আজ- ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  ভোর ৫:০১

ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি-৩ :: শাড়ির কাঁচামাল সুতার বাজার আকাশছোঁয়া

 

বুলবুল মল্লিক:


আসন্ন ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে টাঙ্গাইল শাড়ির প্রধার কাঁচামাল সুতার বাজারে দাম বেড়ে আকাশছোঁয়া হয়েছে। সুতা ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তারা বেশ ফুলে ফেপে উঠছেন। শাড়ি বিক্রির লভ্যাংশের মূল অংশটা চলে যাচ্ছে ওই সুতা ব্যবসায়ীদের পেটে- অভিযোগ তাঁতীদের।
জানাগেছে, দেশভাগের আগে ১৯৪৫ সালে এতদাঞ্চলের তাঁতীদের ভাগ্যোন্নয়নে ‘দি টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ আর্টিজেন্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁতীদের অধিকার আদায়ের জন্য স্বতন্ত্র সংগঠন বাংলাদেশ তাঁতীলীগের প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ‘দি টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ আর্টিজেন্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড’র মাধ্যমে তাঁতীদের মাঝে সুতা বণ্টন করে দেয়া হয়। সে সময়ে তাঁতীরা কিছুটা সুখের মুখ দেখেছিল। কিন্তু কতিপয় মধ্যস্বত্ত্বভোগী তাঁত ব্যবসায় না থেকেও ৩০০-৪০০ তাঁতের লাইসেন্স বাগিয়ে ওই তাঁতের বিপরীতে সুতা উত্তোলন করে খোলা বাজারে অধিকমূল্যে বিক্রি করা শুরু করে। ফলে আগের মহাজনি প্রথায় তাঁতীদের ভাগ্যের চাকা আটকে গিয়ে ঋণে জর্জরিত হয়।
টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরিতে সাধারণত ২০/১,৪০/১, ৬০/১, ৬০/২, ৬২/১, ৭০/১, ৭২/১, ৭৪/২, ৮০/১, ৮০/২, ৮২/১, ১০০/১, ১০০/২, ১০২/১, ১১০/১, ১২০/১, ১২০/২ ইত্যাদি কাউণ্টের সুতার প্রয়োজন হয়। এরমধ্যে অনেক সুতাই আমাদের দেশে তৈরি হয়, কিন্তু সেগুলোর গুণগত মান উন্নত টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য প্রযোজ্য নয়। টাঙ্গাইল শাড়ির প্রধান কাঁচামাল উন্নতমানের সুতা বর্তমানে পার্শ¦বর্তী দেশ ভারত ও চীন থেকে আমদানি করা হচ্ছে। আমদানিকৃত সুতা দেশে পছন্দমতো রঙ করা হচ্ছে। মধ্যম শ্রেণির সুতা দেশেই প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। প্রক্রিয়াজাত করার জন্য তাঁত সমৃদ্ধ এলাকায় তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কারখানা। সেখানে কাঁচা সুতা ধৌত করে পানিতে সিদ্ধ করে পাকা সুতায় রূপান্তর করা হয়। দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ও কালিহাতী উপজেলার বল্লায় এ রকম বেশ কিছু কারখানা দেখা যায়। স্থানীয় ভাষায় ওইসব কারখানাগুলোকে ‘প্রসেস মিল’ বলা হয়ে থাকে। সুতা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার কারিগর নীলা দাস, শামছুল আলম, ফরিদ মিয়া সহ অনেকেই বলেন, সুতার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এসব কারখানার কারিগররা ব্যস্ত সময় পাড় করছে। এদিকে পাঁকা সুতাকে রঙ করার জন্য এ অঞ্চলে বেশ কিছু রঙ কারখানাও রয়েছে। বল্লা গ্রামের রংকর শাজাহান মিয়া, বেহেলাবাড়ির রংকর ফজল হক, ধুলটিয়া গ্রামের রংকর শাহজামাল বলেন, অনেক তাঁত বন্ধ হওয়ায় সুতা রঙ করা কমে গেছে। তবে ঈদের কাপড় তৈরি জন্য তারাও অনেকটা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। 
রংকররা জানান, সুতা রঙিন করতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় রঙ। এলাকায় তাঁতের পরিমাণ কমে যাওয়ায় রঙের দোকানে বেচাকেনা প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ কমেছে। তবে ঈদের সামনে রঙের দোকানেও বেচাকেনা অনেকটা বেশি। রঙ বিক্রেতা আবু আইয়ুব, গোলাম মোস্তফা, আবু তালহাদ সহ অনেকেই জানান, প্রতি কেজি রঙের খুচরা মূল্য ২০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা। শাড়ি উৎপাদন কমে যাওয়ায় রঙের বিক্রি প্রতিদিন কমেছিল ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। ঈদ সামনে থাকায় বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে।
‘র’ সুতা কিনে প্রক্রিয়াজাতকরণ, পাকাকরণ, রঙ করার পর শাড়ি বানানোর উপযোগী হয় সুতা। বিভিন্ন সুতার দোকান ঘুরেও একই চিত্র লক্ষ করা যায়। সুতা বিক্রি বেড়েছে। সুতা বিক্রেতা মিন্টু মিয়া, আব্দুল খালেক মঞ্জু ও আব্দুর রশিদ জানান, ঈদ উপলক্ষে সুতা বিক্রি অনেকটা বেড়েছে। এর কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, ঈদের কারণে তাঁতীরা আগের চেয়ে বেশি শাড়ি উৎপাদন করছেন। ফলে সুতার প্রয়োজন বেড়েছে।
তাঁতশাড়িতে নকশাকারকরা সারা বছর কোন রকমে সময় পাড় করলেও ঈদের সময়ে নকশা তৈরিকারকদের সবচেয়ে ব্যস্ত সময় পাড়ি দিতে হয়। আমদানি-রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় নতুন নতুন ডিজাইন যোগ হয় টাঙ্গাইল শাড়িতে। নকশা তৈরিকারক শর্মিলা রাণী, সুস্মিতা বসাক, আবুল আহাম্মেদ, আবুল হোসেন, মফিজুর রহমান বলেন, ঈদের জন্য টাঙ্গাইল শাড়ির কদর বেড়ে যাওয়ায় এ শিল্পে নতুন ডিজাইন নিচ্ছেন মালিক পক্ষ। এ শিল্পের সচল অবস্থা ধরে রাখতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও নতুন নতুন নকশা তৈরি করা হচ্ছে। ফলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নকশা তৈরি কারকরা।
টাঙ্গাইল শাড়ির ডিজাইনার ও পাথরাইলের নীল কমল শাড়ির স্বত্বাধিকারী নীল কমল বসাক জানান, ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে প্রতি বছরের মতো এবারও তারা অ্যান্ডি সিল্ক ও কটকি শাড়িতে অত্যাধুনিক ডিজাইন সন্নিবেশ করেছেন। তিনি জানান, শাড়ি তৈরির অন্যতম প্রধান উপাদান সিল্ক সুতা চিন থেকে আমদানি করতে হয়। সরকার সিল্ক সুতা আমদানির উপর ৬৯% ট্যাক্স-ভ্যাট আরোপ করেছে। যে কারণে শাড়ির উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্স ও ভ্যাটের কারণে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সরাসরি সিল্ক সুতা আমদানি করতে পারছেন না। যারা আমদানি করছেন তারা কেউই শাড়ি উৎপাদনের সাথে জড়িত নয়। ফলে তাঁতীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
প্রখ্যাত তাঁত শাড়ি ব্যবসায়ী যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং-এর স্বত্ত্বাধিকারী রঘুনাথ বসাক জানান, ঈদ উপলক্ষে টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যবসা এবার তেমন জমে ওঠেনি। সুতার দাম কম হলে ঈদের বাজার জমজমাট হতো এবং তাঁতীরা লাভবান হতে পারতো। সুতার দাম সিল্ক প্রতিকেজি সাড়ে ৬ হাজার টাকা দরে, কটন প্রতি বান্ডিলে ৪ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সুতার দাম বাড়লেও কাপড়ের দাম তুলনামূলকভাবে বাড়েনি। এ জন্য মুনাফা কম হচ্ছে। ঈদের বাজারে এবার টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে তাঁতের শাড়ি ছাড়াও সিল্ক, জামদানি, দোতারি, রেশম, আনারকলি, তসর শাড়ির চাহিদাও কম নয়। সিল্ক শাড়ি সাড়ে ৩ হাজার টাকা থেকে ১২ হাজার, নেট জুট সাড়ে ১১ হাজার, বাহারি নকশার অন্যান্য শাড়ি সাড়ে ১৬ হাজার, কটন জুট আড়াই হাজার, টিস্যু সিল্ক সাড়ে ৪ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
দি টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ আর্টিজেন্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড’র বর্তমান সভাপতি মো. মোফাখখারুল ইসলাম জানান, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তাদের সংগঠনের মাধ্যমে লাইসেন্স অনুসারে তাঁতীদের মাঝে সুতা বণ্টন করা হয়েছে। উপ-মহাদেশের তাঁতীদের মধ্যে বাংলাদেশের তাঁতীদের ছিল স্বর্ণযুগ- এখন যা অতীত। পরবর্তীতে সরকার বস্ত্র দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে তাঁতবোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু তাঁতবোর্ডের সুফল তাঁতীরা পাচ্ছেনা।
তাঁত ব্যাংক প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, উৎপাদিক শাড়ি বন্ধক রেখে তাঁতীদের ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হলে সারা বছর তাঁতীদের ফ্যাক্টরিতে শাড়ি তৈরি হবে। ফলে ধীরে ধীরে তাঁতীরা টাঙ্গাইল শাড়ির চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ পাবে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno