আজ- ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ মঙ্গলবার  দুপুর ১২:৩০

মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান ‘বীরাঙ্গনা ববিজান’

 

দৃষ্টি নিউজ:

dristy-pic-52সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত নারীদের খেতাব দিয়েছেন ‘বীরাঙ্গণা’ অর্থাৎ সাহসী নারী হিসেবে। কিন্তু সামাজিকভাবে হয়রানির ভয়ে অনেকেই বীরঙ্গণা শব্দটা ব্যবহার করতে চান না। তাই টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের বীরাঙ্গণা ববিজান বেগম মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান। তিনি এ উপজেলার বাঁশতৈল ইউনিয়নের বাঁশতৈল পশ্চিমপাড়া গ্রামের মৃত আরাদন আলীর মেয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৯ বছর।
জানা গেছে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে একই গ্রামের দবু খাঁ’র ছেলে দুদু খাঁ’র সঙ্গে বিয়ে হয় ববিজানের। সাত বছরের সংসারজীবন চলাকালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তাদের গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি সেনারা। ১৯ বছরের সুন্দরী যুবতী বাংলার সহজ-সরল গৃহবধূ ববিজানের ওপর নজর পড়ে পাক সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের। সেদিনের সেই ভয়াবহতার কথা মনে পড়লে এখনো শিউরে ওঠেন ববিজান বেগম।
বৃদ্ধা ববিজান বেগম জানান, যুদ্ধ চলাকালে একদিন পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের বাঁশতৈল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক বিএসসি ও আরো কয়েকজনের বাড়ি আগুন দিয়ে পুঁড়িয়ে দেয়। ওই দিনই পাক সেনারা গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে ঢুকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ববিজানসহ কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করে। অস্ত্রের ভয় আর গণধর্ষণের কারণে জ্ঞান হারান তিনি। পাক সেনারা চলে গেলে আশপাশের বাড়ির লোকজন উদ্ধার করে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন তাকেসহ অন্য ধর্ষিতাদের। কিন্তু সুস্থ হলেও ধর্ষিতা হওয়ার অপরাধে স্বামীর সংসার ছাড়তে হয় তাকে। সাত বছরের সংসারজীবন থেকে এক বছরের শিশুকন্যা রহিমাকে নিয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে যান ববিজান। ঘরে সৎ মা থাকায় বাবার অভাবের সংসারে বেশি দিন ঠাঁই হয়নি ববিজান এবং তার শিশু মেয়ের।
যুদ্ধের কিছুদিন পর ময়মনসিংহের আব্দুল মালেক নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হয় ববিজানের। কিন্তু আগে থেকে তার স্ত্রী-সন্তান থাকায় সেখানে বেশিদিন সংসার করতে পারেননি তিনি। দ্বিতীয় স্বামীর সংসারে জন্ম হওয়া ছেলে রফিকুলকে নিয়ে আবার ফিরে আসেন বাবার বাড়ি বাঁশতৈল গ্রামে। তার বাবার মৃত্যুতে সৎমায়ের সংসারে জায়গা না হওয়ায় সরকারি জমিতে ঘর তুলে মেয়ে রহিমা ও ছেলে রফিকুলকে নিয়ে সেখানে কোনো রকমে বসবাস শুরু করেন। শিশু ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভিক্ষা করে খেয়ে না খেয়ে চলতে থাকে ববিজানের সংসার। তার এই দুরবস্থা দেখে বাঁশতৈল গ্রামের বৃদ্ধ ইয়াদ আলী তার সেবাযত্ন করার জন্য তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন। ৭ বছর আগে ইয়াদ আলী মারা গেলে ছেলে রফিকুলের সঙ্গে বন বিভাগের জায়গায় বসবাস করতে থাকেন।
২০ বছর আগে বন বিভাগের একটি প্লট পান ববিজান বেগম। কিন্তু সেই প্লট নিয়েও বাঁশতৈল গ্রামের গফুর মিয়ার ছেলে নুরু মিয়া নানাভাবে হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ করেন ববিজান বেগম। অথচ নূরু মিয়ার নামে বন বিভাগের তিনটি প্লট রয়েছে বলে জানান ববিজান। বয়স হওয়ায় এখন কানে কম শোনেন, স্মৃতিশক্তিও কমে গেছে। ববিজানের দুঃখ, যুদ্ধের পর সমাজ তো তাদের মেনেই নেয়নি, উল্টো খারাপ কথা ও কটূক্তি শুনতে হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও কষ্ট গেল না তার। এ কথা বলে কেঁদে ফেলেন ববিজান।
ববিজান বলেন, ‘কেউ তো কোনো দিন আমার খবরও নেয় না- এ কথা কারও কাছে বলতেও ভালো লাগে না।’
সরকারি কোনো সুবিধা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষের লাঞ্ছনা, ঘৃণা, অপবাদ আর ঘাড়ধাক্কা পেয়েছি’। বয়স্ক বা বিধবা ভাতা তো পানইনি, বন বিভাগের একটি প্লট ছাড়া সরকারি কোনো সযোগ-সুবিধাও পাননি তিনি। কাজকর্ম করতে না পারায় ছেলের সংসারে খেয়ে না খেয়ে কাটছে বীরাঙ্গণা বৃদ্ধা ববিজানের দিন।
বাঁশতৈল গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য আব্দুল হাই বলেন, খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন বৃদ্ধা ববিজান বেগম। বাঁশতৈল ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইয়াকুব আলী বলেন, যেদিন পাক সেনারা বাঁশতৈল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক বিএসসির বাড়িসহ কয়েকটি বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়, একই দিনই দুদু খাঁর বাড়িতে ঢুকে ববিজানসহ গ্রামের কয়েকজন নারীকে গণধর্ষণ করে পাক সেনারা। ওই ঘটনার পর দুদু খাঁ ববিজানকে ত্যাগ করেন।
মির্জাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অধ্যাপক দুর্লভ বিশ্বাস বলেন, এ বিষয়ে ওই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার সত্যতা জানতে পেরেছি। ভবিষ্যতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা পাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
বাঁশতৈল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান মিল্টন বলেন, ববিজানের বিষয়টি তার জানা নেই। তিনি সবেমাত্র ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে ববিজানের বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে সরকারি সুবিধা পাওয়ার সকল ব্যবস্থা করা হবে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno