আজ- শুক্রবার | ২৩ মে, ২০২৫
৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ | বিকাল ৫:০৬
২৩ মে, ২০২৫
৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
২৩ মে, ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

স্কাউট আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব

মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল ::

স্কাউট আন্দোলন এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিশ্বব্যাপী শিশু-কিশোর ও তরুণদের চরিত্র গঠনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। স্কাউটিং আত্মনির্ভরতা, সমাজসেবা, নেতৃত্বগুণ ও জাতীয়তাবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রাথমিকভাবে পুরুষদের জন্য এটা শুরু হলেও সময়ের পরিবর্তনে নারীরাও এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছে। বর্তমান যুগে প্রযুক্তি ও তথ্যের সহজলভ্যতা স্কাউট কার্যক্রমকে আরও আধুনিক ও কার্যকর করেছে।

 

 

 

 

১৯০৭ সালে রবার্ট স্টিফেন্সন স্মিথ লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল অফ গিলওয়েল সংক্ষেপে বিপি- এর হাত ধরে স্কাউট আন্দোলনের সূচনা হয়। তিনি ইংল্যান্ডে প্রথম স্কাউট ক্যাম্প আয়োজন করেন এবং ১৯০৮ সালে ‘Scouting for Boys’ নামক বই প্রকাশ করেন- যা বিশ্বব্যাপী স্কাউট আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে। ১৯১৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে স্কাউট আন্দোলনের সূচনা ঘটে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ স্কাউটস নামে সংগঠনটি সরকারি স্বীকৃতি পায় এবং দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে।

 

 

 

 

 

১৯৭২ সালের ৮-৯ এপ্রিল সারাদেশের স্কাউট নেতৃবৃন্দ ঢাকায় এক সভায় মিলিত হয়ে বাংলাদেশ স্কাউট সমিতি গঠন করেন। ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ১১১ নং অধ্যাদেশ বলে (১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭২, সোমবার) স্কাউট সমিতি সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। এর আগে প্রবীণ স্কাউটার সলিমুল্লাহ ফাহমীর নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ২২মে ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল স্কাউট অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়েছিল। বিশ্ব স্কাউট সংস্থা (WOSM) ১৯৭৪ সালের ১ জুন বাংলাদেশ স্কাউট সমিতিকে ১০৫তম সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে ১৯৭৮ সালের ১৮ জুন পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল সভায় সমিতির নাম বদলে রাখা হয় বাংলাদেশ স্কাউটস। নারীদের সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে জাতীয় কাউন্সিল ১৯৯৪ সালের ২৪ মার্চ একাদশ সভায় বিশ্ব স্কাউট সংস্থার অনুমোদনক্রমে গার্ল-ইন-স্কাউটিং চালু করে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের স্কাউটাররা জাতীয় পর্যায় ছাড়াও বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরিতে অংশগ্রহণ করে বিশেষ কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছে- এটা আমাদের জন্য গর্বের।

 

 

 

 

 

 

 

 

স্কাউটদের পারদর্শিতার বিষয় বিবেচনা করে তাদেরকে বিভিন্ন প্রকার পারদর্শিতা ব্যাজ প্রদান করা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে একজন স্কাউট কতটুকু পারদর্শী তা বোঝা যায়। পারদর্শিতা ব্যাজ গুলোকে দশটি সাধারণ গ্রুপ এবং তিনটি বিশেষ গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। সাধারণ গ্রুপগুলো হচ্ছে- চেতনা, ব্যক্তিগত দক্ষতা, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, আনন্দ, গৃহ শিল্প, গাছের যত্ন, কারুশিল্প প্রাণির যত্ন, স্বাস্থ্য ও জনসেবা এবং প্রযুক্তি। বিশেষ গ্রুপের নাম হচ্ছে- নৌ কুশলী, বিমান কুশলী, ৩) রেলওয়ে কুশলী।

 

 

 

 

 

 

 

 

বাংলাদেশ বিভিন্ন বিশ্ব জাম্বুরিতে অংশগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের সাংগঠনিক দক্ষতা, নেতৃত্ব ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরেছে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় অনুষ্ঠিত ২৪তম বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরিতে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ জন স্কাউট প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। ওই আসরে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, খাবার ও হস্তশিল্প প্রদর্শন করা হয়- যা বহু দেশের স্কাউটদের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। ২০১৫ সালে জাপানের কিরারা-হামায় অনুষ্ঠিত ২৩তম বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরিতে বাংলাদেশের ৭০ জনের বেশি স্কাউট প্রতিনিধি অংশ নেয়।

 

 

 

 

২০২৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় আয়োজিত ২৫তম বিশ্ব জাম্বুরিতেও বাংলাদেশ অংশ নেয়। ওই আসরে আবহাওয়াগত কিছু সমস্যার কারণে কিছু কার্যক্রম ব্যাহত হলেও বাংলাদেশের স্কাউটাররা বেশ কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। এসব কৃতিত্বগুলো শুধু স্কাউটদের ব্যক্তিগত বিকাশ নয় বরং আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করেছে। বাংলাদেশের কয়েকজন কৃতি স্কাউটার দেশে-বিদেশে স্কাউটিংকে একটা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁদেরকে স্মরণ না করলে এ লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে- আমিও একজন ক্ষুদ্র স্কাউটার হিসেবে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে।

 

 

 

 

 

 

 

তাঁরা হচ্ছেন- বাংলাদেশের স্কাউটিংয়ের অন্যতম পথপ্রদর্শক ডক্টর মোহাম্মদ আবদুল মুইদ খান। তাঁর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক স্কাউট সংগঠনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে। বাংলাদেশ স্কাউটস-এর সাবেক জাতীয় কমিশনার মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ মঈন খান। তিনি স্কাউটিং কার্যক্রমকে জাতীয় পর্যায়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়া মোহাম্মদ মোরশেদুল আলম, কবীর বিন আনোয়ার, মো. সাঈদ বাসিত, শাহ কামাল, মো. মোজাম্মেল হক খান, মোহাম্মদ হাবিবুল আলম, শেখ সাহেব আলী, মো. শাহরিয়ার ঝলক, এসএম মোসাদ্দিক বিল্লাহ আরাফাত, নাজমুল হাসান, মো. জাকির হোসেন রিয়াজ সহ অনেকে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গাছ লাগানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, সামাজিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পথশিশুদের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম, আন্তর্জাতিক পরিম-লে ‘গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ভিলেজ’ প্রদর্শন করে সচেতনতা মূলক কার্যক্রম পরিচালনার দৃষ্টান্ত স্থাপন, দেশীয় সংস্কৃতি ইত্যাদি কার্যক্রম তুলে ধরে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রথমদিকে স্কাউটিং শুধুমাত্র ছেলেদের জন্য ছিল। কিন্তু ১৯১০ সালে ‘গার্ল গাইড’ নামে মেয়েদের জন্য একটি আলাদা সংগঠন তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে নারী স্কাউটদের সংক্ষিপ্তভাবে ‘গার্ল ইন স্কাউট’ বলা হয় এবং তাদের জন্য আলাদা কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

নারীদের অংশগ্রহণ শুরুতে সীমিত হলেও বর্তমানে এ সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘গার্ল ইন স্কাউট’ ইউনিট গঠন করে মেয়েদের নেতৃত্ব, সমাজসেবা এবং ক্যাম্পিং-এর মাধ্যমে বাস্তবজীবনের দক্ষতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। রাজশাহীর একটি সরকারি কলেজে আয়োজিত স্কাউট ক্যাম্পে ২০২৩ সালে ৩০০ জন নারী স্কাউট অংশগ্রহণ করে। যেখানে তারা আগুন জ্বালানো, প্রাথমিক চিকিৎসা, দুর্যোগ মোকাবেলা ও কমিউনিটি সেবামূলক কার্যক্রমে অংশ নেয়। এছাড়া ঢাকা শহরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ে বর্তমানে লক্ষাধিক ছাত্রী স্কাউট কার্যক্রমে যুক্ত।

 

 

 

 

 

 

 

 

নানা কারনণে স্কাউটিংয়ে নারীদের অংশগ্রহণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। স্কাউট প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে এবং নেতৃত্বদানে পারদর্শী হয়। নারী স্কাউটরা সমাজের বিভিন্ন সেবামূলক কাজে যুক্ত হয়ে স্থানীয় সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখে। নারী ও পুরুষ উভয়েই স্কাউট কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্য হ্রাস পায়। স্কাউটিংয়ের মাধ্যমে নারী শিক্ষার্থী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়।

 

 

 

 

 

 

স্কাউটিংয়ের প্রচলিত কাঠামোতে সময়ের প্রয়োজনে আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন করে তা আরও গতিশীল ও সময়োপযোগী করা হয়েছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ স্কাউটস ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভার্চুয়াল প্রশিক্ষণ ও সেশন আয়োজন করে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ স্কাউটসের নিজস্ব ওয়েবসাইট ও অ্যাপে সদস্য নিবন্ধন, কার্যক্রম হালনাগাদ, ব্যাজ অর্জন ইত্যাদি পরিচালনা করা হয়। স্কাউটদের বিভিন্ন দক্ষতা অনুযায়ী ডিজিটাল ব্যাজ প্রদান করে তাদের অনলাইন প্রোফাইলে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। স্কাউটরা বিভিন্ন সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন; যেমন- পরিবেশ রক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি, দুর্যোগ প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।

 

 

 

 

 

 

 

বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। স্কাউটিংয়ের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নে তথ্যের ব্যবহার অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রেও স্কাউট কার্যক্রমেও প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। যেমন- ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ: স্কাউটদের কার্যক্রমের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে কার্যক্রমের উন্নয়ন করা হচ্ছে। ভূমিকা ভিত্তিক কার্যক্রম: বিভিন্ন এলাকার চাহিদা অনুযায়ী নারী স্কাউটদের কাজে লাগিয়ে স্থানীয় সমস্যার কার্যকর সমাধান দেওয়া হচ্ছে। ই-লার্নিং কনটেন্ট: নারীদের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইনকৃত প্রশিক্ষণ মডিউল এখন অনলাইনে সহজলভ্য করা হয়েছে।

 

 

 

 

 

দিন দিন যদিও নারী স্কাউটদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তারপরও নারীদের এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেমন- অনেক পরিবার এখনও মেয়ে সন্তানদের ক্যাম্পে পাঠাতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেনা। বিশেষ করে জেলা-উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলে। নারী স্কাউটদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরা এখনও স্কাউটিং কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তবে এসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে নারী স্কাউটরা ইতোমধ্যেই নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- খুলনার একটি গ্রামের গার্ল ইন স্কাউট ইউনিট স্থানীয় নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় বড় ভূমিকা রেখেছে- যেখানে তারা নিয়মিত স্যানিটেশন, মাসিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে কর্মশালা পরিচালনা করছে।

 

 

 

 

স্কাউট আন্দোলন কেবল একটি সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম নয়, এটি একটি জীবনদর্শন- যা ব্যক্তিকে নৈতিক, আত্মনির্ভর ও সমাজ সচেতন করে গড়ে তোলে। নারীদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনের গতি ও কার্যকারিতা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও তথ্যভিত্তিক কার্যক্রম স্কাউটিংকে সময়োপযোগী করে তুলেছে। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার উচিত নারী স্কাউটদের জন্য আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করা, প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সামাজিক সচেতনতামূলক প্রচার চালানো। নারীর ক্ষমতায়ন ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে স্কাউটিং এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে অবদান রাখতে পারে।

 

 

 

 

শেয়ার করুন স্যোশাল মিডিয়াতে

Facebook
Twitter
LinkedIn
X
Print
WhatsApp
Telegram
Skype

সর্বশেষ খবর

এই সম্পর্কিত আরও খবর পড়