব্রয়ডারি, কারচুপি প্রভৃতি মাধ্যমও ব্যবহার করা হয় ডিজাইনে বৈচিত্র্য আনতে। আজকাল অনেক আধুনিক নকশা ও মাধ্যম ব্যবহার করা হয় টাঙ্গাইল শাড়িতে ডিজাইন ফুটিয়ে তোলার জন্য।
বলা হয়ে থাকে, আধুনিকতা ও ঐতিহ্য এই দুই মিলেই ফ্যাশন। ফ্যাশনধারায় ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়ির জনপ্রিয়তা ছোট তাঁতীরা প্রতিটি নকশায়, সুতার কাজে দেশিয় ভাব ফুটিয়ে তোলেন- একজন দেশপ্রেমিকের ন্যায়। আবার তাঁতের শাড়ির সঙ্গে সাজে আধুনিক ভাব আনা যায় অনায়াসে। অত্যাধুনিক ললনারা চুলের সাজের সাথে শাড়ি পড়ার উদ্দেশকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে পারেন। শাড়ি দিয়ে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করে ফেলার পাশাপাশি সহজেই সবার নজর কাড়া যায়।
তপ্ত রৌদ্রের প্রচন্ড গরমে নারীদের প্রথম পছন্দ হচ্ছে তাঁতের সুতি শাড়ি এবং সুতি সালোয়ার-কামিজ। শীত ও গ্রীস্মের গরমে তাঁতের শাড়ির ব্যবহার এবং চাহিদা দু’টোই বেড়ে যায়। গ্রীস্মের খরতাপের হাঁসফাঁস থেকে রেহাই পেতে আরামদায়ক শাড়ি বা ড্রেসের বিকল্প নেই। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়ি বছরজুড়ে নানা ধরনের শাড়ির চাহিদা লক্ষণীয় হলেও শীত ও গরমে বিভিন্ন ডিজাইনের ফ্যাশনেবল তাঁতের শাড়িই নারীর পছন্দের শীর্ষে চলে আসে।
টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি পুরোপুরি হাতের সাহায্যে তৈরি শাড়ি। হ্যান্ডলুমের এই শাড়ি তৈরির সময় এর মান যেন অক্ষুন্ন থাকে সে বিষয়ে বিশেষ যতœ নেয়া হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির বৈচিত্র্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ক্যাজুয়াল বা উৎসবে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত শাড়ি যেমন আছে তেমনি উৎসব অনুষ্ঠানে পড়ার মতো গর্জিয়াস বা জমকালো শাড়িও পাওয়া যায় টাঙ্গাইল শাড়ির ভান্ডারে। ছোট বুটি, বড় বুটি, চওড়া ও চিকন পাড়, চওড়া আঁচল, জড়ির সুতা দিয়ে করা নকশা, জামদানি নকশা, হাফ হাফ, চেক, ডুরে, অলওভার কাজ, প্লেন জমিন আরো কত ধরনের নকশা যে টাঙ্গাইলের শাড়িতে করা হয় সে কথা বলে শেষ করা যাবে না। দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে টাঙ্গাইল শাড়ির চাহিদা ব্যাপকতা ছাড়িয়ে ঈর্ষান্বিত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
টাঙ্গাইল জেলা তাঁতী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক জানান, ছয় ঋতুর প্রত্যেক ঋতুতেই টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাঁতীদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, উৎপাদিত শাড়ির বাজারজাত করণ। বাজার ব্যবস্থাপনা সীমিত থাকায় মাঠ পর্যায়ের তাঁতীরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও স্থানগত কারণে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরপৌলী, আলোকদিয়া সহ ৫-৬টি গ্রামের তাঁতীরা এ কুটির শিল্পের মূল ধারায় যুক্ত হতে পারছেনা।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno