অবৈধ কারখানার আধিক্য প্রশিক্ষণ বিহীন চালক অনিয়মই নিয়মে পরিনত
*মু. আবিদ মল্লিক জয়:

টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় অনুমোদনহীন কারখানায় অবাধে ব্যাটারি চালিত রিকশা-অটোরিকশা তৈরি ও প্রশিক্ষণহীন চালক এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে টাঙ্গাইল শহরে এসব রিকশা-অটোরিকশার রাজত্ব চলছে। ফলে পৌরসভার প্রায় প্রতিটি সড়কে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি রিকশা-অটোরিকশা চলাচলে অসহনীয় যানজটে শহরবাসী দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। সীমাহীন যানজটে অফিস টাইমে স্থবির হয়ে পড়ছে শহরের রাস্তাঘাট। ঘণ্টর পর ঘণ্টা যানজটের কবলে আটকা পড়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে অফিস যাত্রী ও স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা।
টাঙ্গাইল পৌরসভার লাইসেন্স শাখা সূত্রে জানা যায়, পৌরসভার লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার সংখ্যা ছয় হাজার এবং পায়ে চালিত বা প্যাডেল রিকশা রয়েছে পাঁচ হাজার। ভ্রাটারি চালিত অটোরিকশার লাইসেন্স ফি ১০ হাজার ৫০০ এবং পায়ে চালিত রিকশার লাইসেন্স ফি এক হাজার টাকা। ইতোপূর্বে লাইসেন্স দেওয়ার সময় টাঙ্গাইলে পৌরসভার ১০ হাজার ৫০০ টাকা ফি’র পরিবর্তে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার লাইসেন্স এক থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
সারাদেশে ব্যাটারি চালিত রিকশা ও রিকশাভ্যান বন্ধে ২০২১ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে সড়ক পরিবহন বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত অমান্য করে টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন মেয়র এসএম সিরাজুল হক আলমগীর ব্যাটারি চালিত এসব রিকশা-অটোরিকশার লাইসেন্স দেন।
বিগত সময়ে পৌরসভা থেকে পায়ে চালিত বা প্যাডেল রিকশার লাইসেন্স পৌরসভার এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাটারি চালিত রিকশায়। এটা পৌরসভার আইন অনুযায়ী বিধি বহির্ভূত। কিছু কিছু রিকশার মালিক একই নামে দশের অধিক লাইসেন্স নিয়ে ব্যাটারি চালিত রিকশা কিনে চালকদের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন।
পৌরসভার তালিকায় ছয় হাজার ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ও পাঁচ হাজার পায়ে চালিত বা প্যাডেল রিকশার অনুমোদন থাকলেও বাস্তবে শহরে এর ৩ থেকে ৪ গুন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। এই বাড়তি রিকশাগুলো টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে মা মটরস, বিসমিল্লাহ মটরস, একতা মটরসসহ আরো নামে-বেনামে ৩০টির অধিক অনুমোদনহীন ভাবে গড়ে ওঠা কারখানায় তৈরি করে শহরের সড়কে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে টাঙ্গাইলে ব্যাটারি চালিত রিকশা-অটোরিকশা চলাচলে অনিয়মই যেন নিয়মে পরিনত হয়েছে।
ওইসব রিকশা-অটোরিকশার পাশাপাশি টাঙ্গাইল শহরে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট-বড় ১২৮টি পরিবহন, সরকারি বেসরকারি অফিস, ব্যাংক-বীমা, আদালতের যানবাহন, চিকিৎসক ও ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ির পাশাপাশি গড়ে প্রতিদিন তিন সহস্রাধিক মোটরসাইকেল চলাচল করছে। একই সঙ্গে ইমারত তৈরির সরঞ্জামাদী ও বালুবাহী ট্রাক-ড্রামট্রাক সব সময় শহরে চলাচল করছে। ফলে শহরের জেলা সদর রোড, বেবীস্ট্যান্ড, শান্তিকুঞ্জ মোড়, মেইন রোড, নিরালা মোড়, পার্কবাজার মোড়, ক্যাপসুল মার্কেট, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, সুপারি বাগান মোড়, কলেজ গেট, নতুন বাস টার্মিনাল, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নিয়মিত যানজটে আটকা পড়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। শহরজুড়ে লাগামহীন যানজট লেগে থাকায় ব্যাটারি চালিত রিকশা চলাচলে দুই শিফট চালু করা হলেও বালুবাহী ট্রাক-ড্রামট্রাক ও ইমারত তৈরির সরঞ্জামাদীর যানবাহন চলাচলে কোনো বিধিনিষেধ মানা হচ্ছেনা।

অনুমোদনহীন ভাবে গড়ে ওঠা ওইসব কারখানার অধিকাংশ মিস্ত্রিদের কোনো ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ বা শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরিকৃত এসব ব্যাটারি চালিত রিকশা ও অটোরিকশা প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে। এছাড়া প্রশিক্ষণহীন অদক্ষ চালকদের হাতে এসব রিকশার হ্যান্ডেল বা স্টিয়ারিং থাকায় শহরের সড়কগুলোতে প্রতিদিনই একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব রিকশা-অটোরিকশাগুলোর ব্যাটারি চার্জ করতে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ ব্যয় হওয়ায় দিনদিন শহরে লোডশেডিং বাড়ছে। শহরের যানজট নিরসনে মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও মাত্রাতিরিক্ত ব্যাটারি চালিত রিকশা-অটোরিকশার কারণে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
সরজমিনে টাঙ্গাইল-বাঘিল আঞ্চলিক সড়কে দাইন্যা ইউনিয়নের চিলাবাড়ি এলাকার মা-মটরস কারখানায় দেখা যায়, তিনজন কারিগর ব্যাটারি চালিত রিকশার নতুন অনেকগুলো বডি তৈরি করছেন। এদের দুইজনকে রংপুর ও ময়মনসিংহ থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে। এছাড়া একজন ১২ বছরের কিশোর নিরাপত্তা পোশাক ছাড়াই ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করছে। তারা জানায়, প্রতিটি রিকশার বডি তৈরি করলে ব্যাটারি চালিত রিকশার ক্ষেত্রে এক হাজার ২০০ টাকা ও অটোরিকশা তৈরির ক্ষেত্রে তিন হাজার টাকা করে মজুরি দেওয়া হয়। থাকা-খাওয়া কারখানা মালিক বহন করেন। চিলাবাড়িতেই রয়েছে মা মটরসের শোরুম। শো-রুমের সমানে সড়কের উল্টোপাশে রিকশার সিট ও সৌন্দর্য বর্ধনের হুড তৈরির জন্য ঢাকা থেকে কারিগর আনা হয়েছে।

মা মটরসের মালিক দুলাল মিয়া এক সময় রিকশার মেকার হিসেবে টাঙ্গাইল শহরে কাজ করতেন। বর্তমানে তিনি সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ব্যাটারি চালিত রিকশা ও অটোরিকশা তৈরির কারখানা দিয়েছেন। তিনি জানান, এই ব্যাটারি চালিত রিকশা ও অটোরিকশা তৈরির কোনো ধরনের বৈধ অনুমোদনপত্র তার নেই এবং কোন ধরনের কারিগরি জ্ঞানও নেই। তিনি দীর্ঘদিন রিকশা মেরামত অর্থাৎ মেকারের কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি এই রিকশা তৈরির কারখানা করেছেন।
শহরে বসবাসকারী অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন, অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান, জুয়েল রানা, সহকারী অধ্যাপক মো. শাহজাহান মিয়া, শিক্ষিকা সেলিনা হোসেন সহ অনেকেই জানান, শহরের বর্ধিত জনসংখ্যার প্রয়োজনে অতিরিক্ত ব্যাটারি চালিত রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল করছে। এর সাথে প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম্বার বিহীন ব্যাটারি চালিত রিকশা ও অটোরিকশা। ফলে ব্যস্ততম সময়ে শহর একপ্রকার অচল হয়ে পড়ে। শহরে চলাচলকারী রিকশা চালকদের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ না থাকায় যত্রতত্র পার্কিং ও উঠা-নামা করার কারণে যানজট আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এসব অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিকশা ও অটোরিকশা তৈরির কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার জোর দাবি জানান তারা।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ইউএনও) শাহীন মিয়া জানান, তিনি টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। ব্যাটারি চালিত রিকশা ও অটোরিকশা তৈরি আইনগতভাবে বৈধ নয়। এ ধরনের কোনো রিকশা তৈরির কারখানার সন্ধান পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টাঙ্গাইল পৌরসভার প্রশাসক (উপ-সচিব) মো. শিহাব রায়হান জানান, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন করে কোনো ব্যাটারি চালিত রিকশা বা অটোরিকশার লাইসেন্স ইস্যু করা হয়নি। টাঙ্গাইল পৌরসভা কর্তৃপক্ষ অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিকশা মুক্ত শহর গড়তে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছে। এছাড়া এই অবৈধ রিকশাগুলো আটক করে ডাম্পিং করা যায় কি-না সে বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। খুব দ্রুতই এসব অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিকশার বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
