দৃষ্টি নিউজ:
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের অর্থ যোগানদাতা ফজলু মল্লিক স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সহযোগিতা পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত মামলা ও দুদক প্রধান কার্যালয়ে দাখিলকৃত অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে তিনি বিএনপি নেতাদের বাগে আনার চেষ্টা করছেন। ফজলু মল্লিক ভূঞাপুর উপজেলার ছাব্বিশা এলাকার ফয়েজ মল্লিকের ছেলে এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী ও আওয়ামীলীগ নেতা।
জানাগেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন টাঙ্গাইলের সাবেক এমপি তানভীর হাসান ছোট মনির সহ ২৩৮ জন। রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ খানের দক্ষিণ মোল্লার টেকের কাজী মনিরের মেয়ে তাছলিমা কাজী গত ২২ সেপ্টেম্বর ওই অভিযোগটি দাখিল করেন। মামলায় অভিযুক্ত ২৩৮ জনের মধ্যে টাঙ্গাইলের সাবেক এমপি তানভীর হাসান ছোট মনির, পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর সাইফুজ্জামান সোহেল ও আমিনুর রহমান আমিন ওরফে ক্যাডার আমিন আত্মগোপণে রয়েছেন। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামীলীগের অর্থ যোগানদাতা ভূঞাপুরের ছাব্বিশা এলাকার ব্যবসায়ী নেতা ফজলু মল্লিক প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হওয়ায় গ্রেপ্তারের ভয়ে তিনি আড়ালে-আবডালে চলাফেরা করছেন।
অপরদিকে, ঠিকাদারী লাইসেন্সে নামকাওয়াস্তে কাজ দেখিয়ে শতকোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের তদন্ত চেয়ে তার বিরুদ্ধে গত ২৯ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করা হয়। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার তানভীর, মোমেন সরকার ও টাঙ্গাইল শহরের সোনিয়া আক্তার সহ পাঁচজন ওই লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। এ মামলা ও দুদকে দাখিলকৃত অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে ফজলু মল্লিক স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করছেন।
মামলার অভিযোগে প্রকাশ, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমন করার জন্য গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ মহল থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগসহ তাদের অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসীদেরকে সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর লেলিয়ে দেয়। তাদের হামলায় রাজধানী ঢাকার উত্তরা মডেল টাউনের জসিম উদ্দিন ফ্লাইওভারের আশপাশে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
ওইদিন উত্তাল ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে উত্তরার জসিম উদ্দিন ফ্লাইওভারের উপরে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে আরও অজ্ঞাত ৪০-৫০ জন লোক সমবেত হতে থাকে। তখন উত্তর দিক থেকে আসা কালো মাইক্রোবাস থেকে আওয়ামীলীগের সাবেক এমপি তানভীর হাসান ছোট মনির, টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুজ্জামান সোহেল, সাবেক কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম আমিন ওরফে ক্যাডার আমিন, জেলার ভূঞাপুরের ব্যবসায়ী ফজলু মল্লিক ও অস্ত্রধারী ক্যাডার বাবলু শেখ স্বশস্ত্র অবস্থায় নামেন। এরপর দক্ষিণ দিক থেকে একটি সাদা প্রইভেটকার নিয়ে সাবেক ডিবি প্রধান মো. হারুন অর রশিদ ফ্লাইওভারের ওপরে নামেন। সেথানে নেমেই তিনি পুলিশ সদস্যদের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলে গুলি করতে হুকুম দেন। তখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে থাকা সবাই মিছিলের ওপর গুলি চালায়।
মো. হারুন অর রশিদের পর পর ছোঁড়া দুইটি গুলি মিছিলে অংশ নেওয়া জসিমের পায়ে হাঁটুর একটু উপরে বিদ্ধ হয়। আহত জসিম উদ্দিনকে সতীর্থরা উত্তরা মহিলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসার পরও পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় পরদিন অর্থাৎ ৬ আগস্ট(মঙ্গলবার) দুপুর ৩টার দিকে জসিম উদ্দিনের মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনায় নিহত জসিম উদ্দিনের চাচাত বোন তাছলিমা কাজী বাদী হয়ে উল্লেখিত ব্যক্তিরা সহ ২৩৮ জনের নামোল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও অন্যান্য ব্যক্তিদের আসামি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৯৭৩ এর ৩(২)/৪(১)/৪ (২) ধারায় অপরাধ ও গণহত্যার অপরাধ সংঘটিত হওয়ায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মামলা দায়ের করেছেন।
দুদকে লিখিত অভিযোগে প্রকাশ, ফজলু মল্লিক ১/১১-এর সময় ডিস লাইনের বিল তোলার কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলে তিনি ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে যান। আওয়ামীলীগের স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে তিনি ব্যবসায়ীক নানা সুযোগ খুঁজতে থাকেন এবং পেয়েও যান। এক পর্যায়ে তার মামাতো ভাই উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম রফিককে উপজেলার অলোয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচন করান এবং নানা পলিসি করে নির্বাচিত করেন। মামাতো ভাইয়ের সূত্র ধরে স্থানীয় সংসদ সদস্য(সাবেক) তানভীর হাসান ছোট মনির ঘনিষ্ঠজনে পরিণত হন। এরপর তিনি কৌশলগত কারণে মামাতো ভাই রফিকুল ইসলাম রফিককে দিয়ে বালু মহল চালানো এবং নানা রকম ভুয়া প্রকল্প তৈরি ও কাজ পেয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে অর্থ আত্মসাতের প্রয়াস পান। ওই সময় তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির লাইসেন্সে কাজ নিয়ে নিজেই করেন। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসার পাশাপাশি অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক বনে যান।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামীলীগের শাসনামলে ফজলু মল্লিক রাষ্ট্রের উন্নয়ন কাজের নামে অন্যের ঠিকাদারী লাইসেন্স ব্যবহার করে কাজফাঁকি দিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত শতকোটি টাকার মধ্য থেকে ভূঞাপুর উপজেলা শহরে ৬তলা অত্যাধুনিক ভবন নির্মাণ করেন। ওই টাকায় ভূঞাপুরে গ্যারেজ তৈরি করে ৮০টি ভেকু মেশিন(খননযন্ত্র), ভূঞাপুরে ৯টি জমির প্লট, টাঙ্গাইলে ৪টি প্লট, ঢাকায় ২টি প্লট, টাঙ্গাইলের আদালত পাড়ায় একটি ফ্ল্যাট কিনেন। ঢাকার বনানীতে ২২ স্কয়ার ফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেন। ঘাটাইল উপজেলার লোকেরপাড়া ইউনিয়নের ঝোলাবাড়ি খালের কাছে অবস্থিত একটি ইটভাটা ক্রয় করেন।
ভূঞাপুর উপজেলার কাগমারী-শিয়ালকোল মৌজার শিয়ালকোল বট তলার দক্ষিণপূর্বের পাকা রাস্তা সংলগ্ন স্থানে তিনি ও তার স্ত্রী আফরোজা মল্লিকের নামে ১৪ শতাংশ ভূমি ক্রয় করেন। সেখানে ভেকু মেশিনের(খননযন্ত্র) গ্যারেজ তৈরি করেন। এছাড়া চট্টগ্রামেও তার একটি ভেকুর গ্যারেজ রয়েছে।
এসব গুরুতর অভিযোগ থেকে রেহাই পেতেই তিনি স্থানীয় বিএনপি নেতাদের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন। ইতোমধ্যে তৃতীয় সারির কয়েক নেতা তার দেওয়া অর্থ পেয়ে তাকে অভিযোগ থেকে রক্ষা করতে স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য সহ আগামি পর্বে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।