আজ- ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  বিকাল ৫:৫০

কবর দিতে গোরস্থানেও হিজরাদের ঠাঁই হয়না!

 

বুলবুল মল্লিক:

সংগৃহীত ছবি

টাঙ্গাইলে যথাযথ মর্যাদা বঞ্চিত জাতি হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা মারা গেলে কবর দেওয়ার জন্য গোরস্থানে সাড়ে তিন হাত জায়গাও মেলেনা। জন্ম থেকে মৃত্যুর পর পর্যন্ত অনাদর-অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের মধে কাটে তাদের জীবন। কীভাবে কাটছে তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষের জীবন তা নিয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই পরিবার, সমাজ এমন কি রাষ্ট্রের। নেই কোন সরকারি-বেসরকারি জোড়ালো পদক্ষেপ।

বিশ^ব্যাপী মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটলেও পাল্টাচ্ছে না হিজড়াদের জীবন। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে জোগাড় করছে অন্ন-বস্ত্র। কখনও ঘুরছে দোকানে-দোকানে। টাঙ্গাইলে বন্ধন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা হিজড়া তথা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জীবন-মানের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে।


টাঙ্গাইলে হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা বন্ধনের তথ্য মতে, জেলায় সাত শতাধিক হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রাথমিক জরিপ মতে, দেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার ছিল। তবে ২০২২ সালের জনশুমারি মতে, দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন।


জেলার মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করে- হিজড়া সম্প্রদায় দেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও তারা অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সর্বোপরি তাদেরকে সমাজের মূল ¯্রােতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সম্পৃক্তকরণ অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে দীর্ঘ তিন মাস হিজড়াদের জীবন-মান পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, খাদ্য-বস্ত্রের খোঁজেই হিজড়াদের জীবন পাড় হয়। অধিকাংশ হিজড়াদের নিজস্ব বাসস্থান নেই- নেই মানসম্মত কর্মসংস্থান। তাদের পুরো জীবন ভাড়া বাড়িতে কাটিয়ে দিতে হয়। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে যে উপার্জন হয়- তাতে খাদ্য আর বস্ত্রের ব্যবস্থা করাই দায়। তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কোন পদক্ষেপ নেই। হিজড়াদের জীবন-মান নিয়ে অনেক হিজড়ার সাথে কথা হয়- বেড়িয়ে আসে তাদের জীবন যাত্রার প্রকৃত চিত্র।


হিজড়া সম্প্রদায় সৃষ্টি কর্তার সৃষ্টি। অথচ সমাজে অবহেলার দায় নিতে হয় নিজেদেরকে। জন্মের পর বোঝার উপায় নেই কে হিজড়া। ধীরে ধীরে তাদের আচরণ পরিবর্তন হতে থাকে। স্ত্রীলিঙ্গ হয়েও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আসক্তি হারাতে থাকে। তদ্রুপ পুং-লিঙ্গের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। যখন পরিবার বুঝতে পারে তাদের সন্তান হিজড়া- তখন পরিবার নানাভাবে সামাজিক চাপে পড়তে থাকে। সামাজিক চাপে পরিবারও সন্তানের প্রতি কদর কমিয়ে দেয়।


হিজড়ারা জানায়, পরিবারের পর যখন বন্ধুদের সাথে মেশার পালা, ঠিক সেই সময়ে খেলার সাথীদের অবহেলা শুরু হয়। বন্ধুদের কাছ থেকে এমন প্রাপ্তি যেন হিজড়াদেরকে নতুন সমাজ গঠনের দিকে ঠেলে দেয়। বাড়ির বাইরে গেলেই তারা বন্ধুদের কাছে অবহেলিত হতে থাকে। শুরু হয় স্কুল জীবন। অধিকাংশ স্কুলে ভর্তি হতে পারে না হিজড়ারা। সব শিশুদের স্কুলে ভর্তির অধিকার থাকলেও হিজড়া শিশুরা যেন অন্য গ্রহের বাসিন্দা। নানা কৌশলে তারা শিক্ষা বঞ্চিত হয়। সমাজে হেয় হয়ে যখন হতাশাগ্রস্ত হয়- তখন খোঁজে একটি দল। একটি সঙ্গ। পাশেই হিজড়াদের ঐক্যবদ্ধ চলাচল দেখে তারা দলে ভিরে যায়। এভাবেই হিজড়ারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলাচল শুরু করে।


সুবিধা বঞ্চিত এসব হিজড়াদের সাথে কথা বলে তাদের জীবন-মান নিয়ে নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার লিলি নামে এক হিজড়া জানান, শৈশবেই পরিবারের কাছ থেকে অবহেলা শুরু হয়। অতপর বন্ধু ও সমাজের অবহেলা থেকে চলে আসেন হিজড়া সম্প্রদায়ের দলে। এখন এ দলের সাথে মিশেই তার জীবন জীবীকা চলছে। একই কারণে হিজড়া দলে চলে এসেছেন কালিহাতী উপজেলার বৈশাখী। পরিবারের সাথে তার তেমন কোন যোগাযোগ নেই। সমাজের চাপ থেকে পরিবারকে রেহাই দিতে পরিবার বিচ্ছিন্ন বৈশাখী।


নাগরপুরের জেরিন শেখ জানান, শৈশবে তার শরীর ও মানসিক পরিবর্তন হতে থাকলে শুরু হয় অবহেলা। বন্ধুদের সাথে মেশার সুযোগ পাননি। স্কুলে গেলে বন্ধুরা তার সাথে মেশেনি। বন্ধুরা বলতেন হিজড়া- হাফ লেডিস। পরিবারও তাকে সাপোর্ট করেনি। এর পর স্কুল ছাড়েন জেরিন। তারপর তিনি আর পড়ালেখা করতে পারেননি। সরকারিভাবে বিউটিশিয়ানের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরও তিনি আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ায় পার্লার চালু করতে পারছেন না। একই অপবাদে তৃতীয় শ্রেণির পর আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেনি এলেঙ্গা পৌর সভার মর্জিনা। সমাজে অধিকার বঞ্চিত হয়ে হিজড়া দলে যোগ দিয়েছেন টাঙ্গাইল সদরের সোহানা।


টাঙ্গাইলের হিজড়া সংগঠন বন্ধনের সভাপতি জেরিন শেখ হিজড়াদের কোন প্রকার ছবি প্রকাশ না করার অনুরোধ করে জানান, জেলায় সাত শতাধিক হিজড়া রয়েছেন। তারা সুবিধা বঞ্চিত মানুষ। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে তারা সব সময় সুবিধা বঞ্চিত থাকেন। সম্মানজনক কর্মসংস্থান না পেয়ে তারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে উপার্জন করেন। মানসম্মত উপার্জন ব্যবস্থা থাকলে তাদের রাস্তায় ঘুরে উপার্জন করতে হত না। উপার্জনের বড় অংশ ধারাবাহিকভাবে গুরুদের ভাগ দিতে হয়। এরপর যা থাকে জীবন জীবীকা চালানোই কষ্টকর। সরকারিভাবে ৫০০ টাকা হিজড়া ভাতা থাকার নিয়ম থাকলেও ভাতা পাচ্ছেন ৫০ বছরের বেশি বয়সী হিজড়ারা। কম বয়সী হিজড়ারা জীবন-জীবিকার খোঁজে রাস্তায় নামেন।


তিনি বলেন, সমাজে আমাদের সম্মান নেই। আমরা হোটেলে বসলে স্বাভাবিক মানুষ অন্য টেবিলে চলে যান। বাসের সিটে বসলে উঠিয়ে দেন। কখনও স্বাভাবিক মানুষ অন্য সিটে চলে যান। হাসপাতালে একজন হিজড়া ভর্তি হলে রোগিরা অন্য সিটে চলে যায়। এমন কি মৃত্যুর পর কবর দেওয়ার জন্য গোরস্থানে সাড়ে তিন হাত জায়গাও তারা পানা। একজন হিজড়া মারা গেলে কাকুতি-মিনতি করে কবর দেওয়ার জায়গা নিতে হয়। তিনি নিজেও টাঙ্গাইলের একটি গোরস্থানে তার কবরের জন্য দুই শতাংশ জায়গা কিনে রেখেছেন।


সংগঠনের পক্ষ থেকে জেরিন আরও জানান, তিনটি লিঙ্গের একটিকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব না। দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিনত করতে হলে তিন জাতিকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে হবে।


তিনি হিজরাদের পূণর্বাসন, হিজড়া ভাতা নিশ্চিত করা, চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আলাদা সিটের ব্যবস্থা করা, সকল কাজে হিজড়াদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি নিশ্চিত করাসহ হিজড়াদের জন্য আলাদা কলোনি তৈরির দাবি জানান তিনি।


এদিকে, সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে ২০১২-১৩ অর্থ বছর ৭টি জেলায় হিজড়াদের নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প শুরু হয়। ওই প্রকল্পে ২০১২-১৩ অর্থ বছরে মোট বরাদ্দ ছিল বাহাত্তর লক্ষ সতের হাজার টাকা। এরপর প্রতি অর্থ কছরেই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে পূর্বের জেলাসহ নতুন ৪৩ টি জেলায় প্রকল্পের আওতা সম্প্রসারণ করে মোট ৬৪ জেলায় এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।

২০২০-২১ অর্থ বছরে এ প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ছিল- পাঁচ কোটি ছাপ্পান্ন লাখ টাকা। স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৪ স্তরে (জনপ্রতি মাসিক প্রাথমিক ৭০০, মাধ্যমিক ৮০০, উচ্চ মাধ্যমিক ১০০০ এবং উচ্চতর ১২০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি প্রদানের কথা রয়েছে। কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে স্কুলে ভর্তি হতেই হিজড়াদের হোঁচট খেতে হয়।


এদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ৫০ বছর বা তদুর্ধ বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ ভাতা(জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা) প্রদান করা হলেও ৪৯ বছর বয়সী বা তার কম বয়সীদের অন্যের কাছে হাত পেতেই চলতে হয়। হিজড়াদের দাবি তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।


মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আজাদ জানান, হিজড়াদের জীবন অত্যন্ত মানবেতর। তাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ নেই। জীবন-জীবিকার তাগিদে হিজড়া সম্প্রদায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা জরুরি। জাতির উন্নয়নে পুরুষ-স্ত্রীর পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গ তথা হিজড়াদের সম্পৃক্ততার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।


টাঙ্গাইল জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. শাহ আলম জানান, টাঙ্গাইলে তিন শতাধিক হিজড়া রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫০ উর্ধ্ব বয়সী ৫৮ জনকে সরকার ভাতা দিচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে বয়সসীমা নেই। হিজড়াদের ক্ষেত্রেও বয়সসীমা শিথিল করতে তারা উচ্চ পর্যায়ে সুপারিশ করেছেন। পুনর্বাসন নিয়েও সরকার ভাবছে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno