আজ- ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বৃহস্পতিবার  রাত ১১:০৬

ভূঞাপুরে মতিন সরকার-দুলাল চকদার বেপরোয়া ॥ ফের অবৈধ বালু উত্তোলন ॥ হুমকিতে বঙ্গবন্ধুসেতু

 

বুলবুল মল্লিক:


দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে সিন্ডিকেট তৈরি করে যমুনা নদী থেকে আবারও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন শুরু হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী মতিন সরকার ও দুলাল চকদার জলদস্যুদের সহায়তায় ড্রেজায় দিয়ে বালু উত্তোলন করলেও স্থানীয় প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের বৃহত্তর স্থাপনা বঙ্গবন্ধুসেতু। এছাড়া বেশ কয়েকটি গ্রামের আবাদি জমি, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চরম ঝুঁঁকিতে রয়েছে। সাম্প্রতিক বন্যার ধকল থাকতেই অবৈধ বালু উত্তোলন এলাকাবাসীর কাছে বাড়তি আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, বালু মহালের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যমুনায় ইতোপূর্বে জোড়া খুন, এলাকাভিত্তিক নানা দ্বন্দ্ব, হামলা, মামলা ও সংঘর্ষের কারণে যমুনা নদীর ভূঞাপুর অংশে দীর্ঘদিন বালু উত্তোলন বন্ধ ছিল। এরআগে পুলিশের সঙ্গে তাদের কয়েকবার গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি কয়েকজন জলদস্যু মারাও গেছে। তারপরও থেমে নেই তাদের কার্যক্রম। যিনি জলদস্যুদের কব্জা করতে পারবেন, তিনিই হবেন বালু মহালের রাজা। অবৈধ বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে নদীতে ক্রমেই বেড়ে চলছে অপরাধ প্রবণতা। অভিযোগ রয়েছে, বালু মহাল থেকে উপার্জিত অর্থের একটি অংশ চলে যাচ্ছে প্রশাসন ও জলদস্যুদের হাতে। এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করার অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুসেতু পূর্বপাড় ভূঞাপুর উপজেলার পাথাইলকান্দি থেকে গোবিন্দাসী ইউনিয়নের জিগাতলা পর্যন্ত ১৯টি স্থানে ফের অবৈধ বালু উত্তোলন শুরু করা হয়েছে। ভূঞাপুরের বাগানবাড়ী, সিরাজকান্দি, ল্যাংড়ার বাজার, বাঘবাড়ি, পুনর্বাসন, মাটিকাটা, চিতুলিয়াপাড়া, পলশিয়া, সারপলশিয়া, গোবিন্দাসী ও নদী তীরবর্তী কয়েকটি ঘাটে বাংলা ড্রেজারসহ নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। কোটি কোটি টাকার বালু কেনাবেচায় প্রতিদিন কাজ করছেন হাজারো শ্রমিক। এ ছাড়া চলাচল করছে বালুবাহী শত শত ট্রাক। যমুনা নদী থেকে অসংখ্য ড্রেজার ও বলগেট দিয়ে উত্তোলিত বালু বিক্রির জন্য ঘাটে জমা করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিকরাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিন সরকার ও আওয়ামীলীগ নেতা স্থানীয় দুলাল চকদারের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট করে এসব বালুঘাট পরিচালনা করা হচ্ছে। ওই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় মাসুদ মেম্বার, নুহু মিয়া, করিম মেম্বার, আহাদ আলী, আমিনুল ইসলাম আমিন, সাদ্দাম হোসেন, হাশেম প্রামাণিক ও কালাম মেম্বার সহ ২৫-২৬জন প্রভাবশালী ব্যক্তি গত এক সপ্তাহ ধরে পুনরায় বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছেন। বর্তমানে ইউপি চেয়ার¤্যান মতিন সরকার ও আ’লীগ নেতা দুলাল চকদার বালু মহলের একচ্ছত্র অধিপতি। তাদের বালু সা¤্রাজ্যে কেউ মুখ খুললেই মামলা-হামলার শিকার হতে হয়। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ(বিবিএ) বঙ্গবন্ধুসেতুর উত্তরাংশ থেকে গোবিন্দাসী পর্যন্ত সকল বাঁধ(ডাব) ইজারা বন্ধ করে ট্রাক চলাচলে গত বছর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এতে সাময়িকভাবে হলেও বালু উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ওইসব ডাব বা রাস্তা অবৈধভাবে ব্যবহার করে অবৈধভাবে উত্তোলন করা বালু ট্রাক দিয়ে দিনরাত সরবরাহ করছেন। যমুনায় বালু উত্তোলনের ফলে নদীপথ পরিবর্তিত হয়ে জাতীয় স্থাপনা বঙ্গবন্ধুসেতু হুমকির মুখে পড়েছে।
নতুন করে বালু উত্তোলন শুরু করায় এলাকাভিত্তিক পুরনো দ্বন্দ্ব আবার শুরু হয়েছে। যে কোন সময় বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসীর মতে, বালু মহাল নিয়ে প্রায়ই হামলা-মামলার ঘটনা ঘটছে। গত ৭ জুলাই অবৈধভাবে উত্তোলন করা বালু সরবরাহ করতে বিবিএ’র ডাব(ট্রাক চলাচলের রাস্তা) অবৈধভাবে ব্যবহার করা নিয়ে দ্বন্দের জের ধরে মাটিকাটা ঘাটে আ’লীগ নেতা দুলাল চকদারের নেতৃত্বে স্থানীয় মালেক তালুকদার ও আব্দুল্লাহ মেম্বারকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। এ বিষয়ে মামলাও হয়েছে। বঙ্গবন্ধুসেতু পূর্বপাড়ে দক্ষিণ পাশে সেতু সীমানার বাইরে কালিহাতী উপজেলার থানার ঘাট নামক স্থানে সুলতান মেম্বারের নেতৃত্বে স্থানীয় ভূমি মালিকরা তাদের ভূমি থেকে বালু উত্তোলন করছে। ইতোপূর্বে জেলা প্রশাসন নিষেধ করায় তারা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পেয়ে বালু উত্তোলন করছেন। কিন্তু ভূঞাপুর অংশের অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার(২৪ আগস্ট) টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে বালু উত্তোলন বন্ধে গোহালিয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান হযরত আলী তালুকদারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে স্থানীয় পর্যায়ে বালু ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। বালু মহালের প্রভাবশালী লোকজনের আশ্রয়ে নদীতে জলদস্যুদের আনাগোনা অনেক বেড়ে গেছে। যা আগের চেয়ে কয়েকগুন বেশি। পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ওই জলদস্যুরাই নদী পথে আসা গরু-ছাগলসহ মালামাল লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে নদীপথে ব্যবসায়ীসহ নিরীহ লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বালু ব্যবসার সাথে জড়িত ভূঞাপুরের চরাঞ্চলের কয়েক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করে জানান, নিকরাইল ইউপি চেয়ারম্যান মতিন সরকার ও আওয়ামীলীগ নেতা মতিন সরকার উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আপোষরফার মাধ্যমে নতুন সিন্ডিকেট করে যমুনার ভূঞাপুর অংশে বালু উত্তোলন শুরু করেছেন। তারা জানান, বলা হয় সিরাজগঞ্জের বৈধ ঘাট থেকে বালু কিনে এনে ভূঞাপুরে স্তুপ করে রেখে পরে বিক্রি করা হয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, সিরাজগঞ্জ থেকে অল্প পরিমাণ বালু কিনে আনা হয়। কিন্তু অধিকাংশ বালু যমুনার ভূঞাপুরের ১৯টি ঘাট থেকে উত্তোলন করা হয়।
স্থানীয়রা জানায়, নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ হওয়ায় তাঁরা পারিপার্শ্বিক কারণেই অসহায়ভাবে জীবন যাপন করে আসছেন। নদীতে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে প্রতিবছরই তাদের আবাদি জমি, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙনের শিকার হয়। ভূঞাপুরের বালু ব্যবসায়ীরা সিরাজগঞ্জ থেকে বালু কিনে এনে বিক্রি করার কথা বলে প্রশাসনকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। মূলত: সিরাজগঞ্জের বালু সিরাজগঞ্জ থেকেই বিক্রি হবে এটাই স্বাভাবিক। ভূঞাপুরের বালুই ভূঞাপুর থেকে বিক্রি করা হয়।
নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি বলেন, ভূঞাপুর উপজেলা ও জেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ এবং জলদস্যুদের সঙ্গে আঁতাত করে অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভূঞাপুর অংশের প্রভাবশালীরা নতুন করে বালু ব্যবসা শুরু করেছেন। বালু উত্তোলনের কারণে এলাকায় প্রতিবারই ভাঙন দেখা দেয়। বালু বিক্রেতারা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।
ভূঞাপুর উপজেলার নিকরাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বালু সিন্ডিকেটের নেতা মতিন সরকার জানান, আমরা সিরাগঞ্জরে বৈধ বালু মহল থেকে বালু ক্রয় করে এনে ভূঞাপুরের বিভিন্ন ঘাটে বিক্রির জন্য স্তুপ করে রাখি। আমার নেতৃত্বে বাগানবাড়ি ঘাট পরিচালিত হয়। নদীতে পানি কমে গেলে ট্রাক সরাসরি ঘাটে যেতে সমস্যা হয় এজন্য পানি থাকতেই ক্রয়করা বালু বিক্রি করছি।
কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান হযরত আলী তালুকদার জানান, যথাযথভাবে আইন মেনে তিনি নিজের জায়গায় বালু উত্তোলন করে বিক্রির জন্য জমা করেন। সরকারি জায়গায় থেকে তিনি বালু উত্তোলন ও পরিবহনও করেন না। একটি মহল তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে।
বালু উত্তোলনের বিষয়ে ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশরাফ হোসেন বলেন, আমি জানি যমুনা নদীর ভূঞাপুর অংশে বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। তারপরও গোপনে অবৈধভাবে যদি কেউ বালু উত্তোলন করে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃৃপক্ষের (বিবিএ) বঙ্গবন্ধুসেতু পূর্ব সাইট অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. শাহীন হোসেন জানান, সেতুর দক্ষিণে প্রতিরক্ষা বাঁধের অংশে ধস দেখা দিয়েছে। ওই ধস সেতু সীমানার বাইরে বলে দাবি করেন তিনি। সেতুর উত্তরে পাথালিয়া থেকে গোবিন্দাসী পর্যন্ত সেতু কর্তৃপক্ষের বাঁধ(ডাব) অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের জন্য বন্দোবস্ত দেওয়া বন্ধ রয়েছে।
বিবিএ বঙ্গবন্ধুসেতু পূর্বপাড় সাইট অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী প্রকৌশলী মো. ওয়াসিম আলী জানান, যমুনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে তাদের কেউ জড়িত নন। তবে বালু উত্তোলন বন্ধের জন্য উত্তোলনকারীদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক খান মো. নূরুল আমীন জানান, বালু উত্তোলনের সঙ্গে অনেক রুই, কাতলা, রাঘববোয়াল জড়িত। তবে আমাদের জাতীয় সম্পদ বঙ্গবন্ধুসেতু রক্ষায় যা কিছু করা দরকার, তা-ই করব। টাঙ্গাইলে সরকারি সংস্থা কিংবা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ছাড়া কাউকে আর অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতে দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে কালিহাতীর গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হযরত আলী তালুকদারকে শোকজ করা হয়েছে। ভূঞাপুর অংশে পাশের জেলা সিরাজগঞ্জ থেকে বালু কিনে এনে স্তুপ করে রেখে তা বিক্রি করা হয় বলে তাকে জানানো হয়েছে। ভূঞাপুরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে এমন খবর তাঁর(ডিসি) কাছে নেই। তাছাড়া কেউ অভিযোগও করেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তিনি অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno