দৃষ্টি নিউজ:
টাঙ্গাইলের লৌহজং নদীর দখল-দুষণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ বন্ধ থাকায় ধীরে ধীরে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। উন্নয়ন কাজ থেমে যাওয়ায় নদীটি পুনরায় ময়লার ভাগারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানাগেছে, এ বছরের ১১মে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক হিসেবে খান মো. নুরুল আমিন যোগদানের পর থেকে ‘লৌহজং নদী রক্ষা করি- পরিবেশ বান্ধব টাঙ্গাইল গড়ি’ স্লোগান ভুলে যেতে থাকে স্থানীয়রা। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, পুলিশ প্রশাসন, সিটিজেন জার্নালিস্ট গ্রুপসহ নানা শ্রেণি-পেশার লোকজন একাতœতায় শুরু হওয়া লৌহজং নদীর দখল-দুষণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজও থেমে যায়। জেলা প্রশাসন, সিটিজেন জার্নালিস্ট গ্রুপসহ কারোই লৌহজং নদীর দিকে এখন নজর নেই।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, লৌহজং নদীর জন্ম যমুনার টাঙ্গাইল অংশে, এর প্রবাহও টাঙ্গাইল জেলায়ই সীমাবদ্ধ। নদীটি পুর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সরাসরি দক্ষিণে বাঁক নিয়ে আঁকাবাঁকা পথে দেলদুয়ারের এলংজানি নদীতে গিয়ে বন্ধুত্ব করেছে। লৌহজং নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৬ কিমি, প্রস্থ ৪০ মিটার এবং নদী অববাহিকার আয়তন ১০৪ বর্গ কিমি। লৌহজং নদী এককালে খুব খর¯্রােতা ছিল। নদীতে কোন সেতু ছিলনা। পশ্চিম এলাকার লোকদের টাঙ্গাইলে যাতায়াত করতে খুব কষ্ট হত। নৌকা দিয়ে দু’পাড়ে যাতায়াত করতে গিয়ে অনেক সময় স্রোতের ঘূর্ণিপাকে পড়ে নৌকা ডুবে যেত। বর্তমান পার্ক বাজারের কাছে ছিল নৌবন্দর, আম গাছের তলায় একটি ঘাট ছিল বলেই আজকের আমঘাট রোড। দূরদূরান্ত থেকে স্টীমার, জাহাজ, লঞ্চ ও বড় বড় নৌকা বাণিজ্যে এ বন্দরে ভীড়তো। এখন বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় একসময় এ নদী দিয়েই চলতো ষ্টীমার, জাহাজ ও বড় বড় নৌকা। ছিল নৌবন্দর। নদীটি সংস্কার না করায় কালের পরিক্রমায় তার নাব্যতা হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়। বর্ষাকালের ২-৩ মাস এ নদীতে পানির দেখা মেলে। আর অবশিষ্ট সময় এ নদী শুকনো খা খা করে- আবর্জনায় থাকে ভরপুর। আর এর সুযোগ নিয়ে নদীর দু’পাশে ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মাটি ভরাট করে গড়ে ওঠে বাড়িঘর, দালানকোঠা। ফলে ক্রমেই এটি সরু খালে পরিণত হয়। স্থানীয় বয়োবৃদ্ধরা নদীটির যৌবনের কথা ভেবে চোখের কোণে অশ্রু ঝড়ায়, কেউ কেউ অম্ল-মধুর স্মৃতি রোমন্থন করেন। নদীটি কোনদিন দখল-দুষণমুক্ত হতে পারবে, এটা তারা কল্পনাও করেননি। কিন্তু ২০১৬ সালে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন নদীটি দখল-দুষণমুক্ত করে সৌন্দর্য বর্ধনে উদ্যোগী হন। জেলা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কয়েক মাস যাবত লৌহজং নদী দখলমুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে শহরে মাইকিং, নদীর ধারে মানববন্ধনসহ ফেসবুকে জনমত গঠনের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বাড়ে জনসম্পৃক্ততা। জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, পুলিশ প্রশাসন, সিটিজেন জার্নালিস্ট গ্রুপসহ নানা শ্রেণি-পেশার লোকজন একাতœ হন। তারই ধারাবাহিকতায় ‘লৌহজং নদী রক্ষা করি- পরিবেশ বান্ধব টাঙ্গাইল গড়ি’ স্লোগানে গত বছরের ২৯ নভেম্বর সকাল ১১টায় লৌহজং নদী দখল-দুষণ মুক্তকরণ সমন্বিত কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। সেচ্ছাসেবকরা নদীটি পুনরুদ্ধার অভিযানে স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশ নেয়- অংশ নেয় খোদ দখলকারীরাও। তারা স্ব-উদ্যোগে নিজস্ব^ স্থাপনা সরিয়ে নিয়ে দখলী জায়গা ছেড়ে দিতে প্রয়াস পান। জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি দু’পাড় বাধাই করে চলাচলের জন্য রাস্তা নির্মাণে প্রয়াসী হন। নেয়া হয়, পরিবেশ বান্ধব বিশদ পরিকল্পনা। লৌহজং নদীকে ঘিরে টাঙ্গাইলবাসী নয়া স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়ও অর্থ বরাদ্দে প্রকল্প গ্রহন করে। লৌহজং নদীর অবয়ব ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে বরিশাল জেলার বাসিন্দা হয়েও মো. মাহবুব হোসেন টাঙ্গাইলের আত্মজ হয়ে ওঠেন। কিন্তু পদোন্নতি জনিত কারণে তিনি বদলি হয়ে মন্ত্রণালয়ে চলে যান। বন্ধ হয়ে যায় লৌহজং নদীকে ঘিরে সকল কর্মপরিকল্পনা, স্বপ্নভঙ্গ হয় টাঙ্গাইলবাসীর।
ইতোমধ্যে লৌহজং নদীর দু’পাড় বাঁধাইয়ে মাটি খনন ও ভরাটের কাজ বন্ধ রয়েছে, কোন তদারকি নেই। নদীপাড়ের বসতিরা ব্যবহার্য ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলছে। পয়নিস্কাশনের পানিও ফেলা হচ্ছে লৌহজং এ। ফলে ধীরে ধীরে আবার ময়লার ভাগারে পরিণত হচ্ছে লৌহজং।
পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ পৃথিবীর নির্বাহী পরিচালক সহিদ মাহমুদ জানান, লৌহজং নদী পুনরুদ্ধার করতে আমরাই প্রথম জনমত গঠনের চেষ্টা করি। পরে জেলা প্রশাসনের সম্পৃক্ততায় সকলে একতাবদ্ধ হয়। ডিসি মাহবুব ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি। তাঁর প্রচেষ্টায় লৌহজং অবয়ব ফিরে পেতে শুরু করেছিল। আমরা ভেবেছিলাম সরকারি উদ্যোগেই সৌন্দর্য বর্ধনের কাজও হবে। কিন্তু ডিসি মাহবুব বদলি হওয়ার পর আবার নদীটি দখল-দুষণে ভাগারে পরিণত হচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায়না।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাজাহান সিরাজ জানান, লৌহজং নদী খননে একটি ডিজাইন করে প্রকল্প তৈরির কাজ চলছে। প্রকল্পটি উপর মহল থেকে অনুমোদিত হয়ে এলে কাজ শুরু করা হবে।
এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন জানান, এ জেলায় যোগদান করে গুছিয়ে ওঠতে একটু সময় লেগেছে। এরইমধ্যে লৌহজং নদীপাড়ের বাসিন্দারা ময়লা-আবর্জনা ফেলতে শুরু করেছে। লৌহজং নদীর কার্যক্রম চালু করার জন্য অচিরেই একটি সভা আহ্বান করা হচ্ছে। এছাড়া, পানি উন্নয়ন বোর্ড লৌহজং নদী ড্রেজিংয়ের কাজ করবে এবং এলজিআরডি মন্ত্রণালয় ৩৩০কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হলে দ্রুত সৌন্দর্য বর্ধনের কাজও শুরু করা হবে।