আজ- ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  সকাল ১১:৩৯

করোনায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিদের ক্ষয়ক্ষতি শত কোটি টাকা ছাড়াল :: প্রণোদনার দাবি

 

বুলবুল মল্লিক:

টাঙ্গাইলে করোনা মোকাবেলায় লক ডাউনের কারণে তাঁত ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় জেলার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়াল। সোমবার(১৮ মে) পর্যন্ত এখাতে ন্যূনতম ১০১ কোটি ২৮ লাখ ৪৫ হাজার ৬০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকারি নির্দেশনায় তাঁত ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে জেলার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিরা প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৮৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪০০টাকা ক্ষতির শিকার হচ্ছে। তাঁত বোর্ডের স্থানীয় বেসিক সেণ্টার এ তথ্য নিশ্চিত করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিদেরকে সরকারি প্রণোদনা দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে।

জানাগেছে, টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য জেলার কালিহাতীর বল্লায় (ঘাটাইল, মধুপুর, ধনবাড়ী, গোপালপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলার জন্য) একটি এবং সদর উপজেলার বাজিতপুরে (দেলদুয়ার, বাসাইল, মির্জাপুর, নাগরপুর, সখীপুর ও সদর উপজেলার জন্য) একটি বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মোট দুইটি বেসিক সেণ্টার রয়েছে।

বাতাঁবো’র বল্লা ও বাজিতপুর এ দুইটি বেসিক সেণ্টারের ৪৭টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির চার হাজার ৩৯১টি তাঁতি পরিবারের ২৭ হাজার ৯৩১টি তাঁত চালু বা সচল এবং দুই হাজার ৬৭৩টি তাঁত আগে থেকেই বন্ধ বা অচালু রয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকারি নির্দেশনায় কল-কারখানা-ফ্যাক্টরি বন্ধ ঘোষণা করায় চালু তাঁত ফ্যাক্টরিগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জেলার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিরা প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৮৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪০০টাকা ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

বল্লা (কালিহাতী) বেসিক সেণ্টারের সূত্রমতে, এ সেণ্টারের ১৫টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির অধীনে দুই হাজার ১২৪টি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতি পরিবারের ১৮ হাজার ১৭৫টি তাঁত রয়েছে। এ বেসিক সেণ্টারের তাঁতগুলোতে অপেক্ষাকৃত মোটা সুতার শাড়ি উৎপাদিত হয়ে থাকে। বেসিক সেণ্টারের হিসাব মতে, ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় প্রতিটি তাঁতে দৈনিক ন্যূনতম ৬০০ টাকা হারে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ টাকা করে ক্ষতি হচ্ছে। সে হিসেবে ২৬ মার্চ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত ৫৪ দিনে ৫৮ কোটি ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৮০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাজিতপুর বেসিক সেণ্টার সূত্রে জানা যায়, এ সেণ্টারের ৩২টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির দুই হাজার ২৬৭ তাঁতি পরিবারের মোট ১২ হাজার ৪২৯টি তাঁত রয়েছে। এরমধ্যে দুই হাজার ৬৭৩টি তাঁত আগে থেকেই বন্ধ বা অচালু এবং ৯ হাজার ৭৫৬টি তাঁত চালু। মূলত: এ বেসিক সেণ্টারের তাঁতগুলোতে মিহি সুতার ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি হয়।

হিসাব অনুযায়ী সরকারি নির্দেশনা মেনে বন্ধ রাখা প্রতি তাঁতে ৮০০ টাকা হারে প্রতিদিন গড়ে ৭৮ লাখ ৪ হাজার ৮০০টাকা ক্ষতি হচ্ছে। সে হিসেবে ২৬ মার্চ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত ৫৪ দিনে ৪২ কোটি ১৪ লাখ ৫৯ হাজার ২০০টাকা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।

বল্লা এলাকার ক্ষুদ্র তাঁতি নুর ইসলাম, দুলাল হোসেন, বেহেলাবাড়ীর বাবু মিয়া, শামছুল মিয়া, কাজীবাড়ীর হবিবুর রহমান, হাসমত আলী, মমিন নগরের আবুল হোসেন, বকুল আহাম্মেদ, রামপুরের সেকান্দর আলী, হযরত আলী, টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী দেলদুয়ারের পাথরাইল এলাকার ধুলটিয়ার রতন বসাক, উজ্জল, নলসদা গ্রামের আব্দুর রশিদ মিয়া, রহম আলী সহ অনেকেই জানান, করোনার কারণে সরকারি নির্দেশনায় ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় প্রতি তাঁতে দৈনিক ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা লোকশান হচ্ছে। এছাড়া প্রায় সোয়া লাখ তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।

ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁত মালিকরা নিজেদের দিনকালই চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা জানান, তাঁত শ্রমিকরা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ সামগ্রী নিতে পারলেও সামাজিক অবস্থানের কারণে তারা লাইনেও দাঁড়াতে পারছেন না।

বল্লা ১নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. দুলাল হোসেন জানান, করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সরকার প্রণোদনা দিচ্ছেন অথচ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিরা করোনা মোকাবেলায় ফ্যাক্টরি বন্ধ রেখে ইচ্ছাকৃত গৃহবন্দি থাকলেও তাদেরকে এখনো প্রণোদনার আওতায় আনা হয়নি। তারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিদেরকে প্রণোদনা দেওয়ার দাবি জানান।

টাঙ্গাইল জেলা তাঁতি লীগের সহ-সভাপতি কালাচাঁদ বসাক জানান, করোনার কড়াল থাবায় ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপাদনে ধস নেমে এসেছে। ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে। প্রণোদনা না পেলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেনা।

টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও যজ্ঞেস্বর অ্যান্ড কোং এর মালিক রঘুনাথ বসাক জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে জেলার তাঁত শিল্পে স্থবিরতা নেমে এসেছে। শাড়ি ব্যবসার জন্য পয়লা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতর দুটি প্রধান মৌসুম। পয়লা বৈশাখে কোনো শাড়ি বিক্রি হয়নি। ঈদুল ফিতরের জন্য নতুন শাড়ি বানানো হয়নি। উৎসবের জন্য যেসব শাড়ি আগেই মজুদ করা ছিল সেগুলোও বিক্রি হচ্ছে না।

তিনি জানান, বৈশাখীতে শাড়ি তৈরিতে ১০৭ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। শাড়ি প্রতি গড়ে ১০০টাকা লাভে বিক্রি হলে ৮ কোটি ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকার মত লাভ হত। করোনার কারণে বৈশাখীতে তাঁতিরা এই লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ঈদুল ফিতরের শাড়ি বৈশাখী শাড়ির চেয়ে আরো দামি হয়ে থাকে। বিক্রিও হয় বেশি। এখানে লোকসানের পরিমাণ বৈশাখীর তুলনায় তিন-চার গুণ বেশি হবে।

তিনি আরো জানান, করোনা তাঁত শিল্পের মহা ক্ষতি করেছে। সরকারি প্রণোদনা না পেলে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তিনি তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুত করে ব্যাংকের মাধ্যমে তাঁতিদেরকে প্রণোদনা দেওয়ার দাবি জানান।

বাতাঁবো’র বল্লা (কালিহাতী) বেসিক সেণ্টারের লিয়াজোঁ অফিসার(ভারপ্রাপ্ত) মো. ইমরানুল হক জানান, এতদাঞ্চলের তাঁতিরা সাধারণত তুলনামূলক মোটা সুতায় তৈরি শাড়ি উৎপাদন করে থাকে। করোনায় ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় এলাকার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিরা প্রতি তাঁতে দৈনিক নূন্যতম এক কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার ৬০০টাকা লোকশান গুনছে।

তিনি তাঁতিদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসকের কাছে তালিকা পাঠিয়েছেন। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ির সুনাম টিকিয়ে রাখতে হলে তাঁতিদের প্রণোদনা দেওয়ার বিকল্প নেই।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno