আজ- শুক্রবার | ২৩ মে, ২০২৫
৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ | বিকাল ৩:৪৩
২৩ মে, ২০২৫
৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
২৩ মে, ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

স্মৃতির আলোয় সাংবাদিক শাজাহান কমর ঃ এক নিঃসঙ্গ সংগ্রামী জীবন

*মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল*::

সমাজের কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা নিজেদের অস্তিত্ব দিয়ে একেকটা সময়কে চিনিয়ে দেন। তাঁদের পথচলা, কর্ম ও দর্শন হয়ে ওঠে অনুপ্রেরণার বাতিঘর। সাংবাদিক শাজাহান কমর ছিলেন তেমনই এক মানুষ, যিনি সাংবাদিকতার নিরেট জমিনে সততার বীজ বুনে গেছেন নীরবে- নিষ্ঠায়। তাঁর জীবন ছিল সংবাদমাধ্যমের ভেতরের সৎ ও সাহসী কণ্ঠের প্রতীক।

 

 

 

 

 

 

দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় প্রথমে একজন কর্মঠ সাংবাদিক হিসেবে যাত্রা শুরু করে পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মফস্বল সম্পাদক। একজন নেতৃত্ব প্রদানকারী চিন্তক, যিনি শুধু সংবাদের খোঁজ করেননি, খুঁজেছেন মানুষের কথা বলার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার পথ। দৈনিক আমাদের সময়ের মফস্বল সম্পাদক শাহজাহান কমর মাত্র ৬৫ বছর বয়সে ১০ এপ্রিল(বৃহস্পতিবার) ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর অকাল মৃত্যু যেন সংবাদপত্র জগতে এক শূন্যতা নিয়ে আসে।

 

 

 

 

 

 

 

 

শাজাহান কমরের জন্ম সিলেটের বড়লেখার গ্রামতলা গ্রামের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর বাবা সিদ্দেক আলী। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল দৃঢ়তা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস আর গভীর পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা। ছোটবেলায় স্কুলের দেয়াল পত্রিকায় লেখা, বিতর্কে অংশ নেওয়া এবং ছোটখাটো প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেওয়া ছিল তাঁর কাছে নিয়মিত ঘটনা। তাঁর মা-বাবা তাঁকে শৃঙ্খলা ও মানবিকতা শেখাতে কখনো পিছপা হননি। সাত ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ষষ্ঠ ছিলেন শাজাহান কমর। তাঁর পরিবার চেয়েছিল তিনি লেখাপড়া শিখে ডাক্তার বা প্রকৌশলী হন- কিন্তু তিনি নিজেই নিজের জন্য বেছে নেন সত্যকে অনুসন্ধান করার পথ- সাংবাদিকতা। সেই সময়টায় এ পেশাটি মফস্বল পর্যায়ে মারাত্মক ঝুঁঁকিপূর্ণ ছিল। তবুও তিনি পিছিয়ে যাননি।

 

 

 

 

 

 

সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জৈন্তাবার্তা পত্রিকার সিলেট প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে সিলেটের ডাক পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। শুরুতে তিনি কাজ করতেন মফস্বল থেকে প্রতিবেদন পাঠিয়ে। সমাজের নিভৃত পল্লী থেকে উঠে আসা মানুষের কথা, উপেক্ষিত জনপদের সমস্যা, স্থানীয় রাজনীতি, দুর্নীতি সব কিছুই ছিল তাঁর রিপোর্টের মূল বিষয়। তাঁর কলম ছিল একেবারে নির্মোহ। সত্যকে যেমন তিনি বুঝতেন, তেমনই তুলে ধরতেন। এই মনোভাব তাঁকে ধীরে ধীরে আলাদা করে তোলে। তারপর তিনি জাতীয় দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা এবং সর্বশেষ দৈনিক আমাদের সময়ে মফস্বল সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় থাকাবস্থায় মফস্বল সম্পাদক মহিবুল হোসেন জিতুর মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন আমিও বাংলাবাজারে সাংবাদিকতা করতাম। বাংলাবাজার থেকে মতি ভাই অর্থাৎ মতিউর রহমান চৌধুরী সম্পাদকের চাকুরি ছেড়ে ওনার স্ত্রী মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক প্রকাশিত মানবজমিন ট্যাবলয়েড আকারে বৃহদাকারে প্রকাশনায় মনোনিবেশ করেন। আমরা ৯ জন সাংবাদিক মতি ভাইয়ের সঙ্গে মানবজমিনে যোগ দেই। শাজাহান কমর বাংলাবাজরেই থেকে যান। মাঝখানে দীর্ঘ সময় তেমন যোগাযোগ ছিলনা।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

পরে বাংলাদেশে আধুনিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নাঈমুল ইসলাম খান যখন নতুন চিন্তা নিয়ে মাত্র দুই টাকায় পাঠকের হাতে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার ব্রত নিয়ে ‘দৈনিক আমাদের সময়’ এর প্রকাশনা শুরু করেন- সে সময় আমি ওই পত্রিকায় যোগ দেই। সেখানেই দেখা মেলে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী শাজাহান কমরের। আরও একজনের কথা না বললে প্রসঙ্গটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়- তিনি দীপঙ্কর লাহিড়ী- অসম্ভব মেধাবী ও করিৎকর্মা একজন সাংবাদিক। দ্বীপঙ্কর লাহিড়ী ও শাজাহান কমর সহ অন্যদের সমন্বয়ে ওই সময়ের দৈনিক আমাদের সময়ের গতি সংবাদপত্রের জগতে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল- যা দেশীয় সংবাদ সম্পাদনা ও পরিবেশনে নিরপেক্ষতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘আমি মানুষের মন বুঝে সংবাদ করি না, আমি সংবাদ করি মানুষের জন্য-সত্যের জন্য’। এই দর্শনই তাঁকে প্রথাবিরোধী করে তোলে, আবার সতীর্থদের কাছে জনপ্রিয়তাও এনে দেয়। এক সময় দৈনিক আমাদের সময়ের মালিকানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে মেকআপ-গেটআপ ও পাতা-দাম সহ সম্পাদনার কৌশল পরিবর্তিত হয়ে বাজারে অন্য দৈনিকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে। কিন্তু শাজাহান কমর পত্রিকাটি ছাড়েননি। দীর্ঘ দিনের কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি আমাদের সময় পত্রিকার মফস্বল সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এটি ছিল তাঁর জীবনের এক বড় স্বীকৃতি। কিন্তু এই দায়িত্বকে তিনি কখনও চাকরির মতো দেখেননি- বরং এটি ছিল তাঁর কাছে একটি মিশন। মফস্বলের সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের কলমকে নির্ভয়ে লিখতে শেখানোর মিশন। তাঁর সম্পাদনায় প্রতিটি রিপোর্ট ছিল তথ্যনির্ভর, বস্তুনিষ্ঠ এবং সমাজে প্রভাববিস্তরকারী। তিনি বলতেন, ‘মফস্বলের সংবাদই জাতীয় বাস্তবতার আয়না। ৬৮ হাজার গ্রামের সোদামাটির গন্ধ মেশানো সংবাদ জাতীয় পত্রিকাগুলোর অক্সিজেন। রাজধানীর চোখে যা ছোট- সেটা দেশের প্রাণস্পন্দন।’ তিনি দেশের শতাধিক জেলা প্রতিনিধি ও স্থানীয় রিপোর্টারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রাখতেন। তাঁদেরকে শুধু তথ্য নয়, নানা সমস্যায় পাশে দাঁড়াতেন, নৈতিক সাহস জোগাতেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

আজকাল আদর্শ ও দর্শন বিহীন সাংবাদিকের সংখ্যার পদচারণা দেখে শুধুমাত্র আশ্চার্যান্বিত নয়- রীতিমতো খাবি খেতে হয়। আথচ দীর্ঘ ৪৩ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে সততার সঙ্গে সাধারণ মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পথ চলছি। অসম সাহস নিয়ে ‘আর্মস, ড্রাগস ও মৌলবাদ’ এর সঙ্গে বিদ্রোহ করে যাচ্ছি। শাজাহন কমরও একটি দর্শন ও আদর্শ নিয়ে সাংবাদিকতা করেছেন। তাঁর সাংবাদিকতা দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল সততা, সাহস এবং সাধারণ মানুষের পক্ষাবলম্বন। তিনি কখনোই নিরপেক্ষতার নামে অন্যায়ের প্রতি নিরুত্তর ছিলেন না। বরং প্রতিবাদের ভাষাকে শক্তিশালী করে তুলতেন কলম দিয়ে। তাঁর মতে, ‘সাংবাদিকতা মানে নিছক খবর পরিবেশন নয়, এটি সচেতনতা তৈরির একটি দায়িত্ব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার- আর ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেবার।’ তাঁর লেখায় ছিল সাহস, তাঁর বক্তব্যে ছিল তীক্ষè যুক্তি, আর ব্যক্তিত্বে ছিল সম্মান ও মাধুর্য।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বর্তমানে নাম লিখিয়েই অনেকে নিজেকে খুব বড় সাংবাদিক মনে করেন- নিজেকে ওজন করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে শাজাহান কমর ছিলেন অতি সাধারণ। তিনি কখনও নিজেকে বড় সাংবাদিক ভাবেননি। বরং তরুণ সাংবাদিকদের নিঃস্বার্থভাবে সহযোগিতা করতেন। নতুন রিপোর্টারদের কাছে তিনি ছিলেন এক আদর্শ শিক্ষক- যাঁর উপদেশ বাস্তবসম্মত এবং সহানুভূতিশীল। অনেক তরুণ এখন বড় বড় বলে পরিচিত পত্রিকায় কাজ করছেন- যারা একসময় শাজাহান কমরের হাত ধরে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি নিয়েছেন। তাঁদের কাছে তিনি এক আদর্শ। তাঁর কাছের মানুষ মাত্রই জানেন, শাজাহান কমর কখনও রাগ করতেন না- কলিগ বা অনুজদের ভুল এমনভাবে ধরিয়ে দিতেন, যেন সেটাই শেখার সবচেয়ে বড় সুযোগ হয়ে দাঁড়াতো।

 

 

 

 

 

 

 

সাংবাদিক শাজাহান কমর ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত সরল, বিনয়ী ও নিরহঙ্কার। অসুস্থ বা আর্থিক সমস্যায় থাকা সহকর্মী বা এলাকার মানুষদের পাশে দাঁড়ানো ছিল তাঁর এক অদ্ভুত অভ্যাস। অনেক সময় তিনি নিজের কষ্ট গোপন রেখে অন্যকে সাহায্য করতেন।

 

 

 

 

এ বছরের ১০ এপ্রিল হঠাৎ করেই সাংবাদিক শাজাহান কমরের মৃত্যু সংবাদ আসে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শোকের ছায়া। মাত্র ৬৫ বছর বয়সে তাঁর অকাল মৃত্যুতে একে একে সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে গভীর শ্রদ্ধা।

 

 

 

 

 

একজন গণমাধ্যমকর্মী শাজাহান কমরের রেখে যাওয়া আদর্শ, সাংবাদিকতার দর্শন এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা যুগ যুগ ধরে অনেক সাংবাদিকের কাজকে প্রভাবিত করবে- এটা চিরন্তন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় সাংবাদিকতা মানে ক্ষমতার লেজুড়বৃত্তি নয় বরং মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো। তাঁর লেখাগুলো সংরক্ষণ করে রাখা উচিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাঁর জীবনের উপর একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হওয়া উচিত।

 

 

 

 

 

সাংবাদিক শাজাহান কমর শুধুই একজন সংবাদকর্মী ছিলেন না- তিনি ছিলেন এক চলমান দর্শন, এক আলোকবর্তিকা, যে আলো নিভে গেলেও তার আভা থেকে যায়। তাঁর মতো মানুষেরা কখনও চলে যান না। তাঁরা রয়ে যান তাঁদের কর্মে, তাঁদের লেখায় এবং তাঁদের আদর্শের মাঝে। আজ আমরা যখন ভুয়া সংবাদ, পেইড নিউজ কিংবা নিরপেক্ষতার মুখোশ পরা সাংবাদিকতার ভিড়ে হাঁপিয়ে উঠি- তখন শাজাহান কমরের সাংবাদিকতার জীবন আমাদের কাছে এক দৃঢ় পথনির্দেশনা হয়ে দাঁড়াবে- এটাই প্রত্যাশা। ওপারে ভালো থাকবেন প্রিয় শাজাহান কমর। আমিন।

 

 

 

 

 

শেয়ার করুন স্যোশাল মিডিয়াতে

Facebook
Twitter
LinkedIn
X
Print
WhatsApp
Telegram
Skype

সর্বশেষ খবর

এই সম্পর্কিত আরও খবর পড়