দৃষ্টি রিপোর্ট:
‘তিন পুরুষ ধরে খুঁজলেও আমাদের ভাষা খুঁজে পাবেন না। পূর্বপুরুষরা কী ভাষায় কথা বলত, আমরা জানি না। আমাদের যে আর্থিক অবস্থা তাতে খাবারের পেছনে ছুটব, না ভাষার পেছনে ছুটব? সমাজে আমাদের আলাদাভাবে দেখা হয়। ফলে নিজেদের পরিচয়ও লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। ভাষাও বিলুপ্ত, তাই আমরা এখন বাংলায় কথা বলি।’ কথাগুলো বলছিলেন শেরপুরের হুদি নৃগোষ্ঠীর তাপস বিশ্বাস। তিনি শেরপুরভিত্তিক একটি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক, যারা ওই অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করে। নিজের পূর্বপুরুষদের ভাষা হারিয়ে ফেলার আক্ষেপ, যন্ত্রণা ও হাহাকার ফুটে উঠেছে তাঁর কথায়।
দারিদ্র্যেও মরে যাচ্ছে ভাষাবাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে স্বল্প পরিচিত ২০টি নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গবেষণা করেছে ভাষা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস (এসআইএল) ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় দেখা গেছে, হুদি, বাগদি ও ভূঁইমালী, এই তিনটি নৃগোষ্ঠীর ভাষা দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই তিন নৃগোষ্ঠীর লোকেরা এখন বাংলায় কথা বলে। নিজেদের মাতৃভাষা সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। এ বিষয়ে লিখিত কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি। তবে হুদি নৃগোষ্ঠীর মানুষ কিছু কিছু শব্দ তাদের নিজেদের ভাষা বলে স্মরণ করতে পারে। ফলে ‘হুদি’ ভাষাকে একেবারে বিলুপ্ত না বলে ‘বিলুপ্তপ্রায়’ও বলা যেতে পারে। বাকি ১৪টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা কোনো না কোনোভাবে বিপন্ন বা ভবিষ্যতে হারিয়ে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে। মাত্র তিনটি নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে।
মূলত অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অনগ্রসর হওয়ায় এসব ভাষা গুরুত্ব পাচ্ছে না ওই নৃগোষ্ঠীর লোকদের কাছেই। জীবিকার তাগিদে তারা ঝুঁকছে বাংলা বা অন্য ভাষার দিকে। এসব নৃগোষ্ঠীর বেশির ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ভূমিহীন ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। এসআইএল বাংলাদেশ প্রথম দুই পর্বে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত স্বল্প পরিচিত ১৫টি জনগোষ্ঠীর ওপর গবেষণা করে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিরূপণ করে, যা নিয়ে গত বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কালের কণ্ঠে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
তৃতীয় ও সর্বশেষ ধাপে স্বল্প পরিচিত পাঁচ জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করা হয় ২০২৪ সালের মে থেকে আগস্টের মধ্যে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২০টি ভাষার ওপর গবেষণা করা হয়েছে। আমার ভাষা আমার পরিচয় (মাই ল্যাঙ্গুয়েজ মাই আইডেনটিটি) নামের গবেষণাটির তৃতীয় খণ্ড চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়।
ভূমিহীন বেশির ভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী : ক্ষতিগ্রস্ত ভাষা ও সংস্কৃতি-
এসআইএল বলছে, এই স্বল্প পরিচিত নৃগোষ্ঠীগুলো ঐতিহাসিকভাবে চাষাবাদ, শিকার, সংগ্রহ ও মাছ ধরার জন্য তাদের জমি, বন ও জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল। জমির সঙ্গে সম্পর্ক নিছক অর্থনৈতিক বিষয় নয়, বরং এর সঙ্গে গভীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মাত্রাও জড়িত। দুর্ভাগ্যবশত ভূমির অধিকারকে প্রায়ই এমন আইনি কাঠামোর মধ্যে ফেলা হয়, যা দীর্ঘদিনের জীবনযাপনের বাস্তব অভিজ্ঞতার চেয়ে আনুষ্ঠানিক দলিলপত্র বা প্রমাণকে প্রাধান্য দেয়। ফলে এই কাঠামোতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসা এসব ঐতিহ্যবাহী অনুশীলন, রীতিনীতি ও জমির অধিকারের স্বীকৃতি মিলছে না।
এর ফলে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জমি ‘খাস’ (রাষ্ট্রীয়) জমি হিসেবে ভুলভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে বা সংরক্ষিত বন ও ইকোপার্ক হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। ফলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীপন যাপন করছে। সমতলে অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ব্যক্তি কৃষক, বর্গাচাষি বা দিনমজুর; চা-বাগানে বসবাসকারীরা প্রধানত চা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই ভূমিহীন। সাক্ষরতার হারও উদ্বেগজনকভাবে কম। অনেকে এমন জমিতে বসবাস করে, যা একসময় তাদের ছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে সেসব হারিয়ে গেছে। এসআইএল বলছে, বাংলাদেশে এসব নৃগোষ্ঠীর দুর্দশা তাদের প্রথাগত ভূমি মালিকানা এবং ব্যবহার অধিকারের অস্বীকৃতির মধ্যে নিহিত। এই স্বীকৃতির অভাবই তাদের সুবিধাবঞ্চিত করছে।
মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের চা-বাগান এলাকায় বসবাসকারী গড়াইত নৃগোষ্ঠীর ৯৯ শতাংশের ক্ষেত্রে ভূমির মালিকানা বা বসবাস চা-বাগানের মালিকের জমিতে। ১ শতাংশের বসবাস সরকারি খাসজমিতে। অর্থাৎ বসবাসের ক্ষেত্রে ভূমির ওপর নিজেদের কোনো অধিকার নেই গড়াইত নৃগোষ্ঠীর। তারা কম্পানি ও সরকারের ওপর নির্ভরশীল। খেরুয়া নৃগোষ্ঠীর ৮৫ শতাংশ ভূমিহীন। অন্যদিকে মাত্র ২ শতাংশ নিজস্ব ভূমি আছে লোহার নৃগোষ্ঠীর। তাদের ৯৮ শতাংশ বসবাস করে কম্পানির জমিতে। কমবেশি একই চিত্র দেখা গেছে বাকি ১৭টি নৃগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও। মাত্র ৫ শতাংশ শবর নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভূমি রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রত্যেকের অর্থনৈতিক চিত্র প্রায় একই রকম। জীবন ও জীবিকার তাগিদে ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও নিজস্বতা- কোনো কিছু গুরুত্ব পায় না তদের কাছে। দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা তাদের মাতৃভাষাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর বেশির ভাগ পরিবারের দৈনিক আয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা । অর্থাৎ দিনে ১০০ টাকা করে হিসাব করলে মাসে তিন হাজার আর ২০০ টাকা করে হিসাব করলে মাসে ছয় হাজার টাকা উপার্জন করে পরিবারগুলো। এতেই বোঝা যায়, কতটা দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো।
শিক্ষার দৌড় প্রাথমিকে আটকা-
এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার চিত্রও করুণ। এদের বড় একটি অংশ প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তবে প্রাথমিকের গণ্ডি পার হলে লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে যায় ঝরে পড়ার হার।
গড়াইত নৃগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে। কিন্তু মাধ্যমিক (এসএসসি) পর্যায়ে এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ শতাংশে, আর উচ্চ মাধ্যমিকে ৪ শতাংশে। উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিতান্তই হাতে গোনা। মাত্র ১ শতাংশ গড়াইত জানিয়েছে যে তারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে পেরেছে। খেরুয়াদের ৭৫ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ করে। লোহারদের মধ্যে প্রাথমিকেই আটকে যায় ২৪ শতাংশ। কমবেশি একই চিত্র দেখা গেছে অন্য ১৯টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও। এই চিত্র থেকে বোঝা যায়, এসব নৃগোষ্ঠীর প্রাথমিকের পর আর শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই।
হারিয়ে যাচ্ছে সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের বিভিন্ন উপাদান-
ভাষার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের বিভিন্ন উপাদানও। খেরুয়াদের ৯৪ শতাংশ জানিয়েছে, তারা তাদের নিজস্ব বা ঐতিহ্যবাহী আসবাব সম্পর্কে জানে না। মাত্র ৬ শতাংশ এখনো এ ধরনের জিনিসপত্র ব্যবহার করছে। গড়াইত নৃগোষ্ঠীর বেশির ভাগ উত্তরদাতা (৮১ শতাংশ) জানিয়েছে, তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়সূচক বিশেষ কোনো পোশাক বা অলংকার নেই। তবে ছোট একটি অংশ (১৯ শতাংশ) তাদের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী পোশাক বা অলংকারের উপস্থিতি রয়েছে বলে জানিয়েছে।
ভূমি, উপার্জন ও অধিকারের সুরক্ষা না দিলে ভাষা বাঁচবে না-
রাষ্ট্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের ভূমির অধিকার, উপার্জন, ভাষা ও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত না করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলে মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক লেখক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘এটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষা শুধু বাংলা নয়। যাদের বলা হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বাংলার মতো তাদের মাতৃভাষার প্রতিও অঙ্গীকার দেখানো এবং তাদের মাতৃভাষা নিয়ে কাজ করা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।’
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি অনেক অন্যায় করেছি। তাদের ভূমির অধিকার যত দিন না আসবে এবং জমির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা না হবে তত দিন পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এই জনগোষ্ঠী গুলোর জন্য একটা ভালো উপার্জন ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। মাতৃভাষা চর্চার অধিকার দিতে হবে। সব কিছু মিলিয়ে সমাজের সঙ্গে তাদের একটা সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে, যাতে একটা মালিকানাবোধ তৈরি হয় যে এই বাংলাদেশ তাদেরও।’
স্বল্প পরিচিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণার তিন পর্বেই মাঠ পর্যায়ে যুক্ত ছিলেন এসআইএল বাংলাদেশের গবেষক স্বাক্ষর ব্লেইজ গমেজ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা গবেষণা করেছি। ফলে এতে নৃগোষ্ঠীগুলোর সামগ্রিক চিত্র ও জীবনযাপনের বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণায় আমরা যে চিত্র দেখেছি তা কিছু নৃগোষ্ঠী ও ভাষার জন্য উদ্বেগজনক। সরকারি বা বেসরকারিভাবে এখনই এই নৃগোষ্ঠীগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের পদক্ষেপ না নিলে তা চিরকালের জন্য হারিয়ে যেতে পারে।’