** নাফিসা নাজীন লুৎফা **
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে যদি জানতে পারেন, গ্রামের একজন বাসিন্দা অবৈধভাবে আপনার সম্পত্তি দখল করেছে- যে সম্পত্তি আপনি আপনার পারিবারিক সূত্রে পেয়েছেন, আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া কি হবে? স্বাভাবিকভাবে, একজন শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে, বেশিরভাগ মানুষ পরামর্শ দেবে, আইনের দ্বারস্থ হন, মামলা করুন, এবং সঠিক পথে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা চালান। আবার, ধরুন আপনি একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস- যেমন আপনার মোবাইল ফোন হারিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতেও, সাধারণ প্রতিক্রিয়া হলো থানায় জিডি করা এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া।
কিন্তু, এইসব সমস্যার মতোই যদি এমন এক নারীকে দেখেন, হয়তো আপনার পরিচিত, বা অপরিচিত, অথবা এমন একজন যার সঙ্গে কখনো আপনি একটানা দশ মিনিটও কাটাননি, এমন কিছু করছেন যা সমাজের বাঁধাধরা চিন্তা দারা গ্রহণযোগ্য নয় বা নৈতিকভাবে সঠিক নয় বলে মনে হয়- তখন কি করবেন?
এই প্রশ্নটি হয়তো প্রথমে খুবই সাদামাটা মনে হতে পারে। কেউ ভাবতে পারেন, “এটা তো প্রশ্নই না। এটা নিয়ে কথা বলারও প্রয়োজন নেই।” কিন্তু সত্য হলো, বাংলাদেশের নারীদের জন্য এটা একটা বড় ভয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি ভুল পদক্ষেপ, একটা অসাবধানতা, কিংবা সামাজিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামান্য হলেও বিচ্যুতি হলে, একজন নারীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। এই ভয়ানক সামাজিক চাপ নারীকে এক মুহূর্তের ভুলের জন্য সারাজীবন ধরে ভুগতে বাধ্য করে।
সাম্প্রতিককালে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটের দিকে চোখ দিলে দেখি- খুব সহজ সমাধান হল একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস। দু’একটা ছবি সহ, পাঁচশো-ছয়শো শব্দের স্ট্যাটাস, যেখানে নারীদের প্রতি কিছু অবমাননাকর, হাস্যকর মন্তব্য ছুড়ে দিলে যেন সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এটা যেন এক প্রকার সস্তা এবং সহজলভ্য উপায় ন্যায় বিচারের খোঁজার। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ব্যক্তি কাদের কাছে বিচার চাইছে? ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছে? তারা কি আসলে এ ধরনের জটিল পরিস্থিতি বুঝে সঠিক বিচার করতে পারে?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শুধুমাত্র এক পক্ষের কথা শোনা হয় এবং সেটাকে সত্য ধরে নেওয়া হয়। ফলাফল- নাম ধাম প্রকাশ করে এক জন নারীকে অসঙ্কোচে লজ্জিত করা। তক্ষণ ভয়ে-কষ্টে-লজ্জায় অভিযুক্ত নারীর কণ্ঠ যেন এক অদৃশ্য পর্দার আড়ালে চলে যায়। এমনকি, অপর একজন নারীও তার পক্ষে কথা বলতে সাহস পান না। চরিত্রহনন, তার পরিবারের পেছনের ইতিহাস টেনে আনা এসব বিষয় যেন ফেসবুকের ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। এই ধরনের সামাজিক প্রবণতার মাধ্যমে যে আমরা দিন দিন অসুস্থ ও বিষাক্ত হয়ে উঠছি, যা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছে অজানা।
সিমন দ্য বোভোয়ারের নারীদের প্রতি সমাজের আচরণ সম্পর্কে বিখ্যাত একটি পর্যবেক্ষণ তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ “দ্বিতীয় লিঙ্গ” (সেকেন্ড সেক্স) (১৯৪৯)-এ পাওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, “মানবতা পুরুষ, এবং পুরুষ নারীকে তার নিজস্ব সত্ত্বায় নয়, বরং পুরুষের সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করে।” এই উদ্ধৃতিটি যথেষ্ট প্রমাণ দেয় যে সমাজ কীভাবে নারীদের উপর সীমাবদ্ধতা এবং শাস্তি আরোপ করে, যদি তারা প্রচলিত ভূমিকার বাইরে গিয়ে কিছু করে। একজন নারীকে আলাদাভাবে আচরণ করা বা ভুল পথে হাঁটা সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে পুরুষ-শাসিত মানবতার জন্য আমাদের দেশে “ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে বিচার চাওয়া-একটি প্রিয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের দ্বারা বিচার দাবি করার নাম করে, যা তৈরি হয় তা হলো জনসম্মুখে লজ্জা।
মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার সময় আমরা প্রায়ই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দিকে আঙুল দেই। তবে আমাদের মানের মধ্যেই যে সূক্ষ্ম নেতিবাচক আভা বিদ্যমান, তা হয়তো আমরা নিজেরাই বুঝি না। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিচারালয়ের মতো আচরণ করা, বিশেষ করে নারীদের বিরুদ্ধে এভাবে ব্যবহার করা, দিন দিন ভয়ঙ্কর জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। আমাদের সমাজের জন্য এটা মোটেও ইতিবাচক কোনো লক্ষণ নয়। নিজের নিরাপত্তাহীনতা ঢাকার জন্য কেউ ফেসবুককে বিচার চাওয়ার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না।
আমাদের বুঝতে হবে যে, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া মানে ন্যায়বিচার পাওয়া নয়। একজনের অধিকার, কিংবা একজনের জীবনের গুরুত্ব শুধু কয়েকটি লাইক, শেয়ার আর মন্তব্যের ভিত্তিতে মাপা যায় না। বিচার ও ন্যায়ের জন্য সঠিক প্রক্রিয়া ও জায়গা রয়েছে। আমরা যদি সামাজিক মাধ্যমকে এই ধরণের বিচারের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করি, তবে আমাদের সমাজের নৈতিকতা আর বিবেচনার শক্তি খুব শীঘ্রই ধ্বংসের পথে চলে যাবে।
এ ধরনের বিষাক্ত সংস্কৃতি আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কেই তুলে ধরে। আমরা কি এভাবেই আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজ গড়ে তুলতে চাই? প্রথমে আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করতে হবে, এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি? আমরা কি সত্যিই কোনো ভুলকে অন্যায়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি? একজন পুরুষ যদি ভুল করে, সেটাকে আমরা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা ভুল হিসাবে গ্রহণ করি। কিন্তু একজন নারী যদি একটুও ভিন্ন পথে চলে, তাহলে তাকে পুরো সমাজের চোখে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কেন এই বৈষম্য?
আমাদের সমাজে নারীদের জন্য ভয় ও বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। আমরা যদি সত্যিই একটি শিক্ষিত ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠন করতে চাই, তাহলে আমাদের উচিত সবাইকে সমান চোখে দেখা, এবং শুধু নারীদের নয়, সকলের জন্য নৈতিকতার মানদণ্ড একই রাখা।
লেখক: নাফিসা নাজীন লুৎফা, প্রভাষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রোফেশনালস। তথ্যসূত্র-ভো.কা।