আজ- ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  সকাল ৬:১৭

টাঙ্গাইলে বোরো বীজ সংকট ॥ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শঙ্কা

 

বুলবুল মল্লিক:


টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় চলতি মৌসুমে সব ধরণের বোরো বীজের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে জেলায় হাইব্রিড, ঊফশী ও স্থানীয় জাতের বোরো আবাদে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানাগেছে, চলতি মৌসুমে হাইব্রিড জাতের দুই হাজার ২১৩ হেক্টর জমিতে ১০ হাজার ৫৩৫ মে.টনের বিপরীতে ১১০.৬৫ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঊফশী জাতের বোরো চাষে এক লাখ ৬৩ হাজার ৮৯৩ হেক্টর জমিতে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ১১২ মেট্রিক টন বোরো আবাদে ৮ হাজার ১৯৪ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। স্থানীয় জাতের ৭৯১ হেক্টর জমিতে এক হাজার ৫৩৮ মে.টন বোরো আবাদের বিপরীতে ৪৯.৮৪ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যানে এবার জেলায় মোট ১৬ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮ হেক্টর জমিতে ৬৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৫ মেট্রিকটন বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এজন্য ৮ হাজার ৩৫৪.৪৯ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।
এদিকে, কোল্ড ইনজুরির কারণে কৃষি বিভাগের বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি। অধিকাংশ জমিতে বীজতলা তৈরি করা হলেও অতিরিক্ত ঠান্ডায় বীজের অঙ্কুরোদ্গম হয়নি। যেগুলো হয়েছে সেগুলোও শীতের কারণে জমিতে রোপণ করার পর গোড়ায় পঁচন ধরে শুকিয়ে মরে গেছে।
মির্জাপুর উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের ছিটমামুদপুর, লতিফপুর ও তরফপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া, তরফপুর ও পাথরঘাটা এলাকায় বোরো ধানের চারার গোড়ায় পঁচন ধরে মরে যাচ্ছে। এতে কৃষকেরা বেকায়দায় পড়েছেন। বাড়তি খরচ করে পুনরায় চারা(বীজ) কিনে জমিতে পঁচন ধরা চারার জায়গায় প্রতিস্থাপন করে ফসল ঘরে তোলার আশায় বুক বেধেছেন কৃষকরা।
ওই এলাকার কৃষক লেহাজ উদ্দিন, জালেকা বেগম, সৈয়দ রুহুল আমিন সহ অনেকেই জানান, তারা প্রায় ১৫ দিন আগে ধান বুনেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ধানের চারা মরে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন। বাধ্য হয়ে ক্ষেতে পুনরায় ধানের চারা লাগাচ্ছেন। তারা জানান, ওই এলাকায় প্রতি একর জমির ধান বুনতে হালচাষ, সার, শ্রমিক মজুরি ও ধানের চারা কিনতে প্রায় ২০ হাজার টাকা কৃৃষকরা আগেই ব্যয় করেছিলেন। পুনরায় ধান বুনতে একর প্রতি আরো ১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের উপজেলা ওয়ারি পরিসংখ্যানে জানাগেছে, এবার টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৭৫ হেক্টরে ৩৫৭ মে.টন, ঊফশী জাতের ১৩ হাজার ৯১০ হেক্টরে ৫৪ হাজার ৬৬৭ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ২০ হেক্টরে ৩৯ মে.টন; মোট ১৪ হাজার ৫ হেক্টর জমিতে ৫৫ হাজার ৬৩ মে.টন বোরো উৎপাদনের বিপরীতে হাইব্রিড-৩.৭৫ হেক্টর, ঊফশী-৬৯৫ হেক্টর ও স্থানীয়-১.২৫ হেক্টর জমিতে মোট ৭০০ হেক্টর বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
বাসাইল উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৫ হেক্টরে ২৪ মে.টন, ঊফশী ১০ হাজার ৮৬৯ হেক্টরে ৪২ হাজার ৭১৫ মে.টন ও স্থানীয় জাতে ২০ হেক্টরে ৩৯ মে.টন; মোট ১০ হাজার ৮৯৪ হেক্টরে ৪২ হাজার ৭৭৮ মে.টন বোরো আবাদের বিপরীতে হাইব্রিড-০.২৫ হেক্টর, ঊফশী-৫৪৩ হেক্টর ও স্থানীয়-১.২৫ হেক্টর জমিতে মোট ৫৪৪.৫ হেক্টর বীজতলা তৈরি করা হয়েছে।
কালিহাতী উপজেলায় বোরো আবাদে হাইব্রিড জাতের ৫৫ হেক্টর জমিতে ২৬২ মে.টন, ঊফশী জাতের ১৭ হাজার ৩৯৪ হেক্টর জমিতে ৬৮ হাজার ৩৫৮ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ১১০ হেক্টর জমিতে ২১৪ মে.টন; মোট ১৭ হাজার ৫৫৯ হেক্টর জমিতে ৬৮ হাজার ৮৩৪ মে.টন উৎপাদনের বিপরীতে হাইব্রিড-২.৭৫ হেক্টর, ঊফশী-৮৭০ হেক্টর ও স্থানীয়-৭ হেক্টরে মোট ৮৭৯.৭৫ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
ঘাটাইলে হাইব্রিড জাতের ৫৫৫ হেক্টর জমিতে দুই হাজার ৬৪২ মে.টন, ঊফশীতে ১৯ হাজার ৬৯০ হেক্টরে ৭৭ হাজার ৩৮৬ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৪০ হেক্টরে ৭৮ মে.টন; মোট ২০ হাজার ২৮৫ হেক্টরে মোট ৮০ হাজার ১০৬ মে.টনের বিপরীতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে হাইব্রিড-২৭.৭৫ হেক্টর, ঊফশী-৯৮৫ হেক্টর ও স্থানীয়-২.৫ হেক্টর জমিতে মোট এক হাজার ১৫.২৫ হেক্টর।
নাগরপুরে হাইব্রিড জাতের ১৫০ হেক্টরে ৭১৪ মে.টন, ঊফশী জতের ১৫ হাজার ৮০০ হেক্টরে ৬২ হাজার ৪৯৪ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৩৪ হেক্টরে ৬৬ মে.টন; মোট ১৫ হাজার ৯৮৪ হেক্টরে ৬২ হাজার ৮৭৪ মে.টন বোরো আবাদের বিপরীতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে হাইব্রিড-৭.৫ হেক্টর, ঊফশী-৭৯০ হেক্টর ও স্থানীয়-২.১২ হেক্টর জমিতে মোট ৭৯৯.৬২ হেক্টর।
মির্জাপুরে হাইব্রিড জাতের ৯৫ হেক্টরে৪৫২ মে.টন, ঊফশী জাতের ১৯ হাজার ৬৬০ হেক্টরে ৭৭ হাজার ২৬৪ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৯৮ হেক্টরে ১৯০ মে.টন; মোট ১৯হাজার ৮৫৩ হেক্টরে ৭৭ হাজার ৯০৬ মে.টন বোরো উৎপাদনের বিপরীতে হাইব্রিড-৪.৭৫ হেক্টর, ঊফশী-৯৮৩ হেক্টর ও স্থানীয়-৬.১২ হেক্টর জমিতে মোট ৯৯৩.৮৭ হেক্টরে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে।
মধুপুর উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ২২৫ হেক্টরে এক হাজার ৭১ মে.টন, ঊফশী জাতের ১১ হাজার ৭১৫ হেক্টরে ৪৬ হাজার ৪০ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৩ হেক্টরে ৬ মে.টন; মোট ১১ হাজার ৯৪৩ হেক্টরে ৪৭ হাজার ১১৭ মে.টন বোরো আবাদের বিপরীতে হাইব্রিড-১১.২৫ হেক্টর, ঊফশী-৫৮৬ হেক্টর ও স্থানীয়-০.১৮ হেক্টর জমিতে মোট ৫৯৭.৪৩ হেক্টরে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভূঞাপুর উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ২৪ হেক্টরে ১১৯ মে.টন, ঊফশী জাতের ৬ হাজার ১৭০ হেক্টরে ২৪ হাজার ২৪৮ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৪৩০ হেক্টরে ৮৩৫ মে.টন; মোট ৬ হাজার ৬২৫ হেক্টরে ২৫ হাজার ২০২ মে.টন বোরো উৎপাদনের বিপরীতে হাইব্রিড-১.২৫ হেক্টর, ঊফশী-৩০৮ হেক্টর ও স্থানীয়-২৭ হেক্টর জমিতে মোট ৩৩৬.২৫ হেক্টরে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
গোপালপুর উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৫০০ হেক্টরে দুই হাজার ৩৮০ মে.টন, ঊফশী জাতের ১৩ হাজার ১৮৮ হেক্টরে ৫১ হাজার ৮৩০ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৫ হেক্টরে ১০ মে.টন; মোট ১৩ হাজার ৬৯৩ হেক্টরে ৫৪ হাজার ২২০ মে.টন বোরো আবাদের বিপরীতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে হাইব্রিড-২৫ হেক্টর, ঊফশী-৬৫৯ হেক্টর ও স্থানীয়-০.৩১ হেক্টর জমিতে মোট ৬৮৪.৩১ হেক্টর।
সখীপুর উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৩৫ হেক্টর জমিতে ১৬৭ মে.টন, ঊফশী জাতের ১৬ হাজার ৩৯৫ হেক্টর জমিতে ৬৪ হাজার ৪৩৩ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ২১ হেক্টরে ৪১ মে.টন; মোট ১৬ হাজার ৪৫১ হেক্টর জমিতে ৬৪ হাজার ৬৪১ মে.টন বোরো আবাদের বিপরীতে হাইব্রিড-১.৭৫ হেক্টর, ঊফশী-৮২০ হেক্টর ও স্থানীয়-১.৩১ হেক্টর মোট ৮২৩.০৬ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
দেলদুয়ার উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৫ হেক্টর জমিতে ২৪ মে.টন, ঊফশী জাতের ৯ হাজার ৩০০ হেক্টরে ৩৬ হাজার ৫৫০ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৫ হেক্টর জমিতে ১০ মে.টন; মোট ৯ হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে ৩৬ হাজার ৫৮৪ মে.টন বোরো উৎপাদনে হাইব্রিড-০.২৫ হেক্টর, ঊফশী-৪৬৫ হেক্টর ও স্থানীয়-০.৪ হেক্টর; মোট ৪৬৫.৬৫ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ধনবাড়ী উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ৪৮৮ হেক্টর জমিতে দুই হাজার ৩২৩ মে.টন, ঊফশী জাতের ৯ হাজার ৮০৩ হেক্টর জমিতে ৩৮ হাজার ৫২৭ মে.টন ও স্থানীয় জাতের ৪ হেক্টরে ১০ মে.টন; মোট ১০ হাজার ২৯৬ হেক্টর জমিতে ৮০ হাজার ৮৬০ মে.টন বোরো উৎপাদনের বিপরীতে হাইব্রিড-২৪.৪ হেক্টর, ঊফশী-৪৯০ হেক্টর ও স্থানীয়-০.৪ হেক্টর; মোট ৫১৪.৮ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
প্রচন্ড শীতের কারণে এবার প্রায় সব উপজেলায়ই বোরো বীজতলায় ‘কোল্ড ইনজুরি’ হয়েছে। তার উপর ধানের চারার গোড়ায় পঁচন ধরে মরে যাওয়ায় সমস্যা আরো বেড়েছে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের ওমরপুর ঘাট এলাকায় ব্রিজের মুখে মাটি ভরাট করায় ৩০০ একর জমিতে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বোরো জমি অনাবাদী রাখা হচ্ছে। এছাড়া ধনবাড়ী, সখীপুর, ঘাটাইল, ভূঞাপুর, মির্জাপুর ও বাসাইল উপজেলায় ইটভাটা স্থাপন সহ সেচ নিয়ে বিরোধে বেশকিছু জমি অনাবাদী থাকছে বলে জানাগেছে।
এলেঙ্গা পৌরসভার বোরো বীজ বিক্রেতা মো. আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি প্রতি মৌসুমে ধানের বীজ বিক্রি করেন। এবার বিএডিসি থেকে ১০কেজি ধানবীজ এনে ‘বিছরায়’(বীজতলায়) ছিটান। কিন্তু সেই বীজ ভালভাবে গজায়নি। যেগুলো গজিয়েছে সেগুলোও প্রচন্ড ঠান্ডায় কুঁকড়ে গেছে মরে গেছে, কিছু একেবারেই গজায়নি। গত বছরের তুলনায় এবার গাছি বা বিছরার(ধানের চারা) চাহিদা বেশি দামও আকাশ ছোঁয়া। কালিহাতী উপজেলার মশাজান গ্রামের ধানের গাছি বিক্রেতা দুলাল মন্ডলও প্রায় একই কথা বলেন। ফলে জেলার প্রধান রবি ফসল বোরো চষে কাঙ্খিত ফলন তথা কৃষি বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
মির্জাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, তিনি সম্প্রতি মির্জাপুরে যোগদান করেছেন। ঠান্ডার প্রভাব বেশি থাকায় ধানের চারা মরে যেতে পারে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
এ প্রসঙ্গে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক জানান, কোল্ড ইনজুরি দেখা দিলেও তা বোরো আবাদে তেমন প্রভাব পড়বে না। ধানের চারা মরে যাওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। সদর উপজেলার ওমরপুরের বিষয়টি সম্পর্কে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি, অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। বোরো আবাদে তারা কোন প্রণোদনা কৃষককে দেননি, জেলায় কোন বোরো বীজতলাও তৈরি করা হয়নি। তারপরও সব সমস্যা কাটিয়ে এবছর বোরো আবাদে লক্ষ্যমাত্রা পুরনের আশা করছেন তিনি।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno