বুলবুল মল্লিক:
ডিজিটাল এ যুগেও টাঙ্গাইলের সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা নির্ধারিত হয় ১৮৭০ সালে স্থাপিত ঐতিহ্যবাহী একটি সূর্যঘড়ির মাধ্যমে। সূর্যঘড়ির সময়সূচি দেখে স্কুলের পিয়ন বেল বাজিয়ে ‘ঘণ্টা’র জানান দেয়। ঘড়িটির টিক টিক শব্দ নেই কিংবা ভার্চুয়াল পর্দায় নেই। ঘণ্টা, মিনিট ও সেকেন্ডের কাটার ছুটাছুটি নেই। সূর্যের আলোকরশ্মি ব্যবহার করে নির্ধারণ করা হয় সময়। ঐতিহ্যবাহী ওই সূর্যঘড়িটি দীর্ঘ ১৫৪ বছর ধরে বিদ্যালয়ে সময়ের জানান দিচ্ছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সেই সূর্যঘড়ির মাধ্যমে ২০২৪ সালকে বিদায় জানিয়ে খ্রিস্ট্রীয় ২০২৫ সালকে বরণ করতে প্রস্তুতি নিয়েছে বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারীরা।
জানা যায়, টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয় ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়ের সময় নির্ধারণের জন্য তখনই সূর্য ঘড়িটিও প্রতিষ্ঠিত হয়। সে আমলে কোনো ঘড়ি ছিল না। তাই সূর্যঘড়ির মাধ্যমে বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা আগমন, প্রস্থান ও ক্লাসের কর্মঘন্টা নির্ধারণ করতেন। এছাড়া আশপাশের এলাকার মানুষও ওই ঘড়ির মাধ্যমে নিজেদের সময় জেনে নিতেন। সেই সময় থেকে ওই ঘড়ির মাধ্যমে পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, টাঙ্গাইলের সন্তোষে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থান। বিদ্যালয়ের সামনে বিশাল একটি পুকুর রয়েছে। বিদ্যালয়ের ভেতর ঢুকতেই প্রথমে পুকুরের দক্ষিণ পাশের খেলার মাঠটি চোখে পড়ে। মাঠের দুপাশ দিয়ে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের রাস্তা। রাস্তার সামনে বিদ্যালয় ভবনের কাছেই পড়বে সূর্যঘড়ি। ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই সূর্যঘড়িটি আজও ইতিহাসের সাক্ষী বহন করছে।
বিদ্যালয়ের অস্টম শ্রেণির ছাত্রী তানজিলে বলেন, আমাদের স্কুলের সূর্যঘড়িটির ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। বিদ্যালয়ের ঐতিহ্য হচ্ছে সূর্যঘড়ি। এ ঘড়ির মাধ্যমে প্রাচীণ কালে সূর্যের মাধ্যমে দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী দৈনন্দিন কাজকর্ম করতো। ওই সময়ে প্রযুক্তিগত কোন ঘড়ি না থাকায় ওই সূর্যঘড়িই এলাকার মানুষের একমাত্র অবলম্বন ছিল। দূরদূরান্ত থেকে সূর্যঘড়িটি দেখার জন্য অনেকে এখানে আসেন।
সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক দুলাল রায় জানান, বিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সূর্যঘড়িটি স্থাপন করা হয়। সে সময় প্রযুক্তিগত কোনো ঘড়ি ছিলনা। সে সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইংরেজি শিক্ষক এই সূর্যঘড়িটি স্থাপন করেছিলেন।
তিনি জানান, এই ঘড়িটির বিশেষত্ত হচ্ছে- ঘড়িটিতে কোনো কাটা নেই। এটা সূর্যের আলোকরশ্মির ব্যবহার করে সময় নির্ধারণ করা হয়। ঘড়ির দুই স্তম্ভের দুই পাশে দাগান্বিত রয়েছে। যা ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এক পাশে নির্ধারণ করা ও ১২টার পর থেকে ৪টা পর্যন্ত অপর পাশে দাগান্বিত আছে। সূর্যের আলোকরশ্মি যখন ঘড়ির দাগান্বিত স্থানে পড়ে সেই আলোকরশ্মিই সময়ের জানান দেয়। ঘড়িটির দু’পাশে দাগকাটা রয়েছে। প্রতিটি দাগের মান দেওয়া আছে ১৫ মিনিট করে। সেই দাগের মান হিসাব করে প্রযুক্তিগত ঘড়ির সাথে সময়টা হুবহু মিলে যায়।
তিনি জানান, সময় নির্ধারণের জন্য কখনও যদি কিছুটা হেরফের হয় তাহলে সঠিক নির্ণয়ের জন্য ঘড়ির পেছনে একটি স্থায়ী ক্যালেন্ডার দেওয়া আছে। সেই ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে কোন মাসে কখন সময় যোগ বিয়োগ করতে হবে তার হিসাব সুন্দরভাবে দেওয়া আছে। সেই সময়টা যোগ এবং বিয়োগ করা হলে প্রযুক্তিগত ঘড়ির সাথে হুবহু মিলে যাবে। ঘড়িতে যখন আলোর ছায়া পড়ে। সেই আলোর ছায়ার প্রতিবিম্ব দেখে বোঝা যায় কখন কোথায় ছায়া পড়লে কয়টা বাজে।
তিনি অরও জানান, সূর্যঘড়িটি এখনও যখাযথভাবে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। তবে সরকারিভাবে যদি কোন অনুদান পাওয়া যেত তাহলে এই ঘড়িটি আরও সৌন্দর্যময় করে আধুনিক যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘড়িটি ব্যবহার করা যেত।
সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মিয়া চান জানান, ঐতিহ্যবাহী সূর্যঘড়ির মাধ্যমে তারা ২০২৪ সালকে বিদায় জানিয়ে ২০২৫ সালকে স্বাগত জানাবে।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরিফা হক জানান, সূর্যঘড়িটি জেলার ঐতিহ্য বহন করছে। ঘড়িটি এমন একটি কৌশলে তৈরি যা সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে সময় নির্ধারণ করতে হয়। বিগত দিনে সময় জানতে তেমন কোন ঘড়িই ছিল না। আগের যুগের মানুষ সূর্য ঘড়ির মত ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে সময় নির্ণয় করতো। ওই ঘড়িটির সৌন্দর্য, সংরক্ষণ ও আধুনিকায়ন করার প্রয়োজন হলে সব ধরনের পদক্ষেপ যথাযথভাবে নেওয়া হবে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আগামি দিনে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠুক। নতুন বছরে এই প্রত্যাশা রইল- যোগ করেন তিনি।