আজ- শুক্রবার | ২৩ মে, ২০২৫
৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ | বিকাল ৩:৪৩
২৩ মে, ২০২৫
৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
২৩ মে, ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার সন্ধিক্ষণে বিশ্ব

মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল::

গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অবিসংবাদিত। একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যম সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম দিবস’ প্রতি বছর ৩ মে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পালিত হয়। ২০২৫ সালে দিবসটি এমন এক সময়ে পালিত হচ্ছে যখন বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ, দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ডিজিটাল নজরদারি এবং ভুয়া সংবাদের স্রোতের মুখোমুখি। জাতিসংঘ ঘোষিত ২০২৫ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘Journalism in the Age of AI : Safeguarding Truth and Trust’ অর্থাৎ ‘এআই যুগে সাংবাদিকতা : সত্য ও আস্থার সুরক্ষা’।

 

 

 

 

১৯৯১ সালে নামিবিয়ার উইন্ডহুক শহরে ইউনেস্কো আয়োজিত এক সেমিনারে ‘উইন্ডহুক ডিক্লারেশন’ গৃহীত হয়। এতে প্রথমবার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বহুবাচনিকতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব পায়। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ ৩ মে-কে ‘World Press Freedom Day’ হিসেবে ঘোষণা করে। দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- স্বাধীন গণমাধ্যমের গুরুত্ব তুলে ধরা, সাংবাদিকদের উপর নিপীড়নের প্রতিবাদ, মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা।

 

 

 

 

 

 

বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে চলছে। প্রিণ্ট মিডিয়া দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন রাজস্ব কমছে। একাধিক দেশ, বিশেষ করে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো ইন্টারনেট শাটডাউন, সেন্সরশিপ ও সাংবাদিক নিপীড়নের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গণমাধ্যমগুলোতে ডিজিটাল মনিটরিং ও নজরদারি করা হচ্ছে। Pegasus বা অনুরূপ প্রযুক্তির মাধ্যমে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাক করেও হয়রানি চলছে। বিভিন্ন সমাজ মাধ্যমে ‘ফেক নিউজ’ প্রচার করে সত্য সংবাদকে আড়াল করার প্রয়াস পাচ্ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভুয়া সংবাদ ও প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে সত্যের মুখে তালা লাগানো হচ্ছে। ২০২৪ সালের রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (RSF) এর বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম সূচক অনুযায়ী বিশ্বের গণমাধ্যম পরিস্থিতি ৩১ শতাংশ দেশে ‘খুব খারাপ’ বা ‘খারাপ’, ১৯ শতাংশ দেশে মোটামুটি ভালো, মাত্র ৮ শতাংশ দেশে গণমাধ্যম পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে- দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপালে সাংবাদিকতা ও এর পরিবেশ দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। প্রতি বছর ‘বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম দিবস’ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়। ২০২৫ সালে এই দিবসটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ দেশটি বর্তমানে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। ২০২৪ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (RSF) প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬৫তম স্থান পায়- যা আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ অবনতি। ওই ইনডেক্সে বাংলাদেশের স্কোর ২৭.৬৪- যা দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পরেই সর্বনিম্ন। ফ্রিডম হাউসের ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ ২০২৪ এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘আংশিক মুক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে রাজনৈতিক অধিকার স্কোর ১৫/৪০ এবং নাগরিক স্বাধীনতা স্কোর ২৫/৬০।

 

 

 

 

 

 

 

 

মূলত: মুক্ত গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। যেখানে গণমাধ্যম স্বাধীন, সেখানেই গণতন্ত্র সুসংহত। যেমন- নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, আইসল্যান্ড ইত্যাদি। যেখানে প্রেস ফ্রিডম স্কোর খুবই ভালো সেখানে নাগরিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও দৃঢ়। অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়া, ইরান, চীন প্রভৃতি দেশে সাংবাদিকতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। ওইসব দেশে স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রকট।
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ও নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের দমনে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে সাংবাদিক গ্রেপ্তার, গুম ও হয়রানির ঘটনাও উদ্বেগজনক। ২০২৪ সালে অন্তত ৪০টির বেশি গণমাধ্যম সেন্সরশিপের শিকার হয়। ২০২৪ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণআন্দোলনের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সময়ে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন বৃদ্ধি পায়।

 

 

 

 

 

 

 

 

অনেকে আত্মগোপনে চলে যায়, অনেক সাংবাদিক স্বৈরাচারের দোসর তকমা পেয়ে ‘মব’ কালচারের শিকার হন। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৬৭ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করে- যা গণমাধ্যমের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। একই সময়ে সাংবাদিক ফারজানা রূপা ও তার স্বামী শাকিল আহমেদকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। কারান্তরীণ হন ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত সহ অনেক সাংবাদিক। ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন সেণ্টারে গণআন্দোলনকারীদের সমর্থকধারীদের বসানো হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে- নোবেল জয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা মিডিয়া রিফর্ম কমিশন গঠন করেছে এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর পর্যালোচনা শুরু করেছে ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

তারপরও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮ বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অথবা সাইবার নিরাপত্তা আইন এবং সাইবার প্রোটেকশন অর্ডিন্যান্স-২০২৫ এর মতো আইনগুলো সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সীমিত করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই আইনগুলোকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে উল্লেখ করেছে- যা আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

 

 

 

 

 

দক্ষিণ এশিয়ার ভারতে গণমাধ্যমের উপর রাজনৈতিক চাপ, কর দপ্তরের হস্তক্ষেপ, চ্যানেল বন্ধ, অনলাইন সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ চালানো হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের মতে, ভারতে ‘গণমাধ্যম একটি দলবদ্ধ হুমকির মুখে’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। অপর দেশ পাকিস্তানে গণমাধ্যমের উপর সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাব মাত্রাতিরিক্ত। অনেক চ্যানেল ও সাংবাদিককে দমন করার নজির পাকিস্তানে রয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

সারা বিশ্বেই নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের উপর হামলা ও তথ্য ব্লক করার ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকে। ফলে সাংবাদিকতা আজ ‘হাই রিস্ক প্রফেশন’ এ পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকদের হত্যা, নিখোঁজ বা জেলে পাঠানোর ঘটনা অহরহ। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের ইউনেস্কোর (UNESCO) পরিসংখ্যান বলছে ওই সময়ে বিশ্বে প্রায় ৪২০ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে বিচার হয়নি। এছাড়া নারী সাংবাদিকদের প্রতি যৌন হয়রানি বেড়েছে, বেড়েছে ট্রোলিং ও হুমকি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এসবের পাশাপাশি ডিজিটাল যুগে গণমাধ্যমে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও যুক্ত হয়েছে। যেমন- (ক) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI): ChatGPT, Deepfake ইত্যাদি প্রযুক্তি তথ্য যাচাই না করে বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে তথ্য নির্ভরতার প্রশ্ন উঠছে এবং সাংবাদিকদের চাকরি হুমকির মুখে পড়ছে। (খ) সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের আধিপত্য: Facebook, X (Twitter), TikTok সহ অন্যান্য সমাজ মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সমাজে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। অ্যালগরিদম ভিত্তিক ‘Echo Chamber’ সৃষ্টি হচ্ছে- যা সত্য সংবাদকে অবদমন করছে। (গ) সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা ঝুঁঁকি: সাইবার হামলা, ডকসিং, ডিজিটাল নজরদারি এখন প্রতিনিয়তই করা হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সংশ্লিষ্টা চাকরি নয়- দায়িত্ব পালন করছেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রেস ফ্রিডম বা মুক্ত গণমাধ্যমের অবাধ বিচরণে বিভিন্ন সময়ে আর্ন্তজাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন- ইউনেস্কোর ‘Global Media Defence Fund, RSF এর ‘Digital Security Helpline, UN-এর ‘Plan of Action on the Safety of Journalists’. সার্ক জার্নালিস্ট সেফটি নেটওয়ার্ক ইত্যাদি। হাল সময়ে বাংলাদেশে ‘সাংবাদিক নিরাপত্তা বিল’ প্রণয়নের দাবি উঠেছে। এছাড়া ভারত ও নেপালেও প্রেস কাউন্সিলের শক্তিশালীকরণের দাবি উঠেছে।

 

 

 

 

 

 

মুক্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে রাষ্ট্র, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক পর্যায়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের করণীয় হতে পারে- সাংবাদিকদের উপর দমন-পীড়ন বন্ধ করা, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা, সেন্সরশিপ না করা ও ইন্টারনেট শাটডাউন বন্ধ না করা ইত্যাদি। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা ও ন্যায্য পারিশ্রমিক, ফ্যাক্ট-চেকিং ইউনিট গঠন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সামাজিক পর্যায়ে পাঠকের মিডিয়া সচেতনতা বৃদ্ধি, ভুল তথ্য প্রতিরোধে নাগরিক উদ্যোগ এবং নারী সাংবাদিকদের প্রতি বৈষম্য ও হয়রানির প্রতিবাদে জনমত গঠন করা যেতে পারে।

 

 

 

 

 

বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম দিবস বা আন্তর্জাতিক মুক্ত গণমাধ্যম দিবস শুধুমাত্র একটি প্রতীকী দিবস নয়। এটি মুক্তচিন্তা, সত্য উদঘাটন এবং গণতন্ত্র রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ অনুস্মারক। বর্তমান বিশ্বে সাংবাদিকতা যখন নানা সংকটের সম্মুখীন, এই দিবস তখন আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায় স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা শুধু সাংবাদিকদের দায় নয় বরং তা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক দায়িত্ব। স্বাধীন সাংবাদিকতা বাঁচলে সত্য বাঁচবে আর সত্য বাঁচলে সমাজ বাঁচবে।

 

 

 

 

 

 

শেয়ার করুন স্যোশাল মিডিয়াতে

Facebook
Twitter
LinkedIn
X
Print
WhatsApp
Telegram
Skype

সর্বশেষ খবর

এই সম্পর্কিত আরও খবর পড়