আজ- ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  সকাল ১১:৩৫

বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা নারী কামরুন্নাহার!

 

বুলবুল মল্লিক:

শৈশব পেরিয়ে সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েদের হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল। যে বয়সে মেয়েদের লেখাপড়া ও হাসি-খেলায় মেতে থাকার কথা- সেই বয়সে তাদের সংসারের ঘানি টানতে হচ্ছিল। নিজের ছাত্রীদের এমন করুণ পরিণতি দেখে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন স্কুল শিক্ষিকা কামরুন্নাহার খান মুন্নি।

যেহেতু এটা সামাজিক ব্যাধি তাই বাল্যবিয়ে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে তিনি ছাত্রীদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে অনেক মেয়ের জীবনের গতিপথে পরিবর্তন এনেছেন তিনি। কামরুন্নাহার থান মুন্নি টাঙ্গাইল স্টেডিয়াম কেন্দ্রীক মোনালিসা ওমেন্স স্পোর্টস অ্যাকাডেমির পরিচালক।


জানা যায়, ২০১০ সালে কামরুন্নাহার খান মুন্নি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বাবুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে সময় স্কুলের শিশু-কিশোরদের নিয়ে নানা খেলাধূলার আয়োজন করতেন। ২০১২ সালে টাঙ্গাইল প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে এক বছরের জন্য প্রশিক্ষণে অংশ নেন মুন্নি। প্রশিক্ষণ শেষে স্কুলে ফিরে গিয়ে দেখেন অনেক মেয়েই নেই। তাদের অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। কিছুদিন পর বাল্যবিয়ের শিকার এক ছাত্রীর সঙ্গে তার দেখা হয়। তার কাছ থেকে জানতে পারেন, ছোট ছোট মেয়েদের বাল্যবিয়ের ঘটনা।

তখন কামরুন্নাহার খান মুন্নি মেয়েদের বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। যেহেতু বিষয়টা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। তাই চিন্তা করতে থাকেন কীভাবে মেয়েদের বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করা যায়। এরই মধ্যে ২০১৪ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেণ্ট শুরু হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন ফুটবলের মাধ্যমেই এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে দুটি সমস্যা তার সামনে দেখা দেয়- একেতো মেয়ে তার উপর ফুটবল। একেতো মেয়েদের ফুটবল খেলা ঘুনেধরা সমাজের রেওয়াজ বিরুদ্ধ। তারপরও তিনি দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মেয়েদের ফুটবল খেলা শেখাতে থাকেন। সে সময় বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের নিয়ে ফুটবল দল গঠন করা হয়। কামরুন্নাহার খান মুন্নিও তার স্কুলে ফুটবল দল গঠন করেন।


কামরুন্নাহার খান মুন্নি জানান, একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে- যারা বাল্যবিয়ে করেন, সেসব পুরুষ একটু সংকীর্ণ মনের হয়ে থাকে। যে মেয়েরা হাফ প্যাণ্ট পড়ে ফুটবল খেলে, চুল ছোট করে কেটে রাখে, তাদের বিয়ে করতে সেসব পুরুষ উৎসাহিত হন না। তখন তিনি মনে করলেন, ফুটবল খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারলে মেয়েরা বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা পাবে। তাই মেয়েদের ফুটবল খেলায় সম্পৃক্ত করতে থাকেন।


২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কামরুন্নাহার খান মুন্নি টাঙ্গাইল শহরের উত্তরণ শিশু শিক্ষালয়ে বদলি হয়ে আসেন। এরপর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে দল গঠনসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পান তিনি। এ সময় গ্রামের বিভিন্ন স্কুলের মেয়েদের ফুটবল খেলায় সম্পৃক্ত করতে থাকেন। কিন্তু দেখা যায়- অনেক পরিবার মেয়েদের খেলাধূলায় থাকতে দিতে চায় না। অনেক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে নিয়মিত টাঙ্গাইলে এসে অনুশীলনে অংশ নিতে পারে না।

সেই মেয়েদের নিজের বাসায় রেখে অনুশীলন করার ব্যবস্থা করেন। একপর্যায়ে তিনি ‘মোনালিসা ওমেন্স স্পোর্টস একাডেমি’ গঠন করেন। এই একাডেমিতে মেয়েদের নিয়মিত ফুটবল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখন ৩৫ জন মেয়ের প্রশিক্ষণ চলছে। তাদের সবার থাকা-খাওয়া, অনুশীলন সব ব্যবস্থা করেন কামরুন্নাহার। শুরুর দিকে নিজের আয়ের জমানো টাকা খরচ করে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেন। পরে কামরুন্নাহার খান মুন্নি ‘ডেইলি স্টার আনসাং ওমেন্স নেশন বিল্ডার্স’ পুরস্কার লাভ করেন। সেই পুরস্কারের দুই লাখ টাকার পুরোটাই তিনি খরচ করেছেন ওই একাডেমিতে। তার স্বামী আনোয়ার সাদাত উজ্জ্বল ও টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী মির্জা মাসুদ তাকে সহযোগিতা করছেন।


কামরুন্নাহার খান মুন্নি এ পর্যন্ত ৩৮ জন মেয়েকে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করেছেন। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভূঞাপুরের মেয়ে মিলিকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। সপ্তম শ্রেণিতে পড়–য়া মিলিকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে শুনে তার অভিভাবকের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। তাদের বুঝিয়ে মিলিকে নিজের একাডেমিতে নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর শোনেন- বিয়ে ভেঙে গেছে।


তিনি জানান, মিলির মাথায় লম্বা চুল ছিল, ছিল দেখতেও সুন্দর। কামরুন্নাহার ওকে বাসা থেকে লুকিয়ে বের হয়ে সেলুনে গিয়ে চুল কেটে ফেলতে বলেন। বিয়ে ভাঙতে মিলিও তার চুল কেটে ফেলেছিল। সেই মিলি পরে বিকেএসপিতে প্রমীলা ফুটবল প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সুযোগ পেয়েছিল।


শিক্ষক কামরুন্নাহার খান মুন্নি এখন একজন সফল কোচ। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) বি ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করেছেন। এর আগে ‘সি’ লাইসেন্স কোর্স করেছেন। বিকেএসপিতেও করেছেন কোচেস কোর্স। কামরুন্নাহারের একাডেমির মেয়েদের নিয়ে গড়া টাঙ্গাইল জেলা দল ২০২১ সালে এবং ২০১৯ সালে বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল টুর্নামেণ্টে ঢাকা বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসে আনসারের হয়ে খেলেছেন অ্যাকাডেমির ফুটবলার সিরাত সাবরিন ও রূপা আক্তার। বাংলাদেশ গেমসে রৌপ্যজয়ী রাগবি দলের সবাই এই একাডেমির। বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন আট নারী ক্যাডেট ফুটবলার। এ ছাড়া বিকেএসপির স্বল্প মেয়াদি-দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অন্তত ২৫ জন।


৩৬ বছর বয়সী নিঃসন্তান কামরুন্নাহার মুন্নির অ্যাকাডেমির মেয়েরাই তার আদরের সন্তান। মেয়েদের নিয়েই তার সব ভাবনা। কামরুন্নাহার খান মুন্নি জানান, মেয়েরা খেলতে চায়। কিন্তু অনেক পরিবার মেয়েদের খেলতে দিতে চায় না। তিনি মনে করেন, খেলার মাধ্যমেই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব। খেলায় যুক্ত হলে মেয়েদের মধ্যে একটা নেতৃত্ববোধ তৈরি হয়- সংকীর্ণতা দূর হয়।


কামরুন্নাহার মুন্নিকে নিয়ে তৈরি করা একটি প্রামাণ্যচিত্র ৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাণিজ্যিক শাখায় ‘মার্সে দ্যু ফিল্ম’-এ নির্বাচিত হয়ে পুরস্কার লাভ করে। প্রামাণ্যচিত্রটির কারণে কামরুন্নাহারের বাল্যবিয়ে ঠেকানোর সংগ্রামের কথা দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের কাছে পৌঁছে গেছে।


সংগ্রামী কামরুন্নাহার খান মুন্নি আরও জানান, প্রথম যখন মেয়েদের নিয়ে ফুটবল অনুশীলন শুরু করেন, তখন অনেকেই বলতেন- এটা তার পাগলামি। ধীরে ধীরে সফলতা আসছে। এখন অনেকেই এটাকে আর পাগলামি মনে করে না। কোনো মেয়ের শিক্ষাজীবন যেন ঝরে না যায়, কাউকে যেন বাল্যবিয়ের শিকার হতে না হয়- এটাই তার প্রত্যাশা।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno