আজ- ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  দুপুর ২:৩২

টাঙ্গাইলের ১৪৮ অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ হয়নি

 

বুলবুল মল্লিক:

উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও টাঙ্গাইলের ১৪৮টি অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। উপরন্তু ইটভাটায় জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহকৃত কাঠ। মৌসুম শুরু হওয়ায় এরই মধ্যে অধিকাংশ অবৈধ ভাটায় ইট প্রস্তুতের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।


ইতোপূর্বে টাঙ্গাইল, বগুড়া, লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও জেলার অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম সাত দিনের মধ্যে বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।

নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট চার জেলা প্রশাসককে দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও প্রক্রিয়াগতভাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় লিখিত নির্দেশনা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৭ নভেম্বর এ সংক্রান্ত রুলের বিষয়ে আদেশ দেন।


জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ১২টি উপজেলার ২৮২টি ইটভাটার মধ্যে ১৩৪টি বৈধ এবং ১৪৮টি অবৈধভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। এরমধ্যে মির্জাপুরে ২৯টি, ধনবাড়ীতে ১৭টি, মধুপুরে ১৮টি, ঘাটাইলে ৪৪টি, কালিহাতীতে ১১টি, সখীপুরে ৪টি, গোপালপুরে ৩টি, দেলদুয়ারে একটি, ভূঞাপুরে ৫টি, নাগরপুরে ৮টি, সদর উপজেলায় ২টি ও বাসাইলে ৬টি ইটভাটা অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ওইসব ইটভাটার কোনটিরই লাইসেন্স ও ছাড়পত্র নেই।

জেলার ১২৩টি ইটভাটা হাইকোর্টে রিট করে শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি নিয়ে চালানো হচ্ছে। হাইকোর্টের দেওয়া শর্তগুলো কাগজেই বন্দি থাকছে- বাস্তবে কোন ভাটাই তা মানছেনা।


সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা লিখিত আকারে না পাওয়ায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগে মির্জাপুর উপজেলার ৯টি অবৈধ ইটভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হয়েছে।

অভিযানকালে ৯টি অবৈধ ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে এক কোটি ১৮ লাখ টাকা জরিমানা আদায় এবং ভাটার কিলন ভাঙচুর ও দুই লাখ কাঁচা ইট পানি দিয়ে নষ্ট করা হয়। বুধবার(৩০ নভেম্বর) পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়জুন্নেছা আক্তারের নেতৃত্বে মির্জাপুরের আজগানা ইউনিয়নে ওই অভিযান পরিচালনা করা হয়।


এ সময় মেসার্স নিউসান নামীয় ইটভাটকে ২০ লাখ, মেসার্স জেএমবিকে ২০ লাখ, মেসার্স এইচবিএমকে ২০ লাখ, মেসার্স নিউ এমবিএমকে ২০ লাখ, মেসার্স নিউ দেওয়ানকে ২০ লাখ, মেসার্স এমআরবিকে ৫ লাখ, মেসার্স হাজী আনছার আলীকে ৫ লাখ, মেসার্স জেএসবিকে ৫ লাখ ও মেসার্স ভাই ভাই এণ্টারপ্রাইজ নামক ইটভাটাকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া ৯টি ইটভাটায় ভেকু মেশিন(মাটি কাটার যন্ত্র) দিয়ে ভাটার কিলন ভাঙচুর ও পানি দিয়ে কাঁচা ইট নষ্ট করা হয়।


এদিকে, টাঙ্গাইলের ১৪৮টি লাইসেন্স ও ছাড়পত্র বিহীন অবৈধ ভাটায় ইটভাটা স্থাপন-প্রস্তুত ও পরিচালনায় সরকারি নির্দেশনা না মেনে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাঠ পোড়ানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রায় সব ইটভাটাই স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির ও ফসলি জমি ঘেষে স্থাপন করা হয়েছে।

অধিকাংশ ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো শুরু করা হয়েছে। ফলে টাঙ্গাইলের পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। ভুক্তভোগী এবং পরিবেশবাদীরা পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়ে বরাবরের মতো প্রশ্ন তুলেছেন। তারা আরও জোরালো পদক্ষেপের দাবি জানান।

smartcapture

অভিযোগ রয়েছে- বিভিন্ন অজুহাতে ইটভাটাগুলো থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। ইটভাটার ছাড়পত্র পেতেও সীমাহীন হয়রানির শিকার হতে হয়।


সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার নাগরপুর উপজেলার বেকড়া ইউনিয়নের ভালকুটিয়ার এমএমকে এমটি ব্রিকসে ইট পোড়ানোর জন্য বিপুল পরিমাণ কাঠ সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। ধনবাড়ী উপজেলার যদুনাথপুর ইউনিয়নের জাগিরাচালা গ্রামের মেসার্স যমুনা ব্রিকসে কাঠ পোড়ানো শুরু করে দিয়েছে।

কালিহাতী উপজেলার মেসার্স স্বর্ণা ব্রিকস ও মেসার্স ফাইভ স্টার ব্রিকস; ভূঞাপুরের মেসার্স মিশাল ব্রিকস ও আঁখি ব্রিকস; ঘাটাইলের মেসার্স সচল ব্রিকস, মেসার্স আদর্শ ব্রিকস, মেসার্স হাসান ব্রিকস সহ বিভিন্ন ভাটায় বনের কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ইটভাটার শ্রমিকরা মাটি দলাই-মাড়াই করে ইট বানাচ্ছেন। বনাঞ্চল ঘেষা মধুপুর, ঘাটাইল, কালিহাতী, মির্জাপুর ও ধনবাড়ীর প্রায় সব ভাটাগুলোতেই কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল কাছে হওয়ায় কাঠের সহজলভ্যতার সুযোগ ইটভাটাগুলো পুরোপুরিই নিচ্ছে।

এছাড়া পাহাড়-টিলা এবং নদী ও বিল-ঝিলের পাশের ফলসি জমির উপরের মাটি(টপ সয়েল) এক শ্রেণির মধ্যস্বত্তভোগীদের সহায়তায় ইটভাটায় যাচ্ছে। অনেকে অতিলোভের আশায় জমির উপরের মাটি(টপ সয়েল) ইটভাটা মালিকদের কাছে বিক্রি করছেন।


ধনবাড়ীর মেসার্স যমুনা ব্রিকসের মালিক আমির হোসেন জানান, ভালো ইট তৈরিতে কয়লার বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমানে কয়লার সংকট ও দাম বেশি হওয়ায় তারা কাঠ পুড়িয়ে ইট বানাচ্ছেন। বনাঞ্চলের দরপত্র হওয়া বাগান ও স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে তারা কাঠ সংগ্রহ করে থাকেন। এছাড়া কাঠের যোগান দেওয়ার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের পাইকাররা রয়েছেন, তারা চাহিদানুযায়ী কাঠ সরবরাহ করে থাকেন।


তিনি জানান, তার উপজেলার অধিকাংশ ইটভাটার লাইসেন্স নাই- প্রায় সব ইটভাটায়ই কাঠ পোড়ানো হয়। তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে ইটভাটা চালাচ্ছেন। ছাড়পত্র নবায়ন না হওয়ায় হাইকোর্টে রিটের মাধ্যমে শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি নিয়ে দীর্ঘ ৭ বছর ধরে ভাটা চালাচ্ছেন।


টাঙ্গাইল জেলা ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ হায়দার খান জানান, ইটভাটায় তারা বনের কাঠ পোড়ান না। ভাটায় প্রথম চুলা জ¦ালাতে কয়েক হাজার মন কাঠ দিয়ে আগুন লাগাতে হয়। অন্য সময় কয়লা দিয়েই ইট পোড়ানো হয়।

বর্তমানে কয়লার সংকট ও দাম বেশি হওয়ায় কয়লার সহজলভ্যতা এবং লাইসেন্সপ্রাপ্তির শর্তগুলো সহজতর করার দাবিতে তারা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন।


পরিবেশবাদী গবেষক সোমনাথ লাহিড়ী জানান, বনাঞ্চলের ৩ কিলোমিটার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। জেলার ইটভাটগুলো স্থাপনে সে নিয়ম মানা হয়নি। প্রায় সব ভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়।

মধুপুর, ঘাটাইল, কালিহাতী, ধনবাড়ী ও মির্জাপুরে এর পরিমাণ বেশি। ফলে বনাঞ্চলের উপর চাপ পড়ছে, দিন দিন বন উজার হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হলেও ইটভাটা মালিকরা তা মানে না। নিজের স্বার্থে দেশের কি হলো সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য নয়।


টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন ডা. মিনহাজ উদ্দিন মিয়া জানান, নিয়ম না মেনে ইটভাটা স্থাপন ও পরিচালনার জন্য আশপাশের বসতি ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। ভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় তারা চোখ, ত্বক ও ফুসফুসের কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। যথাযথ দূরত্ব মেনে ইটভাটা স্থাপন ও পরিবেশ রক্ষার্থে প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।


টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান জানান, প্রাথমিকভাবে ইটভাটায় আগুন লাগানোর জন্য কাঠ পোড়ানো হয়। এগুলো দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। এছাড়া বন বিভাগে লোকবল কম থাকায় সব সময় সব জায়গায় পাহাড়া দেওয়া বনরক্ষীদের জন্য কষ্টকর। সে সুযোগে কাঠচোররা অনেক সময় তৎপর হয়ে ওঠে। তবে তারা আগের তুলনায় টহল বাড়িয়েছেন ও চেকপোস্টের মাধ্যমে বনের কাঠ সরবরাহে কঠোর নজরদারী করছেন।


টাঙ্গাইল জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন জানান, ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ, কয়লার ব্যবহার করতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনার লিখিত আদেশ তারা এখনও পাননি। তবে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে তারা ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করছেন। গত মৌসুমে ৬৭টি ইটভাটায় এক কোটি ৭১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

এ বছর মৌসুমের শুরুতেই মির্জাপুরের ৯টি ইটভাটাকে এক কোটি ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধ ইটভাটাগুলোয় তৈরিকৃত কাঁচা ইট পানি দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। অনেক ভাটার লাইসেন্স নবায়ন না থাকলেও হাইকোর্টে মামলা চলমান থাকায় সেগুলো চালু রয়েছে।


টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ডক্টর মো. আতাউল গনি জানান, জেলার ইটভাটাগুলো সাধারণত পরিবেশ অধিদপ্তর দেখভাল করে থাকে। তারা চাইলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়া হয়। হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা তিনি পত্র-পত্রিকায় দেখেছেন। এখনও লিখিত কোন আদেশের কপি পাননি। পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno