আজ- ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ বৃহস্পতিবার  দুপুর ২:৪৯

টাঙ্গাইলের অন্ধকূপ নিশ্চিহ্ন ও বধ্যভূমি সংরক্ষণে আগ্রহ নেই

 

বুলবুল মল্লিক:

জেলা সদর পানির ট্যাংকের কাছে জেলা প্রশাসনের ঘের দেওয়া বধ্যভূমি।

জেলা সদর পানির ট্যাংকের কাছে জেলা প্রশাসনের ঘের দেওয়া বধ্যভূমি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশের ন্যায় টাঙ্গাইলেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। পাকিদের বর্বরতায় অসংখ্য বীরমুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যান্য স্থানের মত টাঙ্গাইলেও রয়েছে বেশ কিছু বধ্যভূমি ও গণহত্যা কবলিত স্থান। সেগুলো চিহ্নিত ও সংরক্ষণে সংশ্লিষ্টদের কোন আগ্রহ নেই বলে দাবি স্থানীয়দের।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর টাঙ্গাইল শহরের প্যারাডাইস পাড়া ও কলেজ পাড়ার মধ্যবর্তী স্থানে পাকুটিয়া জমিদারদের জমিদারীর একটি অংশ ছিল। সেখানে অবস্থিত বাড়ির ভবনটি ‘পাকুটিয়া বিল্ডিং’ নামে পরিচিত ছিল। পরে এটি অর্টিজেনদের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। এর বর্তমান নাম আর্টিজেন বিল্ডিং। কথিত আছে ওই বাড়ির ভেতরে একটি কূপ ছিল। জমিদারী আমলে কূপটি বাড়ির প্রয়োজনীয় নানা কাজে ব্যবহৃত হত।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ওই বাড়িটি হয়ে ওঠে বদর বাহিনীর ক্যাম্প। আল-বদর বাহিনীর লোকজন দোর্দন্ড প্রতাপে তাদের কার্যক্রম চালাত ওই বাড়িটিতে বসে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা শহর এবং আশপাশ থেকে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের পরিবারের সদস্যদের ধরে এনে ওখানে বন্দি করে রাখত। পরে তাদেরকে হত্যা করে সেই গভীর কূপে ফেলে দিত ! হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে , গুলি করে, আবার কখনোবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বদর বাহিনীর সদস্যরা অসংখ্য সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ওই কূপে ফেলত! মুক্তিযুদ্ধের সময় যা ‘অন্ধকূপ’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
টাঙ্গাইলে আল-বদর বাহিনীর নিষ্ঠুর, নির্বিচার, নির্মম হত্যাকান্ডের সাক্ষি হয়ে আছে বর্তমান আর্টিজেন বিল্ডিং-এর ওই কূপ। কিন্তু কূপটি তৎকালীন সময়ে ভরাট করে বন্ধ করে দেয় চতুর পাকি সহযোগীরা। ফলে এখন এটি আর বদ্ধভূমি হিসেবে পরিচিত নয়। ইতিহাসের সাক্ষি ওই মৃত্যুকূপটির কথা আজ মানুষ ভুলে গিয়েছে। অস্তিত্ব হারিয়ে সেখানে গড়ে ওঠেছে বসত বাড়ি। বর্তমান প্রজন্মের কাছেও এটি অজানা। কিন্তু সেই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী দু’-চারজন মানুষ আজও ভুলতে পারেনি পাকুটিয়া বিল্ডিং-এর অন্ধকূপের বিভীষিকা। আর্টিজেন অফিসে গড়ে তোলা আল-বদর টর্চার ক্যাম্প ও অন্ধকূপের কথা মুক্তিযোদ্ধা বা স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মীদের মুখে মুখে ওই জল্লাদখানার কথা শোনা গেলেও এখনো স্থানটিকে সরকারিভাবে চিহ্নিত করা হয় নি।
অপরদিকে, রাজাকার-আলবদরদের সহায়তায় টাঙ্গাইল সাকির্ট হাউসে নিরীহ মানুষজনকে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালাত পাক হানাদার বাহিনী। পরে পাশেই পানির ট্যাংকের নিচে ডোবানালায় গণকবর দেয়া হত। এখানে প্রায় পাঁচশ’ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। স্বাধীনতার পর এখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হলেও তা পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায়। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্দিষ্ট একটু জায়গাকে ঘের দিয়ে বধ্যভূমি ঘোষণা করা হয়েছে, একটি ফলক স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বছরের ২৫ মার্চ ও ১৪ ডিসেম্বরের আগে ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ বা পরিচর্যার কোন উদ্যোগ লক্ষ করা যায়না। সারা বছরই আগাছা ঝোপ-ঝাড় আর জঙ্গলে ছেয়ে থাকে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, টাঙ্গাইল শহরের শিবপুর গ্রামের সুশীল কুমার সাহাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৩ নভেম্বর ধরে নিয়ে যায়। এর দুই দিন পরই তাঁকে টাঙ্গাইল জেলা সদর পানির ট্যাংকের পাশে বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় বলে তাঁর পরিবার জানতে পারে।
টাঙ্গাইলের সন্তোষের ইমান আলী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন, ভাগ্যচক্রে বেঁচে আছেন তিনি। তিনি জানান, প্রতিদিন হানাদাররা টাঙ্গাইল ও জামালপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ লোকজনকে ধরে আনত সার্কিট হাউজে। সেখানে রেখে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। প্রতি রাতেই গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের পানির ট্যাংকের পাশে নিয়ে জবাই করে বা গুলি করে হত্যা করা হত।
টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের কমান্ডার খন্দকার জহুরুল হক ডিপটী জানান, তারা বিভিন্ন সময় দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু বধ্যভূমির সে অর্র্থে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের আত্মত্যাগের স্মৃতিচিহ্ন তুলে ধরতে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। কিন্তু এ বিষয়ে কারো কোন ‘আগ্রহ’ আছে বলে মনে হয়না।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন জানান, বধ্যভূমিটি এক সময় অত্যন্ত অবহেলায় ছিল। তিনি জানতে পেরে একটি নামফলক ও কিছু জায়গা ঘের দিয়ে চিহ্নিত করেছেন। এটি সংরক্ষণে ভবিষ্যত পরিকল্পনা রয়েছে।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও টাঙ্গাইল শহরের কলেজ পাড়ায় আর্টিজেন অফিসের আল-বদরদের টর্চারসেল ক্যাম্প(অন্ধকূপ) এখনও চিহ্নিত করা হয়নি। জেলা সদর পানির ট্যাংকের বধ্যভূমি এলাকা আজও সে অর্থে সংরক্ষণ করা হয়নি। নতুন প্রজন্মের কাছে ওই টর্চার সেল এখনও অজানা। মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়দের দাবি জেলার সব বধ্যভূমি জরুরি সংরক্ষণের।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno