দেলওয়ার হোসাইন:
প্রায় এক বছর আগে আশরাফুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন অথচ গোয়েন্দা প্রতিবেদন না দেয়ায় এখনো তিনি চাকরিতে যোগ দিতে পারেননি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি সামাজিকভাবে ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। আদৌ তিনি এ পদে নিয়োগ পেয়েছেন কিনা তা নিয়েও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। অথচ চূড়ান্ত ফল প্রকাশের সময় বলা হয়েছিল সুপারিশকৃত প্রার্থীদের যথাযথ এজেন্সির মাধ্যমে প্রাক-নিয়োগ জীবনবৃত্তান্ত যাছাইয়ের পর তাদের চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হবে। এ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। ৪ বছর অতিবাহিত হলেও শেষ হয়নি এ পরীক্ষার সব কার্যক্রম।
শুধু আশরাফুল ইসলামই নয়, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কারণে অসংখ্য সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া পুরোপুরি ঝুলে আছে। পাশাপাশি পজেটিভ গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেয়ার লোভ দেখিয়ে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগের পাহাড় জমেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, এসব সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রার্থীদের প্রাক-নিয়োগ জীবন বৃত্তান্তের বিষয়ে এক মাসের মধ্যে খোঁজখবর নেয়া সম্ভব। কারণ, নন-ক্যাডারের বিভিন্ন পদে প্রার্থীর সংখ্যা অনেক কম থাকে। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থাগুলো সব প্রার্থীর গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরিতে বছর পার করে দিচ্ছে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে একই প্রার্থীর ব্যাপারে দু’গোয়েন্দা সংস্থার থেকে দুই ধরনের তথ্য আসছে। ফলে আরো জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে পুনঃতদন্ত করতে হয়। দীর্ঘ দিনেও তদন্ত কাজ শেষ না হওয়ায় বর্তমানে বিভিন্ন পদের অর্ধ শতাধিক পরীক্ষার নিয়োগ কার্যক্রম শেষ করা যাচ্ছে না। এতে প্রায় ২০ হাজার প্রার্থীর নিয়োগ ঝুলে আছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন) ড. রাখাল চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘চাকরি প্রার্থীরা নিয়োগের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। তাদের চাওয়াটা বুঝি। প্রার্থীদের পক্ষ থেকেও আমাদের ওপর চাপও আছে। এজন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তাগাদা দেয়া হয়। কিন্তু তারা আলাদা সংস্থা, এজন্য তাদের উপর চাপ দিতে পারি না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাকরিপ্রার্থীদের প্রতি সহনশীল। কারণ, আমরাও এ সময় পার করে এসেছি। সবাই চায় নতুন চাকরিতে যোগদান করে বেতন-ভাতা পাবে।
তদন্ত কার্যক্রম শেষ করার নির্দিষ্ট সময়সীমা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এজন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। তদন্ত কাজ শেষ হলে স্ব-স্ব মন্ত্রণালয়ে তা পাঠিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদের তদন্ত কবে শেষ হবে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সামছুল হক বলেন, এগুলো তাদের চলমান কাজ। এজন্য বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। এ কাজ দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তিনি বলেন, যেভাবে চান ঠিক সেভাবেই শেষ করা হয়। অামরা চেষ্টা করি সব কিছু দ্রুত করার জন্য। এসব কাজ পেন্ডিং রেখে তো কোনো লাভ নেই। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি চাকরি পরীক্ষার কথা উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, এটা আপটেড জানতে হবে। কবে তাদের কাছে পাঠিয়েছে ওটা দেখলে বোঝা যাবে।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘সময়’। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষিত মেধাবী তরুণ-তরুণীদের জীবনের একটা বড় অংশই চলে যায় সরকারি চাকরির পেছনে। এটা অনাকাক্ষিত। যে নিয়োগ পরীক্ষার সময়সীমা কোনোভাবেই এক বছরের বেশি লাগা উচিত নয়। ভারত, পাকিস্তান কোথাও এত সময় লাগে না। এর আগে ২০১৬ সালে সার্কভুক্ত দেশগুলোর পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্মকর্তাদের নিয়ে এক কর্মশালায় পিএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ সরকারি কর্ম কমিশনের অধীনে ক্যাডার ও নন ক্যাডারের বিভিন্ন পদে নিয়োগের দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৬ মে ৩৪তম বিসিএসের গেজেট প্রকাশের পর চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে গত ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট ৮৯৮ জনকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এরপর ২০১৬ সালের ১৪ আগস্ট ৪৫০ জনকে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। তদন্ত কার্যক্রম শেষ না হওয়ার ফলে তারা কেউ এখনো নিয়োগ পাননি। শুধু এই দুই পদের প্রার্থীরা নন একইভাবে আরো অনেক পদে তদন্ত কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় হাজার হাজার প্রার্থী চাকরিতে যোগদান করতে পারছেন না। বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) তদন্তের সময় প্রার্থীদের কাছে শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন ও চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্রের ফটোকপি নেন। আর সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) চাকরিপ্রার্থীর প্রাক জীবন বৃত্তান্ত, মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সার্টিফিকেট, প্রতিবন্ধী কোটার প্রার্থীদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী সনদ, ফৌজদারি, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো মামলায় গ্রেফতার অভিযুক্ত বা দন্ডিত এবং নজরবন্দি বা বহিষ্কৃত হয়েছেন কিনা। নিকট আত্মীয়স্বজনের কেউ সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত থাকলে তাদের জীবন বৃত্তান্ত ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজখবর নেন।
সূত্র: যাযাদি।