আজ- ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ মঙ্গলবার  বিকাল ৩:০২

টাঙ্গাইলের সরিষা ফুলের মধু যাচ্ছে বিদেশে!

 

দৃষ্টি নিউজ:


টাঙ্গাইলের প্রায় সব জায়গায় এবার সরিষার আবাদ হয়েছে। সরিষা ক্ষেতের চারপাশে সারিবদ্ধভাবে মৌবাক্স বসানো হয়েছে। এসব বাক্সে পালিত মৌমাছি সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌবাক্সে জমা করছে। ওই মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষিরা।
টাঙ্গাইল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরিষার আবাদের জেলা হিসেবে পরিচিত। মৌচাষে চাষিরা একদিকে যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, অন্যদিকে দূর হচ্ছে বেকারত্ব। ইদানিং অনেক শিক্ষার্থীই লেখা-পড়ার পাশাপাশি লাভবান হওয়ার জন্য মৌচাষ করছে। মৌচাষিদের এই মধু এখন দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তবে চাষিদের দাবি সরকারের সহযোগিতা পেলে তারা এ মধুচাষের পরিধি আরো বাড়িয়ে অধিক লাভবান হতে পারেন।
সরিষা ফুলের মধু যেমন খাঁটি তেমনি সুস্বাদু। মধু উচ্চমাত্রার প্রাকৃতিক অ্যাণ্টিবায়োটিক হওয়ায় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানী ও ক্রেতাদের কাছে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
সরেজমিনে টাঙ্গাইল শহর এবং ১২টি উপজেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, সরিষা ক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধভাবে মৌবাক্স স্থাপন করা হয়েছে। আর মৌমাছিরা সরিষা থেকে মধু আহরণ করে বাক্সে জমা করছে। ওই বাক্স থেকে চাষিরা মধু সংগ্রহ করছেন। মৌবাক্সের চারদিকে মৌমাছি ভন্ ভন্- ভো ভো শব্দে ঘোরাঘুরি করছে। ওই স্থানে মৌমাছিদের মিলন মেলা তৈরি হয়েছে।
টাঙ্গাইল পৌর এলাকার সন্তোষ ঘোষপাড়ার আমিনুর রহমান বিগত ১০ বছর ধরে মৌচাষ করেন। তিনি এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। তিনি বলেন, এ বছর আমি সরিষা ক্ষেতে শতাধিক মৌবাক্স স্থাপন করেছি। এখন পর্যন্ত আমি (ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি ১ সপ্তাহ) প্রায় দেড় টন মধু সংগ্রহ করতে পেরেছি। সরিষা ক্ষেতে বছরে ৪ মাস মধু আহরণ করে থাকেন। অন্য ৬ মাস কৃত্তিম পদ্ধতিতে চিনি খাইয়ে মৌমাছিদের রাখা হয়। এবার তার প্রায় আড়াই লাখ টাকার মত খরচ হয়েছে। তিনি আশা করছেন, তার প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন তাদের কাছ থেকে মধু কিনে নিয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, সরিষা ক্ষেত থেকে মূলত ডিসেম্বর থেকে মধু আহরণের উপযুক্ত সময়। তখন জেলার বিভিন্ন স্থানে ভালো সরিষা ফুল ফোঁটে। আকার ভেদে একটি বাক্সে ২ থেকে ৪০ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। আর প্রতিটি বাক্সে খরচ হয় ২ থেকে ১২ হাজার টাকা। এছাড়া আমি লিচু থেকেও মধু সংগ্রহ করে থাকি।
আমিনুর রহমান বলেন, তার সংসারের যাবতীয় খরচ এর ওপর নির্ভরশীল। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে তাহলে আমরা মৌচাষের পরিধি আরো বাড়িয়ে বেশি লাভবান হতে পারব। কিন্তু আমি বিগত সময়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও কৃষি অফিসে গিয়ে কোনো সহযোগিতা পাইনি।
অপর মৌচাষি শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি এ পেশায় নিয়োজিত। এতে আমরা বেশ লাভবান হচ্ছি। আমাদের অনুকরণ করে অনেকেই সরিষা থেকে মৌবাক্সে মধু আহরণে আগ্রহী হচ্ছেন। সরিষা থেকে মধু আহরণে একদিকে যেমন বেকারত্ব দূর হয়, অন্যাদিকে অল্প সময়ের মধ্যে লাভবান হওয়া যায়। তিনি বলেন, অনেকেই প্রথমে সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপনে বাধা দিলেও এখন কৃষকরা বাধা দেন না, তারা অনেক বেশি সচেতন। কারণ এর ফলে সরিষার ফলন বেড়ে যায়।
গোপালপুর উপজেলার সুন্দর গ্রামের মাছুম মিয়া, বাসাইলের আয়নাল হক, কালিহাতীর মিয়া চান সহ অনেক কৃষক বলেন, মৌবাক্স স্থাপনে সরিষার ফলন ভাল হচ্ছে। মৌচাষিদের ক্ষেতে মৌবক্স স্থাপনে কোনো বাধা দেয়া হচ্ছে না। আগে বোঝার ভুলে কোন কোন কৃষক বাধা দিতেন, এখন সময় পাল্টেছে।
মৌচাষি ইয়াকুব আলী বলেন, আমাদেরকে মৌমাছি কিনে আনতে হয়। আমি প্রথমে ৫টি মৌবাক্স নিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন আমার মৌবক্স ৫০টিরও বেশি। এই কয়েক মাসের উপার্জন দিয়ে সারা বছর চলে যায়। মধু সংগ্রহে লাভবান হওয়ার কারণে অনেকেই এই পেশায় চলে আসছে।
টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলায় এ বছর সরিষার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার হেক্টর জমি। কিন্তু প্রায় ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। এতে প্রায় ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে।
এ বছর জেলায় ৭ হাজার ২০০টি মৌবক্স বসানোর টার্গেট ছিল। কিন্তু সরিষা ক্ষেতের পাশে প্রায় ১০ হাজারের মতো বাক্স বসানো হয়েছে। যা টার্গেটের চেয়ে বেশি। ডিসেম্বর পর্যন্ত মধু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার কেজি। আধুনিক প্রযুক্তি তথা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মধু আহরণ করা হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ বছর জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি সরিষা আবাদ এবং মৌবক্স স্থাপন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার কেজি মধু উৎপাদন হয়েছে। সামনে আরো মধু উৎপাদন হবে। তিনি বলেন, বিস্তীর্ণ এলাকার সরিষা ক্ষেতে মৌবক্স স্থাপন করেছে মৌচাষিরা। এতে একদিকে মৌচাষিরা কাঙ্খিত পরিমাণে মধু সংগ্রহ করে লাভবান হচ্ছেন, অন্যদিকে স্থানীয় কৃষিজমিতে সরিষার ফলনও অন্য বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কৃষিবিদ আব্দুর রাজ্জাক আরো জানান, মধু ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এখানকার মধু দেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও বিদেশেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই দেশীয় এ খাঁটি মধু বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌচাষ করলে সরিষার পরাগায়ণের ফলে শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ ফলন বৃদ্ধি পায়। কয়েক বছর আগেও সরিষা চাষিরা তাদের জমিতে মৌবাক্স স্থাপনে বাধা দিত। তাদের ধারণা ছিল মৌমাছির কারণে সরিষার ফলন কম হবে। তবে কৃষি কর্মকর্তারা বোঝাতে সক্ষম হন মৌচাষের কারণে সরিষার ফলন কমতো নয়ই বরং ফলন ভালো হয়। এরপর চাষিরা তাদের জমির পাশে মৌবাক্স স্থাপনে সহায়তা করে আসছেন।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno