আজ- ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  দুপুর ২:৩০

কৃষকের সোনালী স্বপ্ন কেড়ে নিচ্ছে ঝড়-শিলাবৃষ্টি

 

বুলবুল মল্লিক:


টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার হাইব্রিড, ঊফশী ও স্থানীয় জাতের বোরো আবাদের মাঠজুড়ে পাঁকা-আধাপাকা সোনালী ধান। জেলায় এবার ধানের বাম্পার ফলন হলেও প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে কৃষকরা মাঠের ফসল ঘরে তুলতে পারছেন না। ফলে ধানের বাম্পার ফলন মৌসুমের বৈশাখী ঝড় ও টানাবৃষ্টির সাথে বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি কৃষকের স্বপ্ন কেড়ে নিচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার দিগন্তজোড়া সোনালী-রূপালী ধানের সমারোহ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো কৃষকের স্বপ্নমাখা সোনার ফসল আর কয়েকদিন পরই কৃষকের ঘরে উঠার কথা। কিন্তু গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ কৃষকের স্বপ্নকে ভেঙে দিয়েছে। ভারি বর্ষণ আর বৈশাখী ঝড়ে পাঁকা ধান মাটিতে নূয়ে পড়েছে। গ্রীস্মের এ সময় এমন ভারি বর্ষণ কৃষক আগে কখনো দেখেনি। বোনা স্বপ্নের এমন অবস্থায় কৃষকের ঘরে ঘরে চলছে হতাশা। এ বছর ধানের চারা রোপনের পর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গত বছরের তুলনায় ফলন অনেক ভাল হয়েছে। কিন্তু কালবৈশাখী ঝড় আর টানা বৃষ্টিতে লাভের বদলে লোকসানের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কালবৈশাখী ঝড়, ভারী বর্ষন বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টিতে নিচু জমি ও চরাঞ্চলের জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে যেসব কৃষক অধিক শ্রমিক মূল্য দিয়ে ধান কাটছে তারা বৃষ্টির কারণে মাড়াই ও শুকাতে পারছে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানাগেছে, চলতি মৌসুমে হাইব্রিড জাতের দুই হাজার ২১৩ হেক্টর জমিতে ১০ হাজার ৫৩৫ মে.টনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঊফশী জাতের বোরো চাষে এক লাখ ৬৩ হাজার ৮৯৩ হেক্টর জমিতে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ১১২ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। স্থানীয় জাতের ৭৯১ হেক্টর জমিতে এক হাজার ৫৩৮ মে.টন বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যানে এবার জেলায় মোট ১৬ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮ হেক্টর জমিতে ৬৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৫ মেট্রিকটন বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
কৃষি বিভাগের উপজেলা ওয়ারি পরিসংখ্যানে জানাগেছে, এবার টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৭৫ হেক্টরে ৩৫৭ মে.টন, ঊফশী জাতের ১৩ হাজার ৯১০ হেক্টরে ৫৪ হাজার ৬৬৭ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ২০ হেক্টরে ৩৯ মে.টন; মোট ১৪ হাজার ৫ হেক্টর জমিতে ৫৫ হাজার ৬৩ মে.টন বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
বাসাইল উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৫ হেক্টরে ২৪ মে.টন, ঊফশী ১০ হাজার ৮৬৯ হেক্টরে ৪২ হাজার ৭১৫ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ২০ হেক্টরে ৩৯ মে.টন; মোট ১০ হাজার ৮৯৪ হেক্টরে ৪২ হাজার ৭৭৮ মে.টন বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কালিহাতী উপজেলায় বোরো আবাদে হাইব্রিড জাতের ৫৫ হেক্টর জমিতে ২৬২ মে.টন, ঊফশী জাতের ১৭ হাজার ৩৯৪ হেক্টর জমিতে ৬৮ হাজার ৩৫৮ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ১১০ হেক্টর জমিতে ২১৪ মে.টন; মোট ১৭ হাজার ৫৫৯ হেক্টর জমিতে ৬৮ হাজার ৮৩৪ মে.টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
ঘাটাইলে হাইব্রিড জাতের ৫৫৫ হেক্টর জমিতে দুই হাজার ৬৪২ মে.টন, ঊফশীতে ১৯ হাজার ৬৯০ হেক্টরে ৭৭ হাজার ৩৮৬ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৪০ হেক্টরে ৭৮ মে.টন; মোট ২০ হাজার ২৮৫ হেক্টরে মোট ৮০ হাজার ১০৬ মে.টনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নাগরপুরে হাইব্রিড জাতের ১৫০ হেক্টরে ৭১৪ মে.টন, ঊফশী জতের ১৫ হাজার ৮০০ হেক্টরে ৬২ হাজার ৪৯৪ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৩৪ হেক্টরে ৬৬ মে.টন; মোট ১৫ হাজার ৯৮৪ হেক্টরে ৬২ হাজার ৮৭৪ মে.টন বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
মির্জাপুরে হাইব্রিড জাতের ৯৫ হেক্টরে৪৫২ মে.টন, ঊফশী জাতের ১৯ হাজার ৬৬০ হেক্টরে ৭৭ হাজার ২৬৪ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৯৮ হেক্টরে ১৯০ মে.টন; মোট ১৯হাজার ৮৫৩ হেক্টরে ৭৭ হাজার ৯০৬ মে.টন বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মধুপুর উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ২২৫ হেক্টরে এক হাজার ৭১ মে.টন, ঊফশী জাতের ১১ হাজার ৭১৫ হেক্টরে ৪৬ হাজার ৪০ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৩ হেক্টরে ৬ মে.টন; মোট ১১ হাজার ৯৪৩ হেক্টরে ৪৭ হাজার ১১৭ মে.টন বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভূঞাপুর উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ২৪ হেক্টরে ১১৯ মে.টন, ঊফশী জাতের ৬ হাজার ১৭০ হেক্টরে ২৪ হাজার ২৪৮ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৪৩০ হেক্টরে ৮৩৫ মে.টন; মোট ৬ হাজার ৬২৫ হেক্টরে ২৫ হাজার ২০২ মে.টন বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
গোপালপুর উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৫০০ হেক্টরে দুই হাজার ৩৮০ মে.টন, ঊফশী জাতের ১৩ হাজার ১৮৮ হেক্টরে ৫১ হাজার ৮৩০ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৫ হেক্টরে ১০ মে.টন; মোট ১৩ হাজার ৬৯৩ হেক্টরে ৫৪ হাজার ২২০ মে.টন বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সখীপুর উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৩৫ হেক্টর জমিতে ১৬৭ মে.টন, ঊফশী জাতের ১৬ হাজার ৩৯৫ হেক্টর জমিতে ৬৪ হাজার ৪৩৩ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ২১ হেক্টরে ৪১ মে.টন; মোট ১৬ হাজার ৪৫১ হেক্টর জমিতে ৬৪ হাজার ৬৪১ মে.টন বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
দেলদুয়ার উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৫ হেক্টর জমিতে ২৪ মে.টন, ঊফশী জাতের ৯ হাজার ৩০০ হেক্টরে ৩৬ হাজার ৫৫০ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৫ হেক্টর জমিতে ১০ মে.টন; মোট ৯ হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে ৩৬ হাজার ৫৮৪ মে.টন বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ধনবাড়ী উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৪৮৮ হেক্টর জমিতে দুই হাজার ৩২৩ মে.টন, ঊফশী জাতের ৯ হাজার ৮০৩ হেক্টর জমিতে ৩৮ হাজার ৫২৭ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৪ হেক্টরে ১০ মে.টন; মোট ১০ হাজার ২৯৬ হেক্টর জমিতে ৮০ হাজার ৮৬০ মে.টন বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
প্রচন্ড শীতের কারণে এবার প্রায় সব উপজেলায়ই বোরো বীজতলায় ‘কোল্ড ইনজুরি’ হয়। তার উপর ধানের চারার গোড়ায় পঁচন ধরে কোন কোন এলাকায় রোপণ করা চারা মরে যাওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। কৃষি বিভাগের সার্বক্ষণিক তৎপরতায় কৃষকরা সেব সমস্যা মোকাবেলা করতে সক্ষম হন।
নাগরপুর উপজেলার মামুদনগর গ্রামের কৃষক রমিজ উদ্দিন, কেদারপুরের কৃষক রফিক মিয়া সহ অনেকেই জানান, এবার ধানের বাম্পার ফলন হলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফসল ঘরে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ঝড়, বৃষ্টি ও বজ্রপাতের কারণে শ্রমিকরা জমিতে নামতে সাহস পাচ্ছে না। টানা বৃষ্টিতে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। ফলে নিচু জমির ধান তলিয়ে যাচ্ছে।
মির্জাপুর উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের ছিটমামুদপুর, লতিফপুর ও তরফপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া, তরফপুর ও পাথরঘাটা এলাকার কৃষক জানান, কোল্ডইনজুরির কারণে বাড়তি খরচ করে পুনরায় চারা(বীজ) কিনে জমিতে পঁচন ধরা চারার জায়গায় প্রতিস্থাপন করে ফসল ঘরে তোলার আশায় বুক বেধেছিলেন তারা। কিন্তু প্রতিকূল প্রকৃতি তাদের সহায় না হওয়ায় ধান ঘরে তোলায় আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে।
ওই এলাকার কৃষক লেহাজ উদ্দিন, জালেকা বেগম, সৈয়দ রুহুল আমিন সহ অনেকেই জানান, ওই এলাকায় প্রতি একর জমির ধান বুনতে হালচাষ, সার, শ্রমিক মজুরি ও ধানের চারা কিনতে প্রায় ৩০ হাজার টাকা কৃৃষকরা ব্যয় করেছেন। অতিরিক্ত টাকা খরচ করেও তারা চাষ করেছিলেন। জমিতে ফসলও ভাল হয়েছে। কিন্তু ঝড় ও বর্ষণে জমির ধান নূয়ে পড়েছে। বজ্রপাতের আশঙ্কায় শ্রমিকরা ধান কাটতে জমিতে নামছে না।
নাগরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিএম রাশেদুল আলম জানান, তিনি উপজেলার ভাদ্রা, সহবতপুর ও ভারড়াসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিদর্শন করে কৃষকদের শান্তনা ছাড়া কিছুই দিতে পারেন নি। যদি সামনে আর শিলা বৃষ্টি ও কালবৈশাখী ঝড় না হয় তাহলে কৃষকরা কাঙ্খিত ফলন পাবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
মির্জাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, উপজেলায় ঠান্ডার প্রভাব বেশি থাকায় কিছু এলাকার ধানের চারা মরে যায়। কৃষি কর্মকর্তারা দ্রুত যথাযথ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করায় উপজেলায় বোরো’র বাম্পার ফলন হয়েছে। ধান ঘরে উঠানোর প্রাক্কালে প্রকৃতি প্রতিকূল থাকায় কৃষকরা কিছুটা হতাশায় ভূগছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক জানান, আবাদের শুরুতে কোন কোন এলাকায় কোল্ড ইনজুরি দেখা দিলেও তা বোরো আবাদে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। জেলায় এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো-২৮ জাতের ধান চাষ হয়। তবে বোরো-২৮ জাতের ধানে কোন কোন এলাকায় ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। কৃষি কর্মকর্তারা দ্রুত সব সময় কৃষকদের পাশে থেকেছে। প্রকৃতিগত কারণে ধান ঘরে তুলতে কৃষকদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে- এটা সাময়িক। দ্রুত এ অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে তিনি আশা করেন।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno