আজ- ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার  রাত ৮:৫৬

৩৫ বছর ধরে অনিয়মেই চলছে ক্লিনিক :: সাতদিনে ৭৭টির অনুমোদন

 

আবুল খায়ের:

দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে অনিয়মেই চলছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের অনুমোদন। তবে সাত দিনে ৭৭টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদন দেওয়ার প্রেক্ষিতে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। আর এ ঘটনা মন্ত্রণালয়ের গঠিত একটি কমিটি তদন্ত করতে গিয়ে বের হয়ে এসেছে যে, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের।
১৯৮২ সালের অধ্যাদেশে বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও বিষয়টি উপেক্ষা করে ৩৫ বছর ধরে এসবের অনুমোদন দিয়ে আসছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল)। ৩৫ বছর ধরে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরের কেউ বিষয়টির খবর রাখেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা এর সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, ৩৫ বছর ধরে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদন নিয়ে অনিয়ম হয়ে আসছে এ বিষয়টি কেউ জানে না এটা সঠিক না। তবে প্রতি মাসে অনিয়মের ভাগাভাগির টাকা সবাই পেত। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন ৭ দিনের জন্য কানাডায় যান। এ সময় মহাপরিচালকের অনুমতিক্রমে ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব পান সহকারী পরিচালক ডা. মঞ্জুরুল হক। তিনি ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (হাসপাতাল) এর দায়িত্ব গ্রহণের পর ৭ দিনে ৭৭টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদন দেন। অথচ কোন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদন দিতে হলে ৬টি শর্ত পূরণ করতে হয়।
শর্তগুলো হচ্ছে, ট্রেড লাইসেন্স হালনাগাদ, আয়কর সার্টিফিকেট হালনাগাদ, পরিবেশ ছাড়পত্র, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কিভাবে হবে তার সার্টিফিকেট। স্বাস্থ্য সেবার উপযোগী পরিবেশ বিরাজ করছে কিনা তা নিশ্চিত হতেই এই ৬ শর্ত। এই শর্ত পূরণের পর প্রথমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্ধারিত ছকে আবেদন করতে হয়। আবেদিত প্রতিষ্ঠানে অধিদপ্তরের নির্ধারিত কমিটি সরেজমিন পরিদর্শনের গিয়ে উপযুক্ত পরিবেশ কিনা, যন্ত্রপাতি কিংবা অভিজ্ঞ জনবল আছে কিনা সব দেখে লাইসেন্স প্রদানের সুপারিশ করবেন। এই সুপারিশ কয়েক টেবিল অনুমোদনের জন্য ফাইল যাবে। সর্বশেষ মহাপরিচালক লাইসেন্স প্রদানের অনুমোদন দেবেন। এ বিষয়টি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। ৭ দিনে ৭৭টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোন ধরনের নিয়মনীতি মানা হয়নি। মোটা অঙ্কের উেকাচ বাণিজ্যে অনুমোদন দেওয়া হয় এবং তদন্ত কমিটি অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। এদিকে যেসব প্রতিষ্ঠানকে এভাবে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই অযোগ্য ও লাইসেন্স প্রাপ্তির শর্ত পূরণে ব্যর্থ। ওই সময় বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে হৈ চৈ পড়ে যায়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের বিষয়টি নজরে আসলে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। আর তখন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অধ্যাদেশে কী আছে সেটি যাচাই করে দেখেন। অধ্যাদেশে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, আইন অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের অনুমোদন দিবেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। শুধু নবায়ন করার ক্ষমতা আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (হাসপাতাল) আছে। সাথে সাথে ডা. মঞ্জুরুল হকসহ ঘটনায় জড়িত ৫ জনকে বদলি করা হয়। বিষয়টি তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই ৭৭টির প্রতিটি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার ঘুষ নেওয়া হয়। এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। ডা. মঞ্জুরুল হক ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের সিল বানিয়ে এসব অনুমোদন দেন। সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, এমনিতেই মোটা অঙ্কের ঘুষ ছাড়া ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স মেলে না। কোন কোন কর্মকর্তা জানান, এটাই নাকি অলিখিত রেওয়াজ। সব আমলেই এটা হয়ে আসছে। এছাড়া ১০ লাখ টাকা ঘুষ বা সার্ভিস চার্জ না দিলে লাইসেন্স ইস্যু হয় না।
অনুমোদিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়মিত তদারকি করার জন্য নির্ধারিত কমিটি রয়েছে। রাজধানীর উপ-পরিচালক বা সহকারী পরিচালকের নেতৃত্বে দুটি কমিটি। বিভাগীয় পর্যায়ের জন্য বিভাগীয় পরিচালকের নেতৃত্বে একটি কমিটি আছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের জন্য সিভিল সার্জন এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে কমিটি। এসব কমিটি নিয়মিত মনিটরের কথা থাকলেও কাগজপত্রে ঠিক আছে, বছরে দু’এক গেছে কিনা তাও কারো চোখে পড়ে না। এমন তথ্যও জানিয়েছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। তবে এসব কমিটিকে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা নির্ধারিত হারে মাসোয়ারা দিয়ে থাকেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরে হাসপাতাল শাখার পরিচালকসহ অন্যন্য পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একবার পোস্টিং পেলেই যথেষ্ট। কয়েক মাস লাগে কোটিপতি হতে। কারণ এ শাখায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গজিয়ে ওঠা নামসর্বস্ব হাসপাতাল ক্লিনিক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা মাসোয়ারাও পান। এমন অভিযোগ আছে। তাছাড়া চিকিত্সা বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লোক দেখানো তদন্তের নামে মোটা অঙ্কের ঘুষ আদায় করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রাজধানীসহ সারাদেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে ২৩ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক আছে। ব্লাড ব্যাংক আছে ১৮০টি। বাকিগুলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অধিদপ্তরের তালিকায় ২৩ হাজার হলেও অবৈধ আছে এর তিন গুণ। এসব চিকিত্সা প্রতিষ্ঠানে চিকিত্সা সেবার নামে হয় গলাকাটা বাণিজ্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, এসব প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ৯৫ ভাগ ভুল। পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দেয়। অপারেশন ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় অপারেশন টেবিলে রোগী মারা যায়। অভিজ্ঞ জনগণ ও যন্ত্রপাতির অভাবে এসব ঘটনা ঘটছে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশের সব হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। একটা ডাটাবেজের মধ্যে চলে আসবে। ঘরে বসে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তিনি বলেন, যারা ঘুষ গ্রহণ করেন তারা অনেক শক্তিশালী। এদের নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর।

সূত্র: ইত্তেফাক।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno