আজ- ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  দুপুর ১২:১৭

মধুপুর বনের এক সম্রাট জাহাঙ্গীর!

 

বুলবুল মল্লিক:

মুঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট জাহাঙ্গীরের সার্বজনীন মানসিকতা নিয়ে টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে এক সম্রাট জাহাঙ্গীরের আবির্ভাব ঘটেছে।

মুঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট মির্জা নুরউদ্দিন বেগ মোহাম্মদ খান সেলিম জাহাঙ্গীর। বাবা তৃতীয় সম্রাট আকবরের পদাঙ্ক অনুসরণে গণকল্যাণে কাজ করে তিনি স্মরণীয়-বরণীয়।

আর মধুপুরের অজপাড়াগাঁয়ের এক সম্রাট জাহাঙ্গীর হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েও ইতোমধ্যে বনের ভেতর ‘আলোর ভুবন আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছেন; স্থানীয় গণমানুষের জন্য নির্মাণ করছেন ১০ শয্যার একটি হাসপাতাল। স্থানীয় আদিবাসী-বাঙালিদের কাছে ‘জাহাঙ্গীর কবির’ একটি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রিয় নাম।

মধুপুর বনাঞ্চলের বেরীবাইদ ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়া(দক্ষিণ জাঙ্গালিয়া) গ্রামের টিউবওয়েল মিস্ত্রি মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে জাহাঙ্গীর কবির(২৫)। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় জাহাঙ্গীর।

বড় ভাই জাহিদ হাসান গাজীপুরের একটি টেক্সটাইল মিলে চাকুরি করেন, মেজ ভাই জাকির হোসেন স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, ছোট বোন রহিমা খাতুনকে বিয়ে দিয়েছেন, ছোট ভাই আলমগীর হোসেন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত, অপর ছোট বোন হালিমা খাতুন টাঙ্গাইল শহরের কুমুদীনি সরকারি কলেজে সমাজকর্মে অনার্স ৩য় বর্ষে অধ্যয়ন করছে, অপর ছোট ভাই আনিসুর রহমান ময়মনসিংহের গাবতলী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে(এইচএসসি) ১ম বর্ষের ছাত্র।

সরেজমিনে জানা যায়, মধুপুরের ঘন বন দিয়ে ঘেড়া জাঙ্গালিয়া গ্রামে কোন সরকারি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কিংবা কোন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র বা কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। গ্রামের সচেতন ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা উপজেলা সদর বা জলছত্র স্কুলে শিক্ষাগ্রহনের সুযোগ নিয়ে থাকে।

২০০৮ সালের আগে গ্রামের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বলতে গেলে শিক্ষার আলো থেকে এক প্রকার বঞ্চিত ছিল। বিগত ২০০৭ সালে জাহাঙ্গীর কবির জলছত্র কর্পোস খ্রিস্টি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় জাঙ্গালিয়া গ্রামের তিনজন ছেলেকে ওই স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে যান। সে সময় ওই তিন ছাত্রকে স্কুল কর্তৃপক্ষ ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ অভিমান জাহাঙ্গীর কবিরের স্কুল প্রতিষ্ঠায় ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে।

২০০৮ সালে জাহাঙ্গীর নিজ উদ্যোগে জাঙ্গালিয়া গ্রামে ‘আলোর ভূবণ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুলের কার্যক্রম শুরু করেন। শুরুর দিকে খোলা জমিতে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে ও ফাঁকা চা স্টলে স্থানীয় ছেলে-মেয়েদের ডেকে এনে স্কুলে ভর্তি করে নিজে শিক্ষক হয়ে তাদের পাঠ্য কার্যক্রম শুরু করেন।

জাহাঙ্গীর কবিরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার সাথে দৃঢ় মনোবল লক্ষ্য করে স্থানীয় আব্দুস সাত্তার মিয়া স্কুলের জন্য দুই বিঘা জমি দান করেন। এরপর সেই জমিতে একটি টিনসেড ঘর নির্মাণ করে ওই স্কুলের কার্যক্রম চালু করা হয়। দানকৃত জমিতে টিনসেড ঘর নির্মাণে ব্যয়কৃত সকল অর্থ জাহাঙ্গীর কবির তার চাকুরির বেতন এবং বন্ধুদের দেয়া সাহায্য থেকে সংগ্রহ করেছেন।

আলোর ভুবন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয় আদিবাসী-বাঙালি ছেলে-মেয়েরা এখন বিনাবেতনে স্বাচ্ছন্দে পড়ালেখা করছে। স্থানীয় কয়েক যুবক-যুবতী নামমাত্র বেতনে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানও তুলনামূলকভাবে প্রশংসার দাবি রাখে।

চলতি বছরের শুরুতে জাহাঙ্গীর কবির গ্রামের চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত দরিদ্র মানুষের জন্য আব্দুস সাত্তারের দেয়া অবশিষ্ট খালি জমিতে একটি হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন।

ইতোমধ্যে ওই হাসপাতালে পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডের জন্য নির্ধারিত ৩৩ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি টিনসেড ঘরের কাজ প্রায় শেষ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে একটি তিনতলা ভবন নির্মাণের কাজ এখন চলছে।

স্কুল প্রতিষ্ঠায় জমিদাতা বয়োবৃদ্ধ আব্দুস সাত্তার জানান, ছেলেটার মধ্যে কী যেন একটা আছে। ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার প্রতি ওর আন্তরিকতা ও অটুট মনোবল দেখে অভিভূত হয়ে তিনি স্বইচ্ছায় স্কুল প্রতিষ্ঠায় জমি দান করেছেন।

তিনি আরো জানান, স্থানীয় পর্যায়ে ছেলেটির কর্মকান্ড অনেক বড় দানশীলদেরও ছাড়িয়ে গেছে। স্কুলের পর এখন ছেলেটি হাসপাতাল নির্মাণে ব্রতী হয়েছে। হাসপাতালের জন্য একটি টিনসেড ঘর তৈরি করা হয়েছে। তিনতলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।

হাসপাতালের আরো দুটি ভবন নির্মাণের জন্য আরো জমি প্রয়োজন। হাসপাতাল নির্মাণে যে পরিমাণ জমির লাগবে তা তিনিই দিবেন।

জাঙ্গালিয়া গ্রামের ফরহাদ আলী, আব্দুল হাকিম সহ অনেকেই স্কুল প্রতিষ্ঠা ও হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করায় জাহাঙ্গীর কবিরের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

আলোর ভুবণ আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোশী চাম্বুগং বলেন, ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও স্কুলটিতে এখন তিনটি ক্লাস রুম, একটি লাইব্রেরী ও একটি শিক্ষক কক্ষ রয়েছে। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯৮জন। তিনি সহ চার জন শিক্ষক রয়েছেন।

এ বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনাবেতনে পাঠদান চলছে। তবে পরীক্ষার ফি বাবদ শিশু থেকে দ্বিতীয় পর্যন্ত ২০ টাকা এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৫০ টাকা নেওয়া হয়।

স্কুলটিতে পিএসসি বা পিইসি ও সরকারি বই পাওয়ার নিবন্ধন রয়েছে। স্থানীয় হতদরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিনাবেতনে লেখাপড়া করানোর কারণে তারা প্রায় স্বেচ্ছাশ্রমে এ বিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন।

জাহাঙ্গীর কবির জানান, গ্রামে কোন স্কুল না থাকায় অতিকষ্টে তাকে লেখাপড়া করতে হয়েছে। বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের ইদিলপুর নির্মলা মারিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির পর সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে জলছত্র কর্পোস খ্রিস্টি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন।

এরপর মধুপুর কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকার মকবুল হোসেন ডিগ্রী কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন। গত ২০১৩ সাল থেকে তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিলের ও-লেবেল প্রোগ্রামের ই-হার্ব সেন্টারে কর্মরত রয়েছেন।

তিনি জানান, এখনও গ্রামের অধিকাংশ মানুষ শিক্ষার আলো ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। তিনি স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ জানান।

তিনি জানান, বর্তমানে হাসপাতালের মহিলা ও পুরুষ ওয়ার্ডের জন্য টিনসেডের একটি ঘর নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। হাসপাতালের আউটডোর ও স্থানীয়দের অনুষ্ঠানের জন্য একটি উন্মুক্ত মঞ্চ, দ্বিতীয় তলায় হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবন এবং তৃতীয় তলায় গ্যালারী নির্মাণের জন্য তিনতলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে।

এছাড়াও হাসপাতালের জন্য আরো দুটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে। এজন্য প্রচুর টাকা প্রয়োজন। যা তার একার পক্ষে জোগার করা কঠিন। হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থে নির্মাণাধীন হাসপাতালের জন্য দেশের বিত্তবানদের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

বেরীবাইদ ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, এ গ্রামে কোন স্কুল ও স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা ছিলনা। স্থানীয় তরুণ জাহাঙ্গীর কবিরের উদ্যোগে ইতোমধ্যে আলোর ভুবণ আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

গ্রামের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে লেখাপড়া করছে। তিনি একটি হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। হাসপাতালটি নির্মিত হলে গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্য সেবা পাবে।

বেরীবাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জুলহাস উদ্দিন বলেন, আলোর ভুবণ আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। তরুণ প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর কবিরকে তিনি পরামর্শ ও সাহস যুগিয়েছেন। হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কাজেও তার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন তিনি।

জাঙ্গালিয়া গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওই সময় বর্তমান বেরীবাইদ ইউনিয়নের সকল গ্রাম ছিল অরণখোলা ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্ভুক্ত।

এ কারণে সে সময় বর্তমান বেরীবাইদ ইউনিয়নের মাত্র তিনটি গ্রামে একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মিত হয়। ফলে নবগঠিত বেরীবাইদ ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক নেই।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno