আজ- ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  বিকাল ৫:০৩

যে নৃশংসতায় এখনো কাঁপে বুক :: কাল রক্তাক্ত ২১ আগস্ট, গ্রেনেড হামলার বার্ষিকী

 

দৃষ্টি নিউজ:

‘প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। তারপর মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ। পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মানুষের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি আর হাহাকারে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। মানুষের মৃতদেহগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল।

অনেকের শরীর থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ছটফট করছিল শরীরের বিচ্ছিন্ন হওয়া অংশগুলো। প্রায় জ্ঞানহারা অবস্থায় সেগুলো দেখতে পাই। নিজের শরীরেও অসংখ্য স্প্রিণ্টার লাগে। ব্যথায় কাতরাতে থাকি। এক সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ি।’- গ্রেনেড হামলা মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ট্রাইব্যুনালে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দেন প্রত্যক্ষদর্শী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (প্রয়াত)।

সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘স্প্রিণ্টার শরীরে বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা যে কী, তা ভুক্তভোগীরা ছাড়া কেউ বুঝবে না।’ সুরঞ্জিত যত দিন বেঁচে ছিলেন শরীরে গ্রেনেডের স্প্রিণ্টার বয়ে বেড়িয়েছেন।

সেই বিভীষিকাময় ২১ আগস্ট আগামীকাল শনিবার। রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে স্মরণকালের নৃশংসতম গ্রেনেড হামলার রক্তঝরা দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে সংঘবদ্ধ গ্রেনেড হামলায় মেতে ওঠেছিল ঘাতকের দল। সেদিনের পৈশাচিক হামলার প্রধান টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

পরিস্থিতি বুঝে ট্রাকে অবস্থানরত নেতারা ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা ঘিরে ফেলেন তাকে। প্রিয় নেত্রীকে রক্ষা করতে মানবঢাল রচনা করেন তারা। ভাগ্যক্রমে ঘাতকের গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড হামলা থেকে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও, ভয়াবহ ওই ঘাতকের বুলেট কেড়ে নেয় নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ তাজা প্রাণ। আহত হন ৪ শতাধিক নেতাকর্মী। লাশের মিছিলে স্বজনদের আহাজারি আর আহতদের চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে রাজধানীর পরিবেশ।

ফিরে দেখা ২১ আগস্ট ২০০৪ :

সেদিনও ছিল শনিবার। বিকালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শুরু হয় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ। প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

শেখ হাসিনার বক্তব্য তখন শেষ। ঘড়ির কাঁটায় বিকাল ৫টা ২২ মিনিট। হঠাৎ বিকট শব্দে গ্রেনেড বিস্ফোরণ। এরপর খই ফোটার মতো ফুটতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। জনাকীর্ণ সমাবেশে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাককে লক্ষ্য করেই ছোড়া হচ্ছিল গ্রেনেডগুলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরিত হয় ১৩টি গ্রেনেড।

হামলাকারীরা যখন বুঝতে পারল গ্রেনেড জখম করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে, তখন গুলি ছুড়তে শুরু করে। নেতারা ও দেহরক্ষীরা দ্রুত মানবঢাল রচনা করে শেখ হাসিনাকে তার বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তুলে দেন।

এ সময় শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় পর পর ৬টি বুলেট। ভাগ্যক্রমে বুলেট থেকেও রক্ষা পান শেখ হাসিনা। তবে বুলেটবিদ্ধ হন তাকে পেছন থেকে আগলে রাখা ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মাহবুব। গাড়িতেও একাধিক বুলেট আঘাত হানে। গ্রেনেড বা বুলেটের আঘাতে শেখ হাসিনা আহত না হলেও, বিকট শব্দে তার কানের শ্রবণযন্ত্র মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মৃত্যুর মিছিলে যারা :

সেদিন নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমান, কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের (দক্ষিণ) কর্মী সুফিয়া বেগম,

১৫নং ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মমতাজ রীনা, মাদারীপুর জেলার ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি লিটন মুন্সী, রি-রোলিং মিল ব্যবসায়ী রতন সিকদার, ৩০নং ওয়ার্ড শ্রমিক নেতা মো. হানিফ, সরকারি কবি নজরুল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মামুন মৃধা, ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সহ-সম্পাদক বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম,

স্বেচ্ছাসেবক লীগের আবদুস কুদ্দুস পাটোয়ারী, যুবলীগ নেতা আতিক সরকার, শ্রমিক লীগ কর্মী নাসিরউদ্দীন সরদার, মহিলা আওয়ামী লীগের রেজিয়া বেগম, বালুঘাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, আবুল কাশেম, মমিন আলী, শামসুদ্দিন, ইছহাক মিয়া এবং অজ্ঞাত আরো দুজন।

আহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাসহ ৪ শতাধিক নেতাকর্মী। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে আহত হন- আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, মোহাম্মদ হানিফ, সাবের হোসেন চৌধুরী, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ প্রমুখ।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনী নীরব দর্শক :

সেদিন সমাবেশস্থল ও আশপাশে অবিস্ফোরিত অবস্থায়ও পাওয়া যায় কয়েকটি গ্রেনেড। সুপ্রশিক্ষিত হামলাকারীরা সমাবেশস্থলের জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে এবং বিপরীত দিকের ভবন থেকে একের পর এক গ্রেনেড ছোড়ে। পরে হামলাকারীদের একটি গ্রুপ মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাকের খুব কাছে থেকে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি করে।

হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্ত-মাংসের স্তূপে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সমাবেশস্থল। সেদিন সমাবেশস্থল ও আশপাশে কয়েকশ সশস্ত্র পুলিশ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কর্তব্যরত থাকলেও, রহস্যজনকভাবে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা।

পুলিশ কাউকে আটক করেনি; বরং হতাহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসা নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপকভাবে লাঠিচার্জ এবং টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে হামলাকারীদের নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে। পরে মামলার তদন্তেও তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় পুলিশ।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno