আজ- ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  রাত ৪:৫৬

আরশিনগরের পড়শিদের কথা

 

*ড. রকিবুল হাসান*

dristy-pic-69

লালন সাঁই বর্তমানে শুধু বাংলা সাহিত্যে নয় বিশ্বসাহিত্যেও একটি বড় অধ্যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় লালন পঠিত হচ্ছে- বিচার-বিশ্লেষণ হচ্ছে- বহুমাত্রিক গবেষণা হচ্ছে। লালনের গান আশ্চর্যরকমের এক রহস্যের অপার সৃষ্টি। যার ভাবরস ও মূলতত্ত্ব উদঘাটনে গবেষণাকর্মীরা নিরন্তর বিস্ময়ের মুখোমুখি। রহস্য থেকে ক্রমশ রহস্যের ভেতর ঢুকে পড়ছে- পুরো এক অন্য জগৎ- যেখানে মুগ্ধতা ও বিস্ময় একসঙ্গে সূত্রবন্দি। লালন এখন বিশ্বের সম্পদ- কিন্তু কুষ্টিয়ার মানুষ তিনি- বিশেষ করে ছেঁউড়িয়ার। তার জন্ম এবং সাধনক্ষেত্র দুটোই কুমারখালীর সীমা-রেখায়িত। লালনের জন্ম ভাঁড়ারা এবং সাধনক্ষেত্র ছেঁউড়িয়া- এই দুটো গ্রামই কুমারখালী উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। যে কারণে তিনি কুমারখালীর মনস্বী-সন্তান। এ কথা বলা বোধ হয় খুব বেশি ভুল হবে না, কুমারখালীতে আর কোনো বিখ্যাত সন্তানের জন্ম বা আবির্ভাব না ঘটলেও এক লালনের জন্যই কুমারখালী দেশে ও দেশের বাইরে বিখ্যাত হয়ে থাকত। তীর্থভূমি হিসেবে কুমারখালীর মর্যাদা একটুও কমত না। যদিও বাস্তবে কুমারখালী ঠিক এই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে নেই। বাংলা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাতজনের জন্ম ও আবির্ভাব ঘটেছে এখানে। এদের অনেকেই দীর্ঘসময় অবস্থানও করেছেন। লালনের আরশিনগর যদি আমরা কুষ্টিয়া ভেবে নেই, তার একটি অংশ কুমারখালী। লালনের পড়শিরাও যে তারই আলোছায়াতে নিজেদের গড়েছেন বা পড়শিদের ওপরও যে তার আলোছায়া পড়েছে- তা তো এখন আর গবেষণা করে বের করার দরকার পড়ে না। দিবালোকের মতো পরিষ্কার। আবার সেই আলোটা যে শুধু তার জীবদ্দশাতেই ঘটেছে তাও নয়, এখনও সে আলো ছড়িয়ে পড়ছে, কালের যাত্রায় তা ছড়াতেই থাকবে। রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভার ওপরও লালনের আলো পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সে আলোতে অপার মুগ্ধতায় ডুবেছিলেন। তিনি তা অকপটে স্বীকারও করেছেন, তার রচনায় সে আলোরশ্মি ছড়িয়ে আছে নানাভাবে। রবীন্দ্রনাথ লালনে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি নিজে লালনের গান পত্রিকায় ছেপেছেন, লালনের গান নিয়ে লিখেছেন, আলোচনা করেছেন। লালনের আলোটা তিনিই প্রথম ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সীমার বাইরে- দূরের সীমানায়। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান- জমিদারি দেখাশোনা- ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা- লেখালেখি; রবীন্দ্রজীবনে একটি বিশাল অধ্যায়। এসব বিবেচনা করলে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের মানুষ- কুমারখালীর মানুষ। যদিও রবীন্দ্রনাথের মতো মহান প্রতিভা কোনো বিশেষ এলাকা-দেশ-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না। তারা সবকালের সব দেশের। তারপরও শেকড় আর সাধনার জায়গাটি নির্ণয় করতে গেলে জন্মস্থান ও সাধনার জায়গাটির বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কালিদাস, শেকসপীয়ার, ওমরখৈয়াম, সফোক্লিসসহ সব বিখ্যাতজনের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। এরা সবকালের সব দেশের হয়েও তাদের নিজের জন্মস্থান এবং সাধনার জায়গাটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় চির উজ্জ্বল। আমাদের লালন-রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও এই একই কথা খাটে। লালনের ভাবশিষ্য আড়পাড়া গ্রামের গগণ হরকরার কথা ভুলে গেলে চলবে না। কী অসাধারণ গান বাঁধতেন। কাঁধে চিঠির ঝুলি নিয়ে হাঁটতেন; হাঁটার তালে তালে গান বাঁধতেন- সুর বুনতেন মনের স্রোতে। তার গানের খোঁজ খুব বেশি আমরা জানি না। কিন্তু তিনি একটি গানেই অমর হয়ে আছেন। ‘আমার মনের মানুষ যে রে/ কোথায় পাব তারে’- এই একটিমাত্র গানই গগণকে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন করে দিয়েছে। এই গানটি রবীন্দ্রনাথকে কী ভীষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করেছিল। এই গানের কথা ও সুর রবীন্দ্রনাথকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে তিনি এ গানে-সুরে প্রভাবিত হয়ে লিখেছেন ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি’। রবীন্দ্রনাথ তার এই মুগ্ধতার কথা অনেকভাবে বলেছেন। লালনের সঙ্গে একেবারে কুমারখালী শহরের প্রাণকেন্দ্রে বসবাসরত কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের দারুণ বন্ধুত্ব ছিল। বিভিন্ন সংকট-সমস্যায় তারা একে অপরের পাশে এসে দাঁড়াতেন। সাধনার ক্ষেত্রেও লালনের বড় রকমের প্রভাব রয়েছে কাঙালের ওপর। কাঙাল লালনের প্রভাবে প্রথম প্রথম একটি-দুটি করে গান বাঁধলেও পরবর্তীকালে গানই তার সাধনার প্রধান ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। তার অমরত্বলাভেও গানের ভূমিকা অসামান্য। কাঙালের সেই বিখ্যাত গানটি কে না জানে ‘ ওহে, দিন তো গেল সন্ধ্যা হ’ল/ পার কর আমারে।/ তুমি পারের কর্তা, শুনে বার্তা,/ ডাকছি হে তোমারে।’ কাঙালের শিষ্যদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য লাহিনীপাড়ার মীর মশাররফ হোসেন ও তেবাড়িয়ার অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। ‘বিষাদসিন্ধু’ ও ‘জমিদার দর্পণ’ এ দুটি কালজয়ী গ্রন্থের রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন। যদিও তার গ্রন্থসংখ্যা পঁয়ত্রিশ ছাড়িয়ে। মীর মশাররফ হোসেনও গান লিখেছেন। তার গানে লালন-কাঙালের প্রভাব বিদ্যমান। এমনকি মীর মশাররফের গানে লালনের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বিখ্যাত হয়ে আছেন ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের জন্য। যে নাটকে তিনি সত্যিকারভাবে দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তুলে ধরেছেন। কয়া গ্রামের সাহিত্যিক ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় ও জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনও তো লালনের বিশেষ পড়শি। সুসাহিত্যিক ললিতকুমারের ‘পারিবারিক স্মৃতিকথা’ অসাধারণ একটি গ্রন্থ। যেখানে রবীন্দ্রনাথ এবং বিপ্লবী বাঘা যতীন ও তার মামাদের পারিবারিক সম্পর্কের খুঁটিনাটি নানা বিষয় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। ললিতকুমার যে স্মৃতির কথা গ্রন্থে বলেছেন, তিনি নিজেও সে স্বর্ণস্মৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার লেখা ‘বাঘা যতীন’ এখনও সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন তো এ দেশে এক সময় ঘরে ঘরে পঠিত ছিলেন। তার ‘অবাঞ্ছিত’, ‘কি পাইনি’, ‘মোহমুক্তি’, ‘মেঘ বিজলি বাদল’ বাঙালি পাঠকদের প্রায় তিনটি দশক ধরে বিশেষ করে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তুর দশক মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রেখেছিল। ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতিমান আকবর হোসেনও গান লিখেছেন। যদিও তার গান এখনও অপ্রকাশিত-অপ্রচারিত। তার নিজের হাতে লেখা গানের পাণ্ডুলিপিতে গানের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম নয়। তার গান শ্রোতার কানে পৌঁছলে হয়তো আকবর হোসেনের শিল্পমেধার নতুন আর এক স্বরূপ আবিষ্কৃত হতে পারত। কবিতাও কম লেখেননি তিনি। প্রকাশ ঘটলে ‘কবি’ অভিধাও হয়তো পেতে পারতেন তিনি। জোবেদা খানম উপন্যাস লিখে এক সময় পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তার ‘অভিশপ্ত প্রেম’ ও ‘দুটি আঁখি দুটি তারা’ পাঠকনন্দিত উপন্যাস। লিখেছেন উপন্যাস-গল্প-নাটক-শিশুতোষ গ্রন্থ মিলিয়ে প্রায় পঁচিশটি গ্রন্থ। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা কবি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। এরা কুমারখালীর আলো-মাটির কৃতী সন্তান। শহীদ আশরাফ কুষ্টিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রের মানুষ ছিলেন। উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ লিখেছেন। তার অনেক কাহিনী চলচ্চিত্র হয়েছে। কল্যাণ মিত্র বাংলা সাহিত্যের দুর্দান্ত এক নাট্যকার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়া জাগানো ‘জল্লাদের দরবার’ তার অমর সৃষ্টি। অসংখ্য বিখ্যাত নাটকের স্রষ্টা তিনি। লালনের আপন-পড়শি- সময়ের সিঁড়িতে আগে আর পরের- লালনের আলোতেই নবতর সৃষ্টির পথের অভিযাত্রী। গীতিকার মাসুদ করিমের কথা তো না বললেই নয়। কুমারখালীর প্রাণকেন্দ্র দুর্গাপুরে জন্ম-বেড়ে ওঠা। লালনের ছেঁউড়িয়া থেকে দুর্গাপুরের পথ কতটুকু- এখনকার হিসাবে পনেরো-বিশ মিনিটের- হয়তো তারও কম। গানের বাতাসটি কী দারুণভাবে লেগেছিল তার মনে-মননে। আধুনিক গানে এক সময় কী রাজত্বটাই না তিনি করেছেন। ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাব’, ‘আমি শিল্পী তোমাদের গান শোনাব’, ‘তন্দ্রা হারা নয়ন আমার এই মাধবী রাতে’,- এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের রচয়িতা লালনের এই উত্তরসূরি পড়শি। মোকসেদ আলী সাঁই লালনের যোগ্যশিষ্য ছিলেন। তার গানও ভাববাদীদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানত।

কুষ্টিয়ার হাটশ হরিপুরের কবি-গীতিকার আজিজুর রহমানের ‘কারো মনে তুমি দিও না আঘাত/ সে আঘাত লাগে কাবার গায়ে’ এক সময় অনেকে মনে করতেন এ গানের গীতিকার কাজী নজরুল ইসলাম। কারণ এমন গান নজরুল ছাড়া আর কে লিখবেন! আজিজুর রহমান এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। তার অনেক বিখ্যাত গান আছে- এখনও মুখে মুখে ভেসে বেড়ায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক সময় আজিজুর রহমান ও মাসুদ করিম গীতিকার হিসেবে অপরিহার্য ছিলেন। আবু জাফর গীতিকার হিসেবে বিশিষ্ট। এখন তিনি গান না লিখলেও তিনি যেসব গান লিখেছেন তা কালজয়ী। ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে’, ‘নিন্দের কাঁটা যদি না বিধিলো প্রেমের কী সাধ আছে’, ‘তোমরা সবাই ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’- এরকম অসংখ্য বিখ্যাত গানের রচয়িতা আবু জাফর। আরশিনগরের পড়শিরা যে শুধু গান বেঁধেছেন, তা নয়। এখানেই তো প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মোকসেদ আলী সাঁই, নার্গিস পারভীনের জন্ম। আবদুল জব্বার জীবন্ত কিংবদন্তি। লালনের গান মানেই তো ফরিদা পারভীন। বিউটিকে তো লালনকন্যাই বলা হয়। চন্দনা মজুমদার, শাহনাজ বেলী ও সালমাও সুনাম অর্জন করেছেন। লালন-জীবনীতো লিখেছেন লালনেরই আর এক পড়শি বসন্তকুমার পাল। খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. আবুল আহসান চৌধুরী ও ড. আনোয়ারুল করিম- এরা তো সবাই লালনের বড় আপন-পড়শি- লালন-আলোতে তারা এখনও পথ হাঁটছেন। আর কবিতায় রবিউল হুসাইন, নাসের মাহমুদ, বিলু কবীর, মাহমুদ হাফিজ, মীর মুর্তজা আলী, লিটন আব্বাসরাও দারুণ পড়শি পথ হাঁটছেন এখনও তারা। এখনকার তরুণরাও তো লালনের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন।

লালনের কুষ্টিয়া- লালনের আরশিনগর-গান-কবিতা-সুরের ভুবন। লালন যে আলো ছড়িয়ে গেছেন- যে সুর বাতাসের গহিনে মেখে দিয়ে গেছেন- তা নতুন নতুন প্রাণে- নতুন নতুন আলোয়- নতুন নতুন সুরে ও নতুন নতুন ধারায় প্রতিনিয়ত নিঃশ্বাসের মতো জেগে উঠছে- যা তার সময়কাল থেকে শুরু করে সময়ের সিঁড়ি ধরে ক্রমশ হিরকদ্যুতিতে কালের যাত্রায়- যা প্রাণের গভীরে এক গভীরতম সত্য- বিশ্বাস এবং অবশ্যই অনুভব ও সৃষ্টির অপ্রতিরোধ্য এক শক্তি।

(সংগৃহীত)

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno