আজ- ১৭ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার  রাত ১:৪৭

সোয়া লাখ তাঁতি পরিবারে এবার ঈদের আনন্দ নেই!

 

বুলবুল মল্লিক:

টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতি এলাকার এক লাখ তিন হাজার ২০৬ জন তাঁত শ্রমিক ও চার হাজার ৩৯১ জন তাঁত মালিকের পরিবারে এবার ঈদুল আযহার আনন্দ নেই। করোনার প্রভাবে গত মার্চ মাস থেকে তাঁত ফ্যাক্টরি বন্ধ রয়েছে।

সাম্প্রতিক বন্যার কারণে তাঁত ফ্যাক্টরিগুলো আর খোলা সম্ভব না হওয়ায় তাঁতি এলাকায় অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব প্রকট আকার ধারণ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁত বোর্ডের স্থানীয় দু’টি বেসিক সেণ্টার ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানাগেছে।

জানাগেছে, টাঙ্গাইল জেলায় তাঁত শিল্প ও তাঁতিদের উন্নয়নের জন্য তাঁত বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন দুটি বেসিক সেন্টার রয়েছে।

এরমধ্যে কালিহাতী, ভূঞাপুর, ঘাটাইল, গোপালপুর, মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার জন্য কালিহাতীর বল্লায় একটি এবং সদর, দেলদুয়ার, নাগরপুর, বাসাইল, সখীপুর, মির্জাপুর উপজেলার জন্য টাঙ্গাইল শহরের বাজিতপুরে একটি বেসিক সেণ্টার রয়েছে।

তাঁত বোর্ডের কালিহাতী বেসিক সেণ্টারে ১৭টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির দুই হাজার ১২৪জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিকের ২১ হাজার ৯৭৩টি তাঁত রয়েছে। প্রতি তাঁতে তিনজন শ্রমিকের হিসেবে ৬৫ লাখ ৯১৯জন শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

টাঙ্গাইল সদর (বাজিতপুর) বেসিক সেন্টারে ৩২টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির দুই হাজার ২৬৭ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁত মালিকের ১২ হাজার ৪২৯টি তাঁত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ৩৭ হাজার ২৮৭জন শ্রমিক কাজ করেন।

মোট ৩৪ হাজার ৪০২ তাঁতের এক লাখ তিন হাজার ২০৬ জন তাঁত শ্রমিক ও চার হাজার ৩৯১ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁত মালিকের পরিবার করোনা ও বন্যার প্রভাবে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।

সরেজমিনে কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, মমিননগর, কোকডহড়া, দত্তগ্রাম, বেহেলা বাড়ী, ঘোণাবাড়ী, ছাতিহাটি, তেজপুর, কাজীবাড়ী; দেলদুয়ার উপজেলার চন্ডি,

পাথরাইল, পুটিয়াজানী, রূপসী, সদর উপজেলার চরকাকুয়া, চরপৌলী, হুগড়া ইত্যাদি তাঁত শিল্প অধ্যুষিত এলাকা বন্যার পানিতে থৈ থৈ করছে।

বেশিরভাগ তাঁত ফ্যাক্টরিতে পানি ঢুকেছে। তাঁতের তানা(কাপড় বুননের ভিম) উঁচুতে তুলে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাড়ি-ঘরে পানি থাকায় তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা কোন রকমে একবেলা-আধপেটা খেয়ে জীবন ধারণ করছে।

তাঁত শ্রমিকরা জানায়, করোনা ভাইরাসের কারণে গত মার্চ মাস থেকে ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখা হয়। এরমধ্যে সাম্প্রতিক বন্যা তাঁত শিল্পে মারাত্মক ধস নেমে এসেছে। অধিকাংশ তাঁত শ্রমিকের ঘরে পর্যাপ্ত খাবার নেই।

এখন তারা কৃচ্ছতা সাধন করে কোন রকমে খেয়ে- না খেয়ে বেঁচে আছেন। কষ্টের এ সময়ে তারা ঈদ নিয়ে ভাবছেন না, পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাটাই এখন তাদের কাছে চ্যালেঞ্জ।

শ্রমিকরা আরো জানায়, প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের লোকদেরকেই সরকারি ত্রাণ সাহায্য দিয়ে থাকেন। জনপ্রতিনিধিদের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকলে কেউ কেউ সুবিধা পেলেও অধিকাংশই পাচ্ছেন না।

তাঁতিরা সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা সরকারি সহায়তায় পক্ষপাতিত্বের শিকার হয়ে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে দাবি করেন।

কালিহাতী উপজেলার বল্লা ১নং প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক দুলাল হোসেন জানান, তার সমিতির সদস্য তিন হাজার ১০জন। করোনা ও বন্যার কারণে গত মার্চ মাস সকল তাঁত বন্ধ।

তাঁত ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় তাঁত মালিক ও শ্রমিক সবাই ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এ অবস্থা বেশিদিন চললে তাঁতিদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। করোনার কারণে তাঁত শ্রমিকদের যৎসামান্য খাদ্য সহায়তা দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

তাঁত শ্রমিকরা ত্রাণ সহায়তার জন্য হাহাকার করছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা চরম অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছে।

তাঁত বোর্ডের স্থানীয় বেসিক সেণ্টার সূত্রে জানা যায়, দুটি বেসিক সেণ্টার থেকে তাঁতিদের মাঝে বিতরণকৃত ৮ কোটি ৬৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকার ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত রাখা হয়েছে।

এছাড়া তাঁত বোর্ডের চলতি মূলধন সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় এক কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে ৬৪জন তাঁতিকে দেওয়া হয়েছে।

বল্লা ইউপি চেয়ারম্যান হাজী চান মাহমুদ পাকির জানান, করোনা ও বন্যার প্রভাবে সব তাঁত ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় হাজার হাজার তাঁত শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

তাদের অনেকের ঘরে খাবার নেই, উপজেলা থেকে কোটা অনুযায়ী সরকারি ত্রাণ সহায়তা ইউনিয়ন পরিষদে আসে। সেখান থেকেও তিনি কিছু তাঁত শ্রমিকের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছেন।

দেলদুয়ারের আটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল ইসলাম মল্লিক জানান, সরকারি বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

ইউনিয়নের ভাতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতিত কর্মহীন শ্রমিকদের মাঝে ত্রাণ পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁত শ্রমিকদের মাঝেও সরকারি ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে।

টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী পাথরাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক জানান, ক্ষুদ্র ও মাঝারী তাঁত শিল্পের মালিকরা সাধারণত ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন। বছরে দুটি ঈদ ও দুর্গাপুজায়ই তাঁত শাড়ির মূল ব্যবসা হয়ে থাকে।

করোনার সাথে ভয়াবহ বন্যা যোগ হয়ে তাঁতিদের পথে বসার অবস্থা হয়েছে। তাঁত মালিকদের সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিদেরকে ঋণ সুবিধা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

তাঁত বোর্ডের কালিহাতী বেসিক সেণ্টারের ভারপ্রাপ্ত লিয়াজোঁ অফিসার ইমরানুল হক জানান, করোনা ও বন্যার প্রভাবে তাঁত শিল্পে ধস নেমে এসেছে। কালিহাতী বেসিক সেণ্টারে পানি ঢুকে পড়ায় সকল কার্যক্রম স্থগিত করে ভবন পাহাড়া দিতে হচ্ছে। বিপুল সংখ্যক তাঁত শ্রমিকের ঘরে খাবার নেই।

তাঁত বোর্ড থেকে পাওয়া দুই হাজার ৩০০প্যাকেট খাদ্য সামগ্রী তিনি তাঁত শ্রমিকদের মাঝে বিতরণ করেছেন। ঈদুল আযহার আনন্দ তাদের মাঝে পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।

টাঙ্গাইল সদর (বাজিতপুর) বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, করোনা ও বন্যার প্রভাব টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের জন্য অশনিসঙ্কেত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাঁতিদের জন্য আলাদা ভাবে কোন সরকারি ত্রাণ সহায়তা আসেনি।

দেলদুয়ার ও সদর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁত শ্রমিকদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধিরা তাঁত শ্রমিকদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছেন।

সরকারি প্রণোদনা তথা ঋণ সুবিধা না পেলে তাঁতিরা এ সঙ্কট মোকাবেলা করতে পারবে না বলে তিনি মনে করেন।

টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মোশারফ হোসেন খান জানান, অস্বচ্ছল তাঁত শ্রমিকদের মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হবে।

গত জুন মাসে তাঁতিদেরকে স্বাস্থ বিধি মেনে তাঁত চালু রাখতে বলা হয়েছে। করোনার সাথে বন্যা যোগ হওয়ায় তাঁতিরা সহ সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno