আজ- ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার  রাত ৮:৪০

টাঙ্গাইলের বিল-ঝিলে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে পরিযায়ী পাখি

 

বুলবুল মল্লিক:

টাঙ্গাইল জেলার বিল-ঝিলে সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে পরিযায়ী পাখি। প্রতি বছর শীতের আগমণ শুরু হলেই পরিযায়ী পাখিরাও ষড়ঋতুর এ দেশে আসতে শুরু করে। দূর দেশ থেকে কিছুটা সুবিধাজনক আশ্রয় ও খাদ্যের আশায় তারা বিল-ঝিলে চলে আসে।

যেসব দেশে শীতের তীব্রতা বেশি হওয়ায় ঠান্ডায় পাখিগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে, খাবার ও বাসা বাঁধার জায়গা না পেয়ে এ দেশে চলে আসে।

শীত মৌসুমে ওরা এলে নানা ঢংয়ের ডাক ও সরবতায় বিল-ঝিলের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। এবারও এসেছে পরিযায়ী পাখিরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় পাঁচ শতাধিক বিল বা জলাশয় রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে- হালদা বিল, চাপড়া বিল, ধন্দা বিল, ভাড়া বিল, বাসুলিয়া বিল, চারান বিল, পোষণা বিল, শুটকী বিল, পদ্মকুঁড়ি বিল, সাতবিল, বংশাল বিল, কয়ড়া

বিল, আঠারচূঁড়া বিল, মাহান্দি বিল, চাটাই বিল, বারকাটি বিল, পদ্মবিল, দেও বিল, কষ্টাপাড়া বিল, বাইশা বিল, বার্থা বিল, বেথইর বিল, উত্তর বিল, কাতুলীর বিল(আজম মারা বিল), ডগা বিল, কারাইল বিল, সিংনা বিল ইত্যাদি।

ভিন দেশ থেকে এসব বিল, দিঘী বা জলাশয়ে এসে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি খাবার খাচ্ছে, নানা ঢং বা স্বরের কিচিরমিচিরে নিজেদের সরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। পাশের গাছ-গাছালিতে রাতে আরামে বাস করছে।

পাখি বিশারদদের কাছ থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখি রয়েছে। এদের মধ্যে এক হাজার ৮৫৫টি প্রজাতির পাখিকে পরিযায়ী পাখি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সূত্রমতে, বছরে দু’বার মোট ৩১৬ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এ ব-দ্বীপে আসে। এরমধ্যে ২৯০ প্রজাতির পাখি শীতকাল ও ২৬ প্রজাতির পাখি বাকি সময়কালে আসা-যাওয়া করে। অক্টোবরের শেষ ও নভেম্বর থেকে শীতকালের পরিযায়ী পাখির আসা শুরু হয় এবং মার্চ মাসে তারা চলে যায়। অর্থাৎ শীতকালে আসে বসন্তকালে বিদায় নেয়।

অপর সূত্রমতে, দেশের প্রায় ৬২৮ প্রজাতির পাখির মধ্যে ২৪৪ প্রজাতির পাখিই স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বাস করে না। ওরা এ দেশের পরিযায়ী পাখি বা অতিথি পাখি।

উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের পাখির তালিকায় মোট ৭৪৪টি পাখি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব পাখির মধ্যে গত দুই শতকে বাংলাদেশে ছিল (কিন্তু এখন নেই) এবং বর্তমানে আছে এমন পাখিও অন্তর্ভুুক্ত।

এমন পাখির সংখ্যা মোট ৬৫০টি। এ ধরণের ৬৫০টি পাখির প্রজাতির মধ্যে ৩০টি বাংলাদেশে বর্তমানে বিলুপ্ত। ওই ৩০টি প্রজাতি পাখির মধ্যে ২৯টি অন্য দেশে পাওয়া গেলেও ‘গোলাপীশির হাঁস’ নামে একটি পাখি সম্ভবত সারা পৃথিবীতেই বিলুপ্ত। অবশিষ্ট ৬২০টি প্রজাতির পাখি সাম্প্রতিককালে এদেশে দেখা গেছে এবং ওরা বাংলাদেশে থাকে বা আসে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এই ৬২০টি প্রজাতির মধ্যে ১৪৩টি প্রজাতির পাখি কালেভদ্রে দেখা পাওয়া যায় বলে বাংলাদেশে এদেরকে ‘অনিয়মিত’ আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাকি ৪৭৭ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে নিয়মিত দেখা যায়। এই ৪৭৭ প্রজাতির মধ্যে ৩০১টি বাংলাদেশের ‘আবাসিক’ পাখি- যেগুলো স্থায়ীভাবে এ দেশে বাস করে।

বাকি ১৭৬টি বাংলাদেশের ‘পরিযায়ী’ পাখি- যেগুলো খন্ডকালের জন্য নিয়মিতভাবে এ দেশে থাকে। এই ১৭৬ প্রজাতির নিয়মিত আগন্তুকের মধ্যে ১৬০টি পাখি শীতে এবং ৬টি গ্রীষ্মে বাংলাদেশে থাকে; বাকি ১০টি পাখি বসন্তে এদেশে থাকে- যাদেরকে ‘পান্থ-পরিযায়ী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

শীতকালের পরিযায়ী পাখির মধ্যে গাঙচিল, নীলশির, লালশির, কালো হাঁস, হাঁস, রাজহাঁস, কালেম, ডাহুক, ছোট সরালি, খঞ্জনা, চটক, মাঠ চড়াই, কসাই পাখি, লেঞ্জা হাঁস, ক্ষুদে গাঙচিল, কুন্তিহাঁস, জিরিয়া, চোখাচখি পাখি, বালিহাঁস, বড় সরালি, কানিবক, জলময়ূর,

চিতি হাঁস, বারো ভূতি হাঁস, ডুবুরি, কোপাডুবুরি, পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, বড় পানকৌড়ি, কালো কুট, কাদা খোঁচা বা চ্যাগা, জালের কাদাখোঁচা, ছোট জিরিয়া, বাটান, গঙ্গা কবুতর, রাজ সরালি, পিন্টেল, পাতি সরালি, সাদা বক, দলপিপি, পানমুরগি,

কাস্তেচড়া, বেগুনি কালেম, ঈগল, পিয়াং হাঁস, ভূতিহাঁস, ধুল জিরিয়া, পাতারি হাঁস, ধূসর রাজহাঁস, বৌমুনিয়া হাঁস ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।

পাখি বিশারদরা মনে করেন, সারাবছর দেখা যায় না বলে অনেকে পরিযায়ী পাখিদের ‘অতিথি পাখি’ বলে থাকেন। এ ধারণাটা সঠিক নয়। এ পাখিগুলো মোটেই অতিথি নয়, এরা আমাদের দেশেরই পাখি। পরিযায়ী পাখিগুলো প্রধানত উত্তরের দেশগুলো থেকে আসে।

বিশেষ করে হিমালয়, নেপাল, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীনের জিনজিয়ান, ইউরোপ, রাশিয়া ইত্যাদি অঞ্চল যখন শীতের দাপটে বরফে ঢেকে যায় তখন সেখান থেকে পাখিগুলো উড়াল দেয়।

পাখিগুলো প্রকৃতিগতভাবে জানে কখন ওদের কোন দেশে আশ্রয় নিতে হবে। এজন্য আসার আগে ওরা পাখার নিচে বেশি চর্বি জমা করে রাখে। সেই সঞ্চিত চর্বির শক্তিতে ওরা হাজার হাজার কিলোমিটার পথ দিনের পর দিন- মাসের পর মাস উড়ে চলে। সাধারণত ওরা দলবেঁধে পরিযায়ন করে।

যেখানে ওরা একবার যায়, সাধারণত সেসব জায়গায়ই পরের বছরগুলোতেও যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে সবসময় একই পাখি হয়তো আসে না। তবে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অবশ্যই পূর্ব অভিজ্ঞ পাখি থাকে- যারা ওড়ার সময় ঝাঁকের সামনে থাকে ও পথের নির্দেশ দেয়।

যাত্রাপথের আকাশ, নক্ষত্র, পাহাড়, নদ-নদী, জলভূমি, অরণ্য ইত্যাদি ওরা চিনে রাখে এবং এসবের সাহায্যে ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছে যায়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া পাখিগুলো একটু উষ্ণতা, খাদ্য এবং আশ্রয়ের আশায় আমাদের দেশের বিভিন্ন বন-জঙ্গল, হাওর, বাঁওর, খাল, নদী, চর, বিল, পুকুর-দিঘী, জলাশয়ে এসে সমবেত হয়।

টাঙ্গাইলের বিভিন্ন বিল-ঝিল, বন-জঙ্গল, চর-দিঘী বা পুকুর-জলাশয়ে আসা পরিযায়ী পাখিগুলো দেখতে স্থানীয় লোকজন সকাল-বিকাল ভির করছেন। ওদের দেখলেই মন ভরে যায়।

সবগুলো পরিযায়ী পাখিই দেখতে অসম্ভব সুন্দর- খুবই সুন্দর বাহারি ওদের গায়ের রং। এ পাখিরা সবাই একসঙ্গে জটলা বেঁধে থাকে। কোনটা পাখা ঝাঁপটায়- কোনটা কিচিরমিচির স্বরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে আবার কোনটা পানিতে দাপাদাপি করে- সে এক অদ্ভুত মনকাড়া সুন্দর দৃশ্য।

টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মুজাহিদুল ইসলাম জানান, পরিযায়ী পাখি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া জীবন-জীবিকা ও বংশ বিস্তারের প্রয়োজনে তারা মরু অঞ্চল থেকে নিরাপত্তার জন্য আমাদের দেশে আসে।

পরিযায়ী বা অতিথি পাখি শিকার বন্ধে আইন রয়েছে। পরিযায়ী পাখি শিকার করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। পাখির নিরাপদ আবাস তৈরি করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রফেসর ড. এএসএম সাইফুল্লাহ জানান, প্রকৃতার্থে পরিযায়ী পাখিদের অতিথি পাখি বলা যায়না।

পাখিরা সাধারণত মুক্ত-স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকে। তারা সুবিধামত জায়গায় গিয়ে বসবাস করতে ভালোবাসে। সেখানে তারা বাসা বাঁধে, ডিম দেয়, ডিম ফোঁটার পর বাচ্চা নিয়ে আবার অন্যত্র চলে যায়।

তবে পরিযায়ী পাখিগুলোর দৃষ্টি ও স্মরণ শক্তি প্রসংশার দাবি রাখে। ওরা যেখান দিয়ে যায়- সে জায়গাগুলো চিনে রাখে। পরের বছর বন্ধুদের সাথে নিয়ে আবার সেখানে আসে।

তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন হাওর-বাওর-জলাশয়ের মতো টাঙ্গাইলের বিভিন্ন জলাশয়েও তাদেরকে দেখা যায়। সন্তোষে অবস্থিত দিঘীতেও একটি দল গত বছর এসেছিল। এবার এখনও আসেনি, তবে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি আরও জানান, কিছু দুষ্ট লোকের লোভাতুর দৃষ্টির কারণে পরিযায়ী পাখি তাদের শিকারে পরিণত হয়।

পরিযায়ী পাখি আমাদের পরিবেশের উপকারী বন্ধু। এদের আসা-যাওয়া ও বসবাস নিরাপদ রাখার বিষয়ে সবারই বিশেষ নজর রাখা উচিত।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno