আজ- বুধবার | ৬ নভেম্বর, ২০২৪
২১ কার্তিক, ১৪৩১ | রাত ১১:৪৮
৬ নভেম্বর, ২০২৪
২১ কার্তিক, ১৪৩১
৬ নভেম্বর, ২০২৪, ২১ কার্তিক, ১৪৩১

নিঃস্ব ঈশিতার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প

দিনমজুর স্বামীর ঘরে সাধারণ আটপৌড়ে ঘর-কন্যা সামলানো গৃহবধূ নিঃস্ব ঈশিতা রাণী দাসের প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হাল সময়ের সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেছেন। লবন আনতে পান্তা ফুরানোর সময় পাড়ি দিয়ে তিনি এখন প্রতিমাসে আয় করছেন লাখ টাকা। বাড়ির পাশের বিলে হাঁস লালন-পালন করে তিনি সংসারে স্বচ্ছ্বলতা এনেছেন। ঈশিতা রাণী টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ধলাপাড়া ইউনিয়নের মুসল্লিপাড়া গ্রামের দিনমজুর পরিমল চন্দ্র দাসের স্ত্রী।


গৃহিনী ঈশিতা ও পরিমল চন্দ্র দাসের এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে চার সদস্যের টানাপোড়েনের সংসার। স্বামী পরিমল চন্দ্র দিনমজুর। স্বামীর আয় দিয়ে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও সংসার চালাতে গিয়ে অমানিষায় ডুবে থাকতে হয় ঈশিতাকে। সংসারের অভাব এবং হতাশার হাতছানিকে উপেক্ষা করে ঈশিতা নিজে কিছু একটা করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। স্বামীর উপর নির্ভর না করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য ২০০১ সালে প্রথম হাঁস পালন শুরু করেন।


সরেজমিনে জানা যায়, টাঙ্গাইল-ধালাপাড়া সড়কের ঘোড়াধহ সেতু থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। সামনেই মুসল্লিপাড়া গ্রাম। গ্রামটি নিচু এলাকা হওয়ায় প্রায় সারাবছরই বসতিগুলোর আশপাশে পানি থাকে। গ্রামের মুসল্লিপাড়া হলেও সেখানে ৯০ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বাস করে। এ গ্রামেই বাস করেন ঈশিতা রাণী দাস। বাড়ির চার পাশে বিলের উন্মুক্ত জলাশয়ে কয়েকটি বাচ্চা দিয়ে হাঁস পালন শুরু করেন ঈশিতা। এর জন্য আলাদা কোন ঘরের প্রয়োজন হয়নি। বাড়তি কোন খাবারেরও প্রয়োজন হয়নি। বিলের কিনারায় নেটের(জ¦াল) ঘের দিয়ে সেখানে হাঁস রাখেন।

পাশেই বাঁশের চাটাই এবং পলিথিনে ঘেরা একটি টং ঘর দিয়েছেন। সেখানে রাতে হাঁস পাহাড়া দেয় ঈশিতা এবং তার স্বামী পরিমল। শুধুমাত্র প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে একদিকে স্বামীর সংসারের ঘাণি অন্যদিকে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই নারী উদ্যোক্তা। অভাবকে জয় করে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন। তার এই প্রচেষ্টা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প দেখে এলাকার অনেকেই হাঁস পালনের দিকে ঝুঁকছেন।


ঈশিতা রাণী দাস জানান, পরিবারের অভাব-অনটনের মাঝেও তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষে ২০০১ সাল থেকে কয়েকটি করে হাঁস লালন-পালন শুরু করেন। তারপর ধারদেনা করে হাঁসের ৫০টি বাচ্চা দিয়ে গড়ে তুলেন ছোট একটি খামার। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধারদেনা সব পরিশোধ করেছেন। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা এবং লাভের জমানো ১৫ হাজার টাকা দিয়ে চলতি বছর তার খামারে ৩০ টাকা দরে ৫০০ হাঁসের বাচ্চা তুলেছিলেন। সবগুলোই দেশি হাঁস। বর্তমানে খামারে প্রায় ৪০০ হাঁস ডিম দিচ্ছে।

অজ্ঞাত অসুখে কিছু হাঁস মারা গেছে। বাকিগুলো পুরুষ হাঁস। হাঁসের ডিমের বাজার ভালো থাকায় প্রতিদিন ডিম বিক্রি করে আয় হচ্ছে প্রায় চার হাজার টাকা। এতে তার প্রতিমাসে আয় হচ্ছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। সারাদিন হাঁসগুলো উন্মুক্ত জলাশয়ে খাবার খেয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খামারে চলে আসে। ডিম পাড়ার সময় দুপুরে বাড়তি খাবার হিসেবে ধানের কুড়া খেতে দিতে হয়। মাঝে মাঝে হাঁসের ছোটখাটো রোগবালাই হলে ওষুধ দিতে হয়। তাছাড়া তার খামারে অন্য কোনো খরচ নেই।

বাড়ির আশপাশের লোকজন ধান ভাঙায়, চাল থেকে যে কুড়া বের হয়, সেগুলো তিনি পরিষ্কার করে দেন- বিনিময়ে তারা ঈশিতাকে ধানের কুড়াগুলো ফিতে দিয়ে দেন। বাইরে কোন ওষুধ ও খাবার না খাইয়ে নিজস্ব প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে তিনি হাঁস লালন-পালন করছেন। এতে তার খামারের হাঁস সুস্থ ও ভালো থাকে। চাহিদা ভালো থাকায় ডিম গুলো বাজারে নিতে হয় না। খামারে এসে পাইকাররা ডিম নিয়ে যাচ্ছে। এতে দামও ভালো পাচ্ছেন। আবার ডিম পাড়া শেষ হলে ও হাঁসের বয়স হলে প্রতিটি হাঁস ৩০০-৫০০ টাকা দরে বিক্রি করে দেন। হাঁস বিক্রি করেও প্রায় দুই লাখ টাকার মতো আয় করতে পারবেন।


তিনি আরও জানান, তাদের সংসারে আগে যেমন অভাব-অনটন ছিল বর্তমানে তা আর নেই। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। ছোট ছেলের বয়স ৪ বছর। মেয়ের পড়াশোনার খরচ ও সংসারের খরচ করার পর যে টাকা থাকে সেগুলো সঞ্চয় করেন। পরিবার নিয়ে বর্তমানে স্বচ্ছ্বলভাবে দিনাতিপাত করতে পারছেন। তার দেখাদেখি এলাকার অনেকেই হাঁস পালনে আগ্রহ দেখাচ্ছে।


বেকারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, চাকরির পেছনে না ছুটে তার মতো উদ্যোক্তা হলে দেশে আর কেউ বেকার থাকবে না। নিজেরাই কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারবেন। হাঁস পালন করা যেমন কষ্ট- তেমন আয়ও ভালো।


তার স্বামী পরিমল চন্দ্র দাস জানান, তিনি কাজের ফাঁকে স্ত্রীর হাঁসের খামার দেখা-শুনাও করি। তিনি যখন খামারে সময় দেন- তার খুব ভালো লাগে। আগে তিনি একা রোজগার করতেন। দিনমজুরি করে যে টাকা পেতেন- তাতে সংসার চালানো কঠিন ছিল। আর বর্তমানে তার স্ত্রী হাঁস পালন করেন। এখন তাদের সংসারে স্বচ্ছ্বলতা এসেছে। তার স্ত্রীর হাঁস পালন দেখে এলাকার নারী-পুরুষরা হাঁস পালনে আগ্রহ দেখাচ্ছে।


ঘাটাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. বাহাউদ্দীন সারোয়ার রিজভী জানান, ঈশিতা রাণী দাস উপজেলার একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। তার সফলতা দেখে উপজেলার বেকার নারী-পুরুষরা অনুপ্রাণিত হয়ে খামারি হয়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবেন।


তিনি আরও জানান, তাদের দপ্তর থেকে কোন প্রণোদনার ব্যবস্থা নাই। তবে তারা খামারিদের ফ্রিতে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এছাড়া সরকার নির্ধারিতমূল্যে হাঁসের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়ে থাকে।

শেয়ার করুন স্যোশাল মিডিয়াতে

Facebook
Twitter
LinkedIn
X
Print
WhatsApp
Telegram
Skype

সর্বশেষ খবর

এই সম্পর্কিত আরও খবর পড়