** তৈমুর আলম খন্দকার **
যুগে যুগে স্বৈরতন্ত্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে। সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছে রাজার নির্দেশে নিজ হাতে বিষ পানের মাধ্যমে। হিটলার হাজার হাজার মানুষ হত্যা করছে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে। বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন অনেক রাজা মহারাজা। কোন শাসন কর্তা কোন সময়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যার জন্য কি পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন তার স্মৃতিস্মারক লন্ডনস্থ বৃটিশ মিউজিয়ামে এখনো বিদ্যামান। বিস্তারিত লিখলে এই আটির্কেল লেখার মূল উদ্দেশ্য এখানে হারিয়ে যাবে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষকে মিথ্যা অপবাদে বিচারের নামে হত্যার বিরুদ্ধে যুগে যুগে গণমানুষ ফুঁসে উঠেছে বিধায় “মেঘনা কার্টা” সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সনদ সম্পদিত হয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত হয়েছে International Bill of Rights নামে পরিচিত; যার সনদ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১) Universal Declaration of Human Rights, 1948
১) Universal Declaration of Human Rights, 1948
২) International Covenant on Economic, Social & culture Rights 1966
৩) Optional Proposal to the International Covenant on Civil and political Rights’.
১৯৬৬ সহ আরো অনেক মানবাধিকার সনদ। অধিকন্তু ২০০৯ সালে বাংলাদেশে প্রণীত হয়েছে The National Human Rights Commission Act, 2009 (যদিও উক্ত কমিশন একটি নাম সর্বস্ব কমিশন, বাংলাদেশ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যার কোন ভূমিকা নাই)।
কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্যাতন, নিপীড়ন কি থেমে গেছে? বরং পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে। এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্যাতনের কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্যাতন, নিপীড়ন কি থেমে গেছে? বরং পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে। এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্যাতনের সবচেয়ে নিরাপদ অস্ত্র হচ্ছে “আইন ও আদালত”। লোকে বলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে এবং আদালত সম্পূর্ণ নিরপক্ষ। এই দুইটি কথাই জঘন্য মিথ্যা ও তন্ত্রকতামূলক।
গায়েবি মোকদ্দমার সংস্কৃতি চালু করে শেখ হাসিনা বিনা ভোটে তথাকথিত প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশকে এককভাবে শাসন করেছেন। এ গায়েবি মোকদ্দমা থেকে পঙ্গু, বিদেশে অবস্থানরত এমন কি মৃত ব্যক্তিও বাদ যায় নাই। আসামিকরার ক্ষেত্রে বাচ-বিচার ছিল না, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা ভিন্ন মতের হলেই হলো। প্রতিপক্ষ গায়েবি মোকদ্দমায় বাদী ছিল পুলিশ এবং গায়েবি মামলা জেনেও বিচার বিভাগে মর্মে কোনও প্রতিকারের উদ্যোগ নেয় নাই বরং রিমান্ডের আদেশ ও কারাগারে রাখার সমস্ত কাজেই বিচার বিভাগ দ্বারা হয়েছে। ফলে দেশবাসী শেখ হাসিনার পাশাপাশি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং বিচার বিভাগের উপরও ফুঁসে উঠে ছিল।
এজন্যই শেখ হাসিনার সাথে প্রধান বিচারপতিকেও মাইক্রোবাসে চড়ে পালানোর কথাও মিডিয়াতে প্রকাশ পেয়েছে এবং পুলিশের বড় বড় কর্মকর্তারাও একই কারণে এখন কারাগারে রয়েছে নতুবা রয়েছেন পলাতক। উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন যে, আগে গায়েবি মামলায় বাদী ছিল পুলিশ, এখন বাদী হচ্ছে ‘‘ব্যক্তি”।
অনুরুপ বক্তব্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা চট্টগ্রাম দিয়েছেন। আসিফ নজরুল আরো বলেছেন যে, যদি তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকেন তবে গায়েবি মামলার বাদীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিবেন। নবনিযুক্ত পুলিশ প্রধান পুলিশ বাহিনীকে ৫ই আগস্টের পরে দায়েরকৃত মামলার বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
কোনও কোনও ব্যক্তি গায়েবি মামলাকে চাঁদাবাজীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। মামলা হওয়ার পর এজাহারভূক্ত ব্যক্তিকে ফোন দিয়ে বলেছে যে, আপনার নামে মামলা হয়েছে মামলার মিউচুয়াল করে ফেলেন অর্থাৎ আপোষের প্রস্তাব। মান ইজ্জতের ভয়ে আপোষ করার কথা বললেই লাখ লাখ টাকার চাহিদা, যা ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যাণিজ্যকেও হার মানায়।
মামলা করলেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা কোনও প্রকার প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই মামলা রুজু করার জন্য সংশ্লিষ্ট থানাকে নিদের্শ দিচ্ছেন। রেলস্টেশন মাস্টারকে যদি বলেন ‘বাবু একখানা টিকেট, স্টেশন মাস্টার চেহারার দিকে না থাকিয়ে নির্ধারিত অর্থ পেলেই টিকেট দিয়ে দিবে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে আদেশ দেওয়ায় পূর্বে অবশ্যই যাচাই বাচাই করে আদেশ দিতে হবে। আদেশ দেয়ার পূর্বে মামলার আসামির সংখ্যা ও যথার্থতা নিয়েও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে তার প্রদত্ব প্রথম ভাষণে বলেছিলেন যে, ‘‘ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে যে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছিল তার অধিকাংশ প্রত্যাহার করেছি এবং আটক ছাত্র-জনতার মুক্তি লাভের ব্যবস্থা করেছি। পর্যায়ক্রমে মিথ্যা ও গায়েবি সব মামলার ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মানুষকে দুঃসহ ভোগান্তি থেকে মুক্ত করা হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গণঅভ্যুত্থানে সব শহিদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে’’।
সে মর্মে ২২ সেপ্টেম্বর ইস্যুকৃত এ প্রজ্ঞাপনে গায়েবি মামলা যাচাই বাচাই করায় তিনি জেলা এবং মন্ত্রণালয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করেছেন। গায়েবি মোকদ্দমা বর্তমানে মামলা বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। প্রথমে শুরু হয় মামলার নাম না দেয়ার জন্য চাঁদার নামান্তরে টাকার বান্ডিল। থানায় এজাহার হলে নাম কাটার জন্য চাওয়া হয় পুনরায় টাকার বান্ডিল। তবে অন্তবর্তীকালিন সরকার গায়েবি মামলার আসামিদের প্রতি সুবিচার করার জন্য একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন।
এখন অন্তবর্তীকালিন সরকার মামলা বাণিজ্য থেকে নির্দোষ ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য কি পদক্ষেপ নিবেন? না কি এ মামলা বাণিজ্য চলতেই থাকবে? তবে কি আবারো ভূক্তভোগী জনগণকে মাঠে নেমে নুর হোসেনের মত বলতে হবে ‘‘স্বৈরাচার নিপাতি যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’’। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত।
প্রবীন আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলেছিলেন “আমাদের দেশে হাওয়া বুঝে মামলার রায় হয়”। যদি এ ধারাই অব্যাহত থাকে তবে পুনরায় প্রধান বিচারপতিকে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে পালানোর পুনরাবৃত্তি অস্বাভাবিক হবে কি? এবং অন্তবর্তী সরকারের ললাটে কি স্বৈরাচারী তকমা লাগবে না- এ নিশ্চয়তা কোথায়?
লেখক: গায়েবী মামলা ও মামলা বাণিজ্যের ভুক্তভোগী রাজনীতিক।
সৌজন্যে- ভো.কা.