আজ- ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার  বিকাল ৫:৪৬

ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বে চালক পেছনে তাকানোয় বাস উল্টে যায়

 

বুলবুল মল্লিক:

কুষ্টিয়া থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাওয়ার পথে ঈগল পরিবহণের বাসে ডাকাতি ও যৌন নিগ্রহের পর লুন্ঠিত টাকা এবং মুঠোফোনসহ অনান্য মালামাল ডাকাতরা বাসের ভেতরেই ভাগবাটোয়ারা করে। ওই সময় এক যাত্রীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ২০ হাজার টাকা নিয়ে ডাকাত দলের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

ডাকাতরা একজন অন্যজনের দেহ তল্লাশি শুরু করেন। এক পর্যায়ে বাসের চালকের আসনে থাকা ডাকাত নিজেদের মধ্যে কথাকাটাকাটি দেখার জন্য পেছনে তাকান। এতে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে বাসটি টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়কে মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়ায় রাস্তার পাশে বালির স্তুপের মধ্যে কাত হয়ে পড়ে যায়।


পুলিশের রিমান্ডে থাকা গ্রেপ্তারকৃত রাজা মিয়া এবং গ্রেপ্তার হওয়া আব্দুল আওয়াল ও নুরুন্নবী দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।


ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত তিন জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালের বিচারক সামছুল আলম ও রুমি খাতুন পৃথকভাবে তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।


পুলিশ সূত্র জানায়, চাঞ্চল্যকর মামলাটি দায়ের করার পর থেকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আসামিদের চিহ্নিত করে। পরে বৃহস্পতিবার(৪ আগস্ট) রাজা মিয়া নামে ডাকাত দলের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। রাজা ডাকাতির সময় চালককে সরিয়ে বাসটি চালাচ্ছিলেন। রাজা মিয়াকে আদালতে হাজির করে পুলিশ ৭দিনের রিমা- আবেদন করলে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তিনি দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ায় রিমান্ডের দুই দিনেই রাজা মিয়াকে আদালতে হাজির করা হয়।


এদিকে একই ঘটনায় শুক্রবার(৫ আগস্ট) গাজীপুরের কালিয়াকৈর থেকে আব্দুল আওয়াল ও নুরুন্নবীকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাদেরক শনিবার(৬ আগস্ট) টাঙ্গাইলের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে তারা দ-বিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।


আদালতের পুলিশ পরিদর্শক তানভীর আহমেদ জানান, টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সামছুল আলম গ্রেপ্তারকৃত রাজা মিয়া ও নুরুন্নবীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এবং সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রুমি খাতুন আব্দুল আওয়ালের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

এরআগে বুধবার(৩ আগস্ট) মধুপুর থানায় ডাকাতি ও দল বেঁধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগে বাসের যাত্রী হেকমত আলী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। তখন মধুপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুরাদ হোসেনকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে চাঞ্চল্যকর বিবেচনায় বৃহস্পতিবার(৪ আগস্ট) রাতেই জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি-উত্তর) অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মো. হেলাল উদ্দিনকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।


আদালত ও পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, স্বেচ্ছায় সীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে গ্রেপ্তারকৃতরা ঘটনার সাথে তাদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বর্ণনা দিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন- বাসটি ঢাকার দিকে মির্জাপুরের গোড়াই পর্যন্ত গিয়ে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে ইউটার্ন নিয়ে আবার টাঙ্গাইলের দিকে যাত্রা শুরু করে। আসামি রাজা মিয়া ঈগল পরিবহণের বাসটি শুধু চালিয়েছেন, তা নয়- তিনি ডাকাতি ও যৌন নিগ্রহ উভয় অপরাধেই অংশ নিয়েছেন।

আসামি মো. আব্দুল আওয়াল ও নুরুন্নবী শুধু লুট করায় অংশ নিয়েছেন। শনিবার (৬ আগস্ট) সন্ধ্যায় আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব অপরাধের কথা তারা স্বীকার করেন। জবানবন্দি শেষে তিনজনকেই রাত সাড়ে ৮টায় জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। জবানবন্দিতে তারা ডাকাতি ও যৌন নিগ্রহের ঘটনার পুরো বিবরণ এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের নাম প্রকাশ করেছেন।


জবানবন্দিতে তারা জানান, এক পর্যায়ে লুন্ঠিত টাকা ও মুঠোফোনের সংখ্যা নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এক সদস্য ২০ হাজার টাকা এক যাত্রীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন এবং ওই টাকা লুকিয়ে ফেলেন বলে কয়েক ডাকাত অভিযোগ করেন। পরে একজন অন্যজনের দেহ তল্লাশি শুরু করেন।

এসময় বাসের চালকের আসনে গ্রেপ্তারকৃৃত রাজা মিয়া ছিলেন না- ডাকাত দলের আরেক সদস্য বাস চালাচ্ছিলেন। তিনি পেছন দিকে তাকিয়ে ভালো করে তল্লাশি করার জন্য নির্দেশনা দিচ্ছিলেন- এসময় বাসটি রাস্তার পাশে কাত হয়ে যায়।


পরে ডাকাত দলের সবাই জানালা দিয়ে দ্রুত বের হয়ে পড়েন। তারা রক্তিপাড়া থেকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে মধুপুরের দিকে দৌঁড়াতে থাকেন। প্রায় এক কিলোমিটার যাওয়ার পর একটি বাস এলে সেটি সংকেত দিয়ে থামান। সেখান থেকে প্র্রথমে তিনজন ওই বাসে উঠেন।

কিছু দূর যাওয়ার পর এগিয়ে থাকা অন্য সদস্যরা ওই বাসটিতে উঠেন। তারা নিজেদের পরিবহণ শ্রমিক বলে পরিচয় দেন। দুর্ঘটনা কবলিত বাসটির শ্রমিক বলেও তারা জানান। ওই বাসে মধুপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে নেমে পড়েন ডাকাতরা। পরে ব্যাটারী চালিত অটোরিক্সা নিয়ে ডাকাত দলের এক সদস্যের আত্মীয় বাড়ি গিয়ে উঠেন তারা। বেলা উঠার পর এক এক করে তারা ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যান।


ডাকাতিকালে তারা পাঁচটি স্মার্ট মুঠোফোন সেট, ১২-১৩টি বাটনফোন এবং তিন হাজার ৪০০ টাকা লুট করেন। যে ২০ হাজার টাকা নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়- সে টাকা তারা শেষ পর্যন্ত আর উদ্ধার করতে পারেননি।


মামলার বাদী কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার সালিমপুর এলাকার ফল ব্যবসায়ী হেকমত আলী জানান, তিনি স্ত্রী, দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে ওই বাসে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। যৌন নিগ্রহের শিকার নারীটি ছিলেন তার সিটের দুই সারি পেছনে বসেছিলেন। বাসের সর্বশেষের সারিতে তিনি একাই বসেছিলেন। তার পাশে দুর্বৃত্তদের দুই তরুণ গিয়ে বসেন। ডাকাতির সময় পুরুষ যাত্রীদের হাত, মুখ ও পা বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়।

ওই নারীটির সঙ্গে পাশে বসা দুই তরুণের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে কয়েকজন মিলে নারীটিকে যৌন নিগ্রহ করেন। মেয়েটির মুখে কাপড় গোঁজা ছিল। তার গোঙানির শব্দ আসছিল। কিন্তু কেউ তাকে রক্ষার জন্য এগিয়ে যেতে পারেননি। যদি কেউ কোনো শব্দ করছিলেন- সঙ্গে সঙ্গে তাকে আঘাত করা হচ্ছিল। এক যাত্রী ৯৯৯-এ কল করতে গেলে তাকে ছুরি দিয়ে পোচ দেওয়া হয়। ওই যাত্রীর শরীর থেকে রক্ত বের হয়। এরপর ভয়ে কেউ কোনো শব্দ করেননি।


মামলার বাদী ওই বাসের যাত্রী হেকমত আলীর স্ত্রী জেসমিন আরা জানান, এক সন্তানকে বুকে জড়িয়ে তিনি মাথা নিচু করে সৃষ্টিকর্তার নাম নিচ্ছিলেন। সামনে আরেক সিটে তার মা অপর সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন। তার হাত, চোখ, মুখ বাঁধা ছিল। ডাকাত দল সব কাজ শেষ করার পর একে অপরকে ডাকাডাকি করেন।

ডাকাত দলের সরদারকে তারা ‘কাকা’ বলে সম্বোধন করছিলেন। মাঝেমধ্যে নুরু, সাব্বির, রকি নামেও ডাক দিচ্ছিলেন। রাত ৩টার দিকে ডাকাতরা টাকা, মোবাইল ও স্বর্ণালংকার নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি শুরু করে। বাসের ভেতরে ভাগাভাগি নিয়ে তাদের মধ্যে বাগবিতন্ডা হয়।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্যাতিতা নারী ঈগল পরিবহণের অন্য একটি বাসের সুপারভাইজারের সাবেক স্ত্রী। ওই সুপারভাইজারের বাড়ি পাবনা জেলার সদর উপজেলায়। আবার যে বাসে ডাকাতি ও যৌন নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে ওই বাসটির সুপারভাইজার ও হেলপারের বাড়িও পাবনা সদর উপজেলায়। কিছুদিন আগে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এর পর থেকে ওই নারী তার বাবার বাড়ি দৌলতপুরে থাকতেন। পোশাক কারখানায় কাজের আশায় তিনি নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিলেন।


এদিকে, টাঙ্গাইল শহরের দেওলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তারকৃত রাজা মিয়ার বাড়ি কালিহাতী উপজেলার বল্লা গ্রামে নয়। বল্লা গ্রামের মৃত মালাবক্সের ছেলে মৃত হারুন অর রশিদ জীবিতাবস্থায় সিরাজগঞ্জের যমুনার তীর(তৎকালীন পতিতালয়) থেকে তার মা হেলেনা বেগমকে ছোট একটি শিশু সহ বিয়ে করে নিয়ে আসেন।

সেই ছোট্ট শিশুটিই রাজা মিয়া। বল্লা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি রাশিদুল হাসান আকন্দ লাভলু বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।


মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি-উত্তর) অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. হেলাল উদ্দিন জানান, জবানবন্দিতে আসামিরা ডাকাতি ও পালাক্রমে যৌন নিগ্রহের বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আসামি রাজা মিয়া যৌন নিগ্রহ এবং লুণ্ঠন উভয় অপরাধে অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।


প্রকাশ, গত মঙ্গলবার(২ আগস্ট) সন্ধ্যায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে ঈগল পরিবহণের একটি বাস নারায়ণগঞ্জ হয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে সিরাজগঞ্জের একটি খাবার হোটেলে যাত্রাবিরতি করে। সেখান থেকে যাত্রা শুরুর পর তিন দফায় যাত্রীবেশী কয়েক জন ডাকাত বাসে ওঠে।

বাসটি টাঙ্গাইল অতিক্রম করার পর ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে চালককে জিম্মি করে বাসটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। তারা যাত্রীদের হাত, পা, চোখ বেঁধে তাদের সব লুটে নেয়। বাসে ১২-১৩জন নারী সহ ২৪-২৫ জন যাত্রী ছিল। এ সময় বাসে থাকা এক নারী যাত্রী পালাক্রমে যৌন নিগ্রহের শিকার হন।


ডাকাতরা পরে বাসটি টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের দিকে নিয়ে যায়। রাত সাড়ে ৩টার দিকে বাসটি মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়া নামক স্থানে রাস্তার পাশে বালির ঢিবিতে ফেলে ডাকাতরা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যাত্রীদের উদ্ধার করে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno