আজ- ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার  রাত ৮:৪৫

টাঙ্গাইলে নিষিদ্ধ অনলাইন স্ক্যামিংয়ের ভয়াল থাবা!

 

বুলবুল মল্লিক:

টাঙ্গাইলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে নিষিদ্ধ অনলাইন স্ক্যামিং ব্যবসার ভয়াল থাবা করোনা ভাইরাসের মতো দিন দিন ছড়াচ্ছে। জেলার ঘাটাইল, গোপালপুর, ধনবাড়ী, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলায় এই স্ক্যামিং ব্যবসা ছড়িয়ে পড়লেও মধুপুর উপজেলা এখন স্ক্যামারদের স্বর্গরাজ্য। এসব সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রকে সামলাতে স্থানীয় প্রশাসনও রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে দেশে যেমন রেমিট্যান্স আসে- তেমনি লাখো যুবকের কর্মসংস্থান হয়। তাই সরকার এ বৈধ পেশাকে নানাভাবে উৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু স্ক্যামিং অনলাইনে একটি প্রতারণামূলক নিষিদ্ধ(অবৈধ) ব্যবসা।

টিনএজার পর্ণো, অ্যাডাল্ট সাইট এবং ডেটিং সাইট নিয়ে স্ক্যামাররা কাজ করে থাকে। এটা এক ধরনের অন্ধকার জগতের ব্যবসা। এ পেশায় যৌনতা নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে স্ক্যামারদের নেট ব্যবসায়ী বলা হয়।

দুই বছর আগে যারা রিকশা চালাতেন, ইটভাটায় কাজ করতেন, তার এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা এখন নিজেদের বহুতল ভবনে বসবাস করেন। দামি গাড়িতে চড়েন। অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শোরুম ও কারখানা গড়ে তুলেছেন।


একাধিক আইটি বিশেষজ্ঞের মতে, স্ক্যামাররা সাধারণত আমেরিকান মডেল, পর্ণোস্টার বা এসকর্টদের নগ্ন ছবি, ভিডিও বা নানা তথ্য ওয়েবসাইট থেকে কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে অ্যাডাল্ট ডেটিং সাইটে আইপি হাইড করে পোস্ট দেয়। এরপর টেক্সট নাউ নামের ভার্চুয়াল নম্বর সার্ভিসের মাধ্যমে স্ক্যামাররা এসকর্ট সেজে হাজির হয়। যাদের এসকর্ট সার্ভিস দরকার সেই গ্রাহকরা নক করলে এসকর্ট সাজা স্ক্যামাররা ব্যক্তিগত সময় কাটানোর জন্য গ্রাহকের সঙ্গে ডলার নিয়ে দর কষাকষি শুরু করে।

নগ্ন ছবি ও ভিডিও শেয়ারের পরেও অনেক গ্রাহক ভিডিও বা ভয়েস কলে রিয়েল পার্সন ভেরিফাই করতে চায়। রোবট সফটওয়্যার দিয়ে ভয়েস বা ভিডিও কল ভেরিফিকেশনেও গ্রাহকরা সন্তুষ্ট না হলে স্ক্যামাররা ভাড়াটে নারীদের হাজির করে। এসব নারীরা স্বল্প আলোতে ন্যুড হয়ে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করে। এরপর গ্রাহকের কাছ থেকে কিছু ডলার অ্যাডভান্স নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

স্ক্যামাররা এসব ডলার বিভিন্ন ক্যাশ অ্যাপ, কার্ড বা বিট কয়েনের মাধ্যমে রিসিভ করে। এরপর বিশেষ কায়দায় ডিজিটাল পেমেন্ট সার্ভিসের অ্যাকাউন্ট খুলে ডলার বিট কয়েনে কনভার্ট করে বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তর করে।


মধুপুর উপজেলায় প্রায় পাঁচ হাজার কিশোর ও তরুণ নিষিদ্ধ অনলাইন স্ক্যামিংয়ে জড়িত। সাইবার অপরাধের মাধ্যমে ডলার কামানোর ধান্ধায় এখন স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা এমনকি গৃহবধূরা বিশেষ করে প্রবাসীদের বধূরা এতে যুক্ত হচ্ছেন। এই স্ক্যামিং যেমন নব্য ধনকুবের তৈরি করছে- তেমনি মাদক ও জুয়াসহ নানা সামাজিক ব্যাধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।


মধুপুরের একজন স্ক্যামার জানান, অভিজ্ঞ স্ক্যামাররা গ্রাহকদের সঙ্গে চ্যাট করে ব্যক্তিগত তথ্য, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, এসএসএস উইথ সেলফি সংগ্রহের পর বিশেষ কায়দায় গ্রাহকের ক্রেডিট কার্ডের সমুদয় ডলার হাতিয়ে নেয়।


রনি সরকার নামে এক স্ক্যামার জানান, ডেটিং স্ক্যাম ছাড়াও স্ক্যামাররা আমেরিকায় সম্পত্তি কেনা-বেচা, বাড়ি ভাড়া বা রিয়েল এস্টেট সাইটে গিয়ে ক্রেগলিস্ট অর্গানাইজেশনের আইপি হাইড করে লোভনীয় তথ্যে পোস্ট দেয়। একই কায়দায় অ্যাডভান্স ডলার নিয়ে তারা কেটে পড়ে। আমেরিকার জনপ্রিয় ক্লাসিফায়েড সাইট ব্যাকপেইজ ডটকমের আদলে মধুপুরের স্ক্যামাররা ক্লাসিফায়েড ডেটিং সাইট তৈরি করে প্রতারণামূলকভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।


তিনি জানান, টু ব্যাকপেইজ ডটকম, ব্যাকলিস্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং স্কিপ দ্য গেইমস ডটকম নামের সাইটগুলোর মালিক মধুপুরের কয়েকজন স্ক্যামার। তারা এখন শত কোটি টাকার মালিক।


সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসন মধুপুর পৌরসভার নয়াপাড়া ও মাস্টারপাড়া মহল্লায় অভিযান চালিয়ে পর্ণো ও ডেটিং সাইট ব্যবহারের মাধ্যমে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে একজন স্ক্যামারকে ১২ লাখ টাকা আয় করার প্রমাণ পান।
মধুপুরের একটি বেসরকারি আর্কিটেক্ট কনসালটেন্টের তথ্যে দেখা যায়, দেড় বছরে মধুপুর উপজেলায় তিন শতাধিক বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে- যার প্রায় সবগুলোই স্ক্যামিং পার্টির।


মধুপুরের ফ্রিল্যান্সার ও ওয়েব ডেভেলপার সবুজ মিয়া জানান, তার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা ফাইভার থেকে ভালো আয় করছিলেন তারাও কু-মতলবে স্ক্যামিংয়ে চলে যাওয়ায় তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।


মধুপুরের নকরেক আইটির মালিক সুবীর নকরেক জানান, যেখানে বৈধ ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে প্রচুর আয় করা যায়, সেখানে স্ক্যামিংয়ের মতো প্রতারণামূলক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। এতে দেশের ইমেজ ক্ষুন্ন হচ্ছে। এর একটি নেগেটিভ রেজাল্ট শিগগিরই আসবে।


শোলাকুড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ইয়াকুব আলী জানান, অনলাইন স্ক্যামিংয়ের টাকা এখন হাওয়ায় উড়ছে। এক শ্রেণির কিশোর ও যুবকের হাতে অঢেল অর্থ আসায় স্থানীয় পর্যায়ে মাদক ও জুয়াসহ নানা অসামাজিক কাজ বেড়ে গেছে। ফলে সমাজে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে।


মধুপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মুরাদ হোসেন জানান, অল্প সময়ে অধিক টাকার নেশায় মধুপুরে স্ক্যামারদের সংখ্যা বাড়ছে। তবে এসব অবৈধ কর্মকান্ড বন্ধে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।


মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শামীমা ইয়াসমিন পরিস্থিতির সত্যতা স্বীকার করে জানান, অবৈধ স্ক্যামিং ব্যবসার কাঁচা টাকা ভয়াবহ মাদকের প্রসার ঘটাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে না গিয়ে প্রতারণা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে ৬ জন স্ক্যামারকে আটক করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। কিছু ভবন সিলগালা এবং স্ক্যামারদের যেন বাড়ি ভাড়া দেওয়া না হয়- সেজন্য অনেক ভবন মালিককে সতর্ক করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno