বুলবুল মল্লিক:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইলের আলোচিত খান পরিবার ও তাদের অনুসারীরা আওয়ামীলীগের মনোনয়ন না পাওয়ায় দলীয় রাজনীতি থেকে খান পরিবারের বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। টাঙ্গাইল-৩, ৪, ৫ ও ৮ আসনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী মনোনয়নে এ আশঙ্কা দৃঢ় হয়েছে।
জানাগেছে, মহান স্বাধীনতার পর থেকে টাঙ্গাইলে আওয়ামীলীগের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে মূলত: শহরের প্রভাবশালী সিদ্দিকী ও খান পরিবারকে কেন্দ্র করে। দীর্ঘ ৫২ বছরে নানা কারণে সিদ্দিকী ও খান পরিবার নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালে সিদ্দিকী পরিবারের অন্যতম সদস্য বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম আওয়ামীলীগ ছেড়ে কৃষক শ্রমিক জনতালীগ নামে আলাদা দল গঠন করেন।
এরপর থেকে সিদ্দিকী পরিবারের বড় ছেলে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামীলীগে থাকলেও পরিবারের অন্য সদস্যরা আওয়ামীলীগ থেকে দূরে সরে যায়। কাদের সিদ্দিকী আলাদা দল গঠন করে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আদর্শিক পিতা মেনে কৃষক শ্রমিক জনতালীগের আদর্শ ও উদ্দেশ নির্ধারণ করেন।
এ সময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করলেও আওয়ামীলীগের দলীয় প্রতীক নৌকা ও কৃষক শ্রমিক জনতালীগের প্রতীক গামছার মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সিদ্দিকী পরিবারের বড় ছেলে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামীলীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ও সরকারের মন্ত্রী থাকাবস্থায় নিউ ইয়র্কের একটি সভায় ইসলাম ধর্ম ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হন।
ইসলাম পন্থী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রীত্ব, আওয়ামীলীগের পদ হারান এবং সর্বশেষ জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ সুযোগে খান পরিবার টাঙ্গাইলের আওয়ামীলীগের একচ্ছত্র কান্ডারী হিসেবে আবির্ভুত হয়।
আওয়ামীলীগ ক্ষমতাসীন থাকায় খান পরিবারের সদস্য সহিদুর রহমান খান মুক্তি টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র, আমানুর রহমান খান রানা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শুধুমাত্র লতিফ সিদ্দিকীর নির্বাচনী এলাকা কালিহাতী উপজেলা ব্যতিত প্রায় সর্বত্র খান পরিবারের অনুসারীরা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নির্বাচিত-মনোনীত হন।
২০১২ সালে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে জনপ্রিয় আওয়ামীলীগ নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদের সঙ্গে খান পরিবারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। খান পরিবার সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটায় ২০১৩ সালে। এ বছরের ১৮ জানুয়ারি পৌর এলাকায় কলেজপাড়া থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়।
ঘটনার তিন দিন পর তার স্ত্রী নাহার আহমেদ বাদী হয়ে সদর থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন। গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে জেলার আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী খান পরিবারের চার ভাই সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা, সাবেক পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, জাহিদুর রহমান খান কাকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে।
এছাড়া ২০১৪ সালের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হোটেল বয় আব্বাস আলীকে সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে মনোনীত করেও জনবিচ্ছন্নতার মুখে পরে খান পরিবার। ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আব্বাস আলী জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হন।
অতঃপর খান পরিবারের সহযোগিতায় বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও জমি দখল শুরু করেন। চাঁদাবাজি ও অন্যের জমি দখল করে রাতারাতি হোটেল বয় থেকে কোটিপতি বনে যান আব্বাস আলী। কথিত আছে, এ সময় ডিমের বাজার থেকে প্রতি ডিমের বিপরীতে ১৫ পয়সা হারে খান পরিবারের নির্দেশে আব্বাস আলী চাঁদা আদায় করেন।
জেলা আওয়ামীলীগের জনপ্রিয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা সহ হত্যা, হামলা, অত্যাচার-নির্যাতন, জমি দখল ইত্যাকার নানা বিষয়ে বেপরোয়া হয়ে পড়ায় খান পরিবার জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকে।
সম্প্রতি টাঙ্গাইলের আটটি আসনের মধ্যে চারটিতেই বর্তমান সংসদ সদস্যদের আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়নি। তাদের জায়গায় নতুন চারজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
বাদ পড়া নেতাদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম(ভিপি জোয়াহের), টাঙ্গাইলের আলোচিত খান পরিবারের আতাউর রহমান খান, টাঙ্গাইল সদরের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন ও কালিহাতী থেকে নির্বাচিত মোহাম্মদ হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারি রয়েছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, টাঙ্গাইল-৩(ঘাটাইল) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। তিনি আলোচিত খান পরিবারের কর্তা ও সাবেক সংসদ সদস্য শামসুর রহমান খানের ভাই এবং আমানুর রহমান খান রানার বাবা। শামসুর রহমান খান এ আসন থেকে সাত বার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
আমানুর রহমান খান রানা ২০১২ সালে উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন। আওয়ামী লীগের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলায় আমানুর রহমান খান রানা ও তার ভাইয়েরা অভিযুক্ত হওয়ার পর তারা আত্মগোপন করেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে আতাউর রহমান খান আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন। নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এলাকার উন্নয়ন কাজে তার সিদ্ধান্ত সব সময়ই গৌন ছিল। তার ছেলে সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা নিজস্ব বলয় তৈরি করে তাদের মাধ্যমে উন্নয়ন কাজ করেছেন।
তিনি স্থানীয় আওয়ামীলীগের সঙ্গে দূরত্ব না কমিয়ে আরও বাড়িয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছেন। ফলে দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। এবার তার জায়গায় জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. কামরুল হাসান খানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি এলাকায় স্বজ্জন ও সাদা মনের মানুষ হিসেবে পরিচিত।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম খান পরিবার কর্তৃক অত্যাচারিত নেতা। তিনি ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়ে টাঙ্গাইল-৮(সখীপুর-বাসাইল) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পরই নিজ নির্বাচনী এলাকা সখীপুর ও বাসাইলে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তার বিরোধ দেখা দেয়।
সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলামের সঙ্গে দুই উপজেলার আওয়ামীলীগের বেশিরভাগ নেতার সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। বিগত সময়ে তার নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়ন কাজ সঠিকভাবে হয়নি। তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মীয়করণ করেছেন।
ফলে জনবিচ্ছিন্ন হওয়ায় দলীয় মনোনয়ন পাননি। এবার তার জায়গায় সখীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অনুপম শাহজাহান জয়কে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহানের ছেলে। তিনি খান পরিবারের আস্থাভাজন ছিলেন। ২০১৪ সালে শওকত মোমেনের মৃত্যুর পর তিনি উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালে তিনি মনোনয়ন পাননি।
টাঙ্গাইল-৪(কালিহাতী) আসনের সংসদ সদস্য হাসান ইমাম খান ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে উপ-নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সংসদ থেকে পদত্যাগ করার পর আসনটি শূন্য হয়েছিল।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হন। তিনি খান পরিবারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। তিনি এলাকায় ‘ভাইলীগ’ প্রতিষ্ঠা করে সমালোচিত হন। এ আসনে উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদারকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি একজন সাচ্চা আওয়ামীলীগার, দলের জন্য তার ত্যাগ অনস্বীকার্য।
আলোচিত খান পরিবারের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। খান পরিবারের বিশ্বস্ততা ভেঙে ছনোয়ার হোসেন আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্য হিসেবে এলাকার গণমানুষের আকাঙ্খা পুরণে ব্যর্থ হয়েছেন।
তিনি সব সময় খান পরিবারের অনুসারীদের কথায় কাজ করেছেন। খান পরিবারের স্বার্থ রক্ষায় তিনি প্রাজ্ঞ রাজনীতিক ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। ফলে দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। এবার তার জায়গায় যুবলীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য মামুন অর রশিদকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
জেলার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, খান পরিবারের কর্তা আতাউর রহমান খান, তাদের বিশ্বস্ত অনুসারী ছানোয়ার হোসেন ও হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারি দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার পেছনে খান পরিবারের অপকর্ম ও এক নায়ক তান্ত্রিক মানসিকতা কাজ করেছে।