আজ- মঙ্গলবার | ১১ নভেম্বর, ২০২৫
২৬ কার্তিক, ১৪৩২ | রাত ১১:৪০
১১ নভেম্বর, ২০২৫
২৬ কার্তিক, ১৪৩২
১১ নভেম্বর, ২০২৫, ২৬ কার্তিক, ১৪৩২

ষড়রিপু দমনের শিক্ষা দেয় দুর্গোৎসব

মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল::

পূজা শব্দটি এসেছে পূজ ধাতু থেকে। এই পূজ ধাতুর অর্থ হচ্ছে ‘বর্ধনশীলতা’। উৎসব শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘উৎস অভিমুখে গমন বা যাত্রা’ অতএব পূজা বা উৎসব শব্দ দুটি প্রায় সমার্থক। এ জন্যই ধর্ম যার যার হলেও ‘উৎসব’ সবার। হিন্দু শাস্ত্রের এ পার্বণে সনাতন ধর্মবলবলম্বীদের সঙ্গে উৎসবে মেতে উঠে বাঙালি হৃদয়। জাত-পাত, হিন্দু-মুসলিম ‘উৎসবে’ একাকার হয়।

দুর্গা শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ দুর্গতি নাশিনী। দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসবের প্রকৃত তত্ত্বার্থে পূজা শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- যা করলে জীবনে উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হয়’। এ দুর্গার ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয় বা শত্রুনাশক হিসেবে চিহ্নিত। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয় বা শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে, ‘দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা’-অর্থাৎ দুর্গ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা। আবার শ্রীশ্রীচন্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষ দেবগণ শক্তি সমূহ মূর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি।

যুগে যুগে দুষ্টের বিনাশ ও সৃষ্টের পালন হেতু দেবী দুর্গা প্রকট হয়েছেন। শাস্ত্রে শ্রী শ্রী দুর্গা দেবীর অনেক নামের মধ্যে মহাশক্তি, ব্রহ্মময়ী, আদ্যাশক্তি, নারায়ণী, চন্ডী, মহিষ মর্দিনী, অশুর নাশিনী- এই সকল নাম বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। এই নামগুলোর প্রত্যেকটি অর্থের মাঝে একটি দর্শন, একটি তত্ত্ব নিহিত আছে। আবার এই দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসবের মধ্যে দুটি তত্ত্ব নিহিত আছে। একটি জাগতিক বা সাংসারিক এবং অন্যটি আধ্যাত্মিক। এ পূজার জাগতিক অর্থ হল বাস্তব জীবনের উন্নয়ন। দুর্গাপূজা করা মানে হচ্ছে দুর্গা হওয়া। দুর্গার দশটি হাতের অর্থ হল দশদিকের কর্মযোগ্যতা বা দক্ষতা। একজন নারী যখন সংসারের সকল কর্মে দক্ষতা লাভে ব্রতী হয় তখনই তার সংসার সুন্দর হয়। আর সুন্দর সংসার হতে হলেই লক্ষ্মী-সরস্বতীর মত কন্যা এবং গণেশ-কার্তিকের মত পুত্র হওয়া বাঞ্চনীয়। আর সুন্দর সন্তান জন্মাতে প্রয়োজন স্বামীর প্রতি অবিচ্ছেদ্য টান বা প্রেম।

বাঙালি সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাণের উৎসব দুর্গাপূজা। ‘বার মাসে তের পার্বণ’- এ প্রবাদের দেশে দুর্গাপূজা তাদের কাছে সবচেয়ে বড় পার্বণ। আয়োজনের আধিক্য আর সমারোহের ঐক্যে দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব। ষড়ঋতুর খেলাঘর বঙ্গপ্রকৃতির কোলে নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে; কাশফুলের স্নিগ্ধ কোমল পেলবতা নিয়ে; শিউলি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে দশভূজার আগমন ঘটে পৃথিবীতে। শঙ্খধ্বনি আর কাশের শব্দের সঙ্গে ঢাকের আওয়াজে ত্রিনয়নার মুখখানি পঞ্চপ্রদীপের আভায় লীলাময়ী হয়ে ওঠে।

সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গা পূজিত হয়ে আসছেন। পুরানে বর্ণিত আছে, দেব-দেবীরাও আদ্যাশক্তির পূজা করেছেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে আছে, দুর্গা পূজার প্রথম প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ, দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর তৃতীয়বার দুর্গাপূজার আয়োজন করেন মহাদেব। আবার দেবী ভাগবত পুরান অনুসারে জানা যায়, ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু ক্ষীরোধ সাগরের তীরে দুর্গার আরাধনা করে বর লাভে সফল হন।

হিন্দু শাস্ত্রানুসারে ‘দুর্গা’ নামের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘‘দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিত। উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত। রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ। ভয়শত্রুঘ্ন বচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।”

ধর্মমতে, নারীকে মাতৃরূপে পূজা করা তথা নারীকে সর্বদা পূজনীয় শক্তিরূপে ভূষিত করা সনাতন শাস্ত্রে স্পষ্ট। ‘সনাতন’ শব্দের মানে যার আদি ও অন্ত নেই, তেমনি জগতের আদি ধর্মশাস্ত্রও সনাতন শাস্ত্র। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ‘ওঁম’ শব্দে একে একাত্ম ত্রিমূর্তি। এই ত্রিমূর্তি বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা, জগতের প্রাণের সঞ্চারক, ‘আদ্যাশক্তি’ দেবীরূপিনী ত্রিমূর্তির সম্মিলিত প্রকৃতি রূপ।

দুর্গা, দুর্গতি নাশিনী। দুর্গা, দুঃখ হারিনী। দুর্গতি নাশ করে দুঃখ হরণ করে যে শক্তি মানব মনে ন্যায় ও সত্যের তেজোদীপ্ত রশ্মি জ্বালিয়ে দেয়- সেই দুর্গা। অসুর দমন-ই দুর্গাদেবীর কাজ। সুর শব্দের অর্থ দেবতা। যারা দৈবী গুণে গুণান্বিত তারা সুর। যারা দেবতা নন- তারা অসুর। দৈবী গুণের বিপরীত অপশক্তির অধিকারীরা অসুর হিসেবে খ্যাত। অসুর যখন মহিষের ওপর ভর করে কিংবা মহিষকে আশ্রয় করে সুর অর্থাৎ দেবতার সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে নিহত হয়েছেন সেই অসুর মহিষাসুর নামে খ্যাত। দেবী দুর্গা স্বীয় শক্তির বলে মহিষাসুরকে বধ করে অপশক্তিকে পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করেছেন। দেবী দুর্গার এ দর্শন সাধকজন আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। বিশেষ করে তান্ত্রিক সাধনায় বিশ্বাসীরা দুর্গাদেবীর আরাধনার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন নিজেকে জয় করার শক্তি। তাদের মতে দুর্গাদেবী হচ্ছেন সেই শক্তি, যে শক্তি মানবমনের যাবতীয় তমো ও রজো গুণের আধারজাত ইন্দ্রিয়শক্তিকে দমন করে সত্ত্বগুণের জাগরণ ঘটান। অর্থাৎ মানবমনের ষড়রিপুজাত অপশক্তি হচ্ছে মহিষাসুর। এর বিরুদ্ধে দেবীশক্তি অর্থাৎ সত্ত্বগুণ জাতশক্তিকে অবিরত সংগ্রাম করে তাকে পরাজিত করে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে হয়।

যদি সত্ত্বগুণ জাতশক্তি পরাজিত হয় তবে অপশক্তি বা অসুরশক্তির উত্থান ঘটবে। তখন হয়তো পৃথিবী হয়ে উঠবে অশান্ত। তাই অসুরশক্তির দমনে সত্ত্বগুণ জাতশক্তি বা দেবীশক্তির জাগরণের প্রয়োজন আবশ্যক। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার অগ্নিবীণা কাব্যের আগমনী কবিতায় বলেছেন-
“রণরঙ্গিনী জগৎমাতার দেখ মহারণ,
দশ দিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ।
পদতলে লুটে মহিষাসুর,
মহামাতা ঐ সিংহবাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে
শাশ্বত নহে দানব শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর।”

দেবীশক্তি নিজের পদতলে দানবশক্তি অর্থাৎ অসুরশক্তিকে দলে যায়, পিষে যায়। সাধকরা যখন নিজের সাধনার বলে ষড়রিপুকে দমন করতে সমর্থ হন তখন দেবীশক্তি বা সত্ত্বগুণ শক্তির বিজয় হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ কারণেই দুর্গাপূজা শুধু আনন্দের হিল্লোলে গা ভাসিয়ে দিন কাটানোর শিক্ষা দেয় না। দুর্বলতা, ভীরুতা কাটিয়ে অসুরশক্তিকে পরাজিত করার মত শক্তি অর্জন করার শিক্ষাই আমরা দেখতে পাই।

শেয়ার করুন স্যোশাল মিডিয়াতে

Facebook
Twitter
LinkedIn
X
Print
WhatsApp
Telegram
Skype

সর্বশেষ খবর

এই সম্পর্কিত আরও খবর পড়