দৃষ্টি নিউজ:
বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল পাক হানাদারমুক্ত দিবস উদযাপন করা হয়েছে। এ দিন বিজয় উৎসবে মেতে উঠে টাঙ্গাইলবাসী। এ দিন থেকে ছয়দিন ব্যাপী বিজয় মেলা স্থানীয় শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যানে শুরু হয়েছে, চলবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
রোববার(১১ ডিসেম্বর) সকালে শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক। উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন, টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র জামিলুর রহমান মিরণ। এ সময় আলহাজ মো. ছানোয়ার হোসেন এমপি, খন্দকার আব্দুল বাতেন এমপিসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
রোববার সকালে ছয় দিন ব্যাপী বিজয় উৎসবের উদ্বোধনী শেষে এক বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়। র্যালিটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদণি করে। র্যালিতে মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সহ সর্বস্তরের প্রায় ১০ সহস্রাধিক সর্বস্তরের জনতা অংশ গ্রহন করে।
টাঙ্গাইল পৌরসভা উদ্যোগে আয়োজিত ৬দিন ব্যাপী বিজয় উৎসবে পৌর উদ্যানের মুক্তমঞ্চে প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চিত্র প্রদর্শনী ও বিভিন্ন রকমের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রকাশ, ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর বাংলার দামাল ছেলেরা পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে টাঙ্গাইলকে মুক্ত করে। উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
যুদ্ধকালীন সময়ে টাঙ্গাইলের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনী দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত ‘কাদেরিয়া বাহিনীর’ বীরত্বের কথা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।
কাদেরিয়া বাহিনী দেশের মধ্যাঞ্চল টাঙ্গাইলের সখীপুরের বহেড়াতৈলে অবস্থান করে মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২৬ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টাঙ্গাইল ছিল স্বাধীন। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রশাসন পরিচালিত হয়। ২৬ মার্চ সকালে আদালত পাড়ার অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামের বাসভবনে এক সভায় গঠিত হয় টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীনবাংলা গণমুক্তি পরিষদ। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক ও সশস্ত্র গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং বদিউজ্জামান খানকে চেয়ারম্যান ও আব্দুল কাদের সিদ্দিকীসহ আরো ৮ জনকে সদস্য করে কমিটি গঠিত হয়।
টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তানদের মধ্যে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের আব্দুল মান্নান, গণপরিষদ সদস্য শামসুুর রহমান খান শাজাহান ছিলেন অগ্রগণ্য। ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হতে থাকে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা।
আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর অসীম সাহস, দুর্বার দেশপ্রেম, পরিস্থিতি বিশ্লেষণে ত্ণী দৃষ্টিভঙ্গি সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও যুদ্ধ পরিচালনায় অসম্ভব মেধার কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ দেশ-বিদেশে পরিচিতি পায়। এ বাহিনীর সদস্য ১৭ হাজারে উন্নীত হয়, এছাড়া ১৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও কাদেরিয়া বাহিনীর সহযোগী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কাদেরিয়া বাহিনীর যুদ্ধ। এ সময় পাক হানাদারদের কাছে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ‘বাঘা সিদ্দিকী’ নামে এক মহাতঙ্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এছাড়াও টাঙ্গাইলে খন্দকার আব্দুল বাতেন বাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত ‘বাতেন বাহিনী’ অনেক জায়গায় হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। চারদিক থেকে আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাক বাহিনী।
৩ এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ৮ তারিখ পর্যন্ত টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পরাজিত করে খান সেনাদের। এ সব যুদ্ধে ৩ শতাধিক দেশপ্রেমিক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের টাঙ্গাইল অঞ্চলের প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যোদ্ধাদের নিয়ে সখিপুরের মহানন্দা ও কীর্ত্তনখোলায় গড়ে তুলেন দুর্ভেদ্য দুর্গ। একের পর এক আক্রমণের মুখে পাক সেনারা গুটিয়ে জেলার অন্যান্য স্থান থেকে এসে যখন টাঙ্গাইল শহরে অবস্থান নেয় তখন উত্তর ও দণি টাঙ্গাইল ছিল সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
১০ ডিসেম্বর রাতে টাঙ্গাইল প্রবেশ করেন কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক ভোলা। ১১ ডিসেম্বর সকালে কমান্ডার বায়োজিদ ও খন্দকার আনোয়ার টাঙ্গাইল পৌঁছান। আসেন বিগ্রেডিয়ার ফজলুর রহমান। ১১ ডিসেম্বর ভোরে কাদেরিয়া বাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজ আক্রমণ করে দখলে নেন এবং শহরকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কাদেরিয়া বাহিনীর ১৫৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এই বাহিনী থেকে ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় খেতাব পান।