*মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল*
বাংলাদেশের পশু চামড়া শিল্প বহুদিন ধরেই সম্ভাবনাময় একটি খাত হিসেবে বিবেচিত। কোরবানির ঈদের সময় প্রায় ৫০ শতাংশ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয় এবং তা রপ্তানির জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এই চামড়া শিল্প দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি খাত হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এই খাত একধরনের অদৃশ্য এবং দৃশ্যমান সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে ধুঁকছে। ঈদের পর পরই দেখা যায়, চামড়ার দাম পড়ে যায়, স্থানীয় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অনেক সময় দেখা যায় রাস্তায় রাস্তায় চামড়া ফেলে দেওয়া হচ্ছে বা মাটিচাপা দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন ওঠে এই সিন্ডিকেট ভাঙবে কবে?
বাংলাদেশে চামড়া শিল্প প্রায় ২২০টি ট্যানারি, ৪০০টি ছোট মাঝারি কারখানা এবং প্রায় ১৫ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর উপর নির্ভরশীল। দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৩% আসে এই খাত থেকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি করে আয় হয়েছে প্রায় ১.১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে কাঁচা চামড়া নয়, ফুটওয়্যার ও গ্লাভস রপ্তানিই ছিল মুখ্য।
সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সম্ভাবনাময় এ শিল্প প্রায় ধ্বংসের কিনারে গিয়ে পৌঁছেছে। কোরবানির সময় অস্বাভাবিক দামে চামড়া কেনা, ট্যানারিদের দেরি করে মূল্য পরিশোধ এবং মজুদ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ। মূলত এই তিনভাবে সিন্ডিকেট কাজ করে। প্রতিবারই দেখা যায়, সরকার কাঁচা চামড়ার নির্ধারিত দাম ঘোষণা করে (এবার প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ঢাকায় ৬০-৬৫, ঢাকার বাইরে ৫৫-৬০টাকা)। কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ২৫০-৩৫০ টাকায় সম্পূর্ণ চামড়া কিনে নেয়। অনেকক্ষেত্রে দাম পড়ে ২০ টাকায়, এমনকি ১০ টাকায়ও বিক্রি করতে বাধ্য হন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
ট্যানারিগুলো সিন্ডিকেটের অংশ হয়ে ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা বছরের পর বছর বকেয়া রাখে। যেমন- ২০২১ সালে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের পাওনা ছিল ২০০ কোটি টাকারও বেশি, যার একটি বড় অংশ এখনও পরিশোধ করা হয়নি। এ ছাড়া সিন্ডিকেটের অংশবিশেষ চামড়া মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং চাহিদার সময় দাম বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার অজুহাতে প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের ন্যায্যমূল্য দেওয়া হয় না।
সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকায় ২০১৯ সালে প্রায় ১০ লক্ষ পশুর চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। এতে বিলুপ্ত হয়ে যায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার চামড়া। অনেক স্থানেই রাস্তার পাশে চামড়া ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনাকালীন সঙ্কটে বিদেশি চাহিদা কম থাকলেও সিন্ডিকেট দাম কমিয়ে ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। ওই সময় বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (BTA) স্বীকার করে তাদের মধ্যে মূল্য নির্ধারণ নিয়ে সমন্বয়হীনতা ছিল। ২০২৩ সালে সরকারের পক্ষ থেকে গরুর কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ঢাকায় ৫০-৫৫ টাকা প্রতি বর্গফুট। বাস্তবে অনেক জেলা শহরে ২০-২৫ টাকায়ও চামড়া বিক্রি করতে দেখা যায়।
এই সিন্ডিকেটের খেলোয়াড় মূলত বড় ট্যানারি মালিকরা(বিশেষ করে হেমায়েতপুরের ট্যানারি ক্লাস্টার), কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, স্থানীয় হোয়ারস ব্যবসায়ী ও ফড়িয়া এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে গড়ে ওঠা গোষ্ঠীবদ্ধতা। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (BTA) এবং বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (BHSMA) অনেক সময় এই সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
চামড়া সিন্ডিকেট নিয়ে যথেচ্ছ কথা-কথান্তর হয়েছে। বিগত সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের মধ্যে কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া, চামড়া মজুদ ও সংরক্ষণের জন্য জেলা পর্যায়ে গুদাম নির্মাণের পরিকল্পনা এবং হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তর করে পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা ইত্যাদির কথা বলা হলেও সিন্ডিকেট ভাঙেনি। ফলে খুচরা বিক্রেতা, ফড়িয়া ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিগত সরকারগুলো চামড়া সিন্ডিকেট ভাঙতে ছোটখাট উদ্যোগ নিলেও তা কথার কথাই রয়ে গেছে। কিন্তু চামড়া সিন্ডিকেট ভাঙা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। বিশেষ করে ঈদুল আযহার সময়কালে যখন কাঁচা চামড়ার বাজারে সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণআন্দোলনের পর সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ফলে পেঁয়াজ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সিন্ডিকেট কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও চামড়া খাতের দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট এখনো প্রায় অক্ষত।
সরকারি মনিটরিং কাজে দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাবে ইতোপূর্বে সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হয়নি। ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো নিরাপদ মূল্য নীতির নিশ্চয়তাও তৈরি হয়নি। ঈদের সময় কোরবানির পশুর চামড়া দান করা হয় মাদ্রাসা, এতিমখানা, মসজিদ ইত্যাদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। সিন্ডিকেটের কারণে যখন দাম পড়ে যায় বা চামড়া নষ্ট হয়, তখন এই প্রতিষ্ঠানগুলোও বিরাট আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। ২০২২ সালে চট্টগ্রামে ৭০টির বেশি এতিমখানা ও মাদ্রাসা ঈদের পর দাবি করে- তারা প্রায় দুই কোটি টাকার চামড়ার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে ১. সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করা। দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে সিন্ডিকেট বিরোধী তদন্ত জরুরি। ২. সরকারি নজরদারি বৃদ্ধি। জেলা প্রশাসন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ঈদের সময় তৎপর হতে হবে। ৩. মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জন্য সহায়ক ঋণ ও তহবিল গঠন। SME ব্যাংকের মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ ও মূলধন সরবরাহ নিশ্চিত করা যেতে পারে। ৪. চামড়া সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি ও হিমাগার স্থাপন করা। বিশেষ করে জেলা ও উপজেলায় সোল্টিং ইউনিট ও কোল্ড স্টোরেজ গড়ে তুলতে হবে। ৫. ট্যানারিদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ব্যবসায়ীদের পাওনা পরিশোধ বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ৬. চামড়া রপ্তানিতে স্বচ্ছ নীতিমালা তৈরি করতে হবে। রপ্তানি উৎসাহিত করতে কাঁচা চামড়ার পরিবর্তে চামড়া পণ্যকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। একই সঙ্গে চামড়া শিল্পে জগদ্দল পাথরের মতো ঘাপটি মেরে থাকা সিন্ডিকেট যেকোনো মূল্যে ভাঙতে হবে।
চামড়া খাতের এই সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। যেমন- ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের স্বার্থে গঠিত সিন্ডিকেট চিহ্নিত করা ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), গোয়েন্দা সংস্থা ও এনবিআর-এর যৌথ উদ্যোগে ট্যানারি মালিক, বড় পাইকার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের লেনদেন ও সম্পদের ওপর নজরদারি বাড়ানো। ঈদের মৌসুমে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সিন্ডিকেট দমনে উদ্যোগী হওয়া। সীমান্তবর্তী এলাকা ও ঢাকার বাইরের বাজারে নজরদারি বাড়িয়ে অবৈধ চামড়া পাচারকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিটি জেলায় কাঁচা চামড়ার ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করে তা প্রচার করা। দাম লঙ্ঘনকারী ক্রেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করা। পাড়া-মহল্লায় মসজিদভিত্তিক কোরবানির চামড়া সংগ্রহে সংগঠনের মাধ্যমে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। চামড়া কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদকে দায়িত্ব দিয়ে তাদের মাধ্যমে স্থানীয় ‘চামড়া বাজার কমিটি’ গঠন করা।
স্থানীয় পর্যায়ে স্বচ্ছভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য অস্থায়ী চামড়া সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও প্রয়োজনীয় লবণ সরবরাহ নিশ্চিত করা। যারা সরাসরি পশু কোরবানি দেন বা সংগঠিতভাবে চামড়া সংগ্রহ করেন, তাদের জন্য লবণ ও সংরক্ষণের প্রাথমিক খরচে ভর্তুকি বা প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। সংগৃহীত চামড়া দ্রুত সঠিক স্থানে বিক্রি করতে না পারলে সেটি নষ্ট হয়, ফলে সরকারি স্টোরেজ ও পরিবহনের ব্যবস্থা করা। ঈদের পরপরই বিজিএমইএ ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সঙ্গে সমন্বয় করে চামড়া রপ্তানির প্রস্তুতি নেওয়া। বায়ারদের সঙ্গে আগাম চুক্তি করে রপ্তানির গতি নিশ্চিত করা- যাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঁচা চামড়ার গদি ঘরের অজুহাতে দাম কমানো না যায়। হেমায়েতপুরের ট্যানারি শিল্প এলাকায় সরকারি হস্তক্ষেপ বাড়ানো ও স্বচ্ছ হিসাব ব্যবস্থার ওপর নজরদারি করা।
যেসব ট্যানারি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রপ্তানিযোগ্য চামড়া তৈরি করে না বা কাঁচা চামড়া অপচয় করে, তাদের লাইসেন্স বাতিলের ব্যবস্থা করা। কাঁচা চামড়ার সরবরাহ ও মূল্য সংক্রান্ত ডিজিটাল পোর্টাল চালু করা। যেখানে প্রতিদিন দাম হালনাগাদ হবে এবং সাধারণ মানুষ সেই তথ্য দেখে বিক্রি করতে পারবে। মোবাইল অ্যাপ চালুর মাধ্যমে সরাসরি বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি করা। চামড়া ফেলে দেওয়া বা বিক্রি করতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে নষ্ট করে ফেলার প্রবণতা রোধে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো। মিডিয়ায় সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান পরিচালনা করা, বিশেষ করে কোরবানির আগে-পরে। এছাড়া সংবিধানসম্মত অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। আমরা মনেকরি, এসব কাজ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করা হলে তথাকথিত অলংঘনীয় সিন্ডিকেট ভাঙা যাবে।
চামড়া খাতে সিন্ডিকেট ভাঙা মানে শুধু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীকে দমন করাই নয়; এটি হলো অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ খাতকে মুক্ত করা। কোরবানির চামড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ এতিমখানা, মাদ্রাসা, সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়। সেই অর্থের ওপর যারা অনৈতিকভাবে কব্জা করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ না করলে সরকার জনগণের আস্থা হারাতে বাধ্য। তারপরও বলতে হয়- চামড়া সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে সরকারকে শুধু প্রশাসনিক নির্দেশনা দিলেই হবে না; প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা, জনসম্পৃক্ততা ও প্রযুক্তিনির্ভর বাস্তবায়ন কৌশল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এটি একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র। যেখানে সফল হলে তারা জনগণের আস্থা আরও দৃঢ় করতে পারবে এবং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি কালো চক্রের অবসান ঘটাতে পারবে।
চামড়া শিল্প আমাদের দেশের সম্ভাবনাময় খাত হলেও একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কারণে এটি বারবার হুমকির মুখে পড়ে। সিন্ডিকেট ভাঙার প্রশ্নটি তাই কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি ন্যায়বিচার, সামাজিক সমতা ও নৈতিকতার প্রশ্ন। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতা, মিডিয়ার নজরদারি এবং জনসচেতনতা সব মিলিয়ে সম্মিলিত চাপ দরকার। বাংলাদেশ যদি চামড়া শিল্পকে সত্যিকার অর্থে বিশ্বমানের অবস্থানে নিতে চায়, তবে এ সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে- আর তা খুব শীঘ্রই।