দৃষ্টি নিউজ:
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলার চার্জ গঠনের তারিখ বৃহস্পতিবার(২৯ সেপ্টেম্বর) ধার্য থাকলেও এমপি রানা আদালতে হাজির না হওয়ায় চার্জ গঠন হয়নি। এমপি রানার আইনজীবা পুলিশের দাখিল করা অভিযোগপত্রে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন না করে মনগড়া প্রতিবেদন দেয়ার অভিযোগ এনে মামলাটি পুনতদন্তের আবেদন করেছেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-১ এর বিচারক আবুল মনসুর মিয়া আগামী ৯ নভেম্বর চার্জ গঠনের পাশাপাশি বিবাদী পক্ষের পুনতদন্তের আবেদনের ওপর শুনানীর তারিখ নির্ধারণ করেন। একই সাথে আটক দুই আসামী সাবেক কমিশনার মাসুদুর রহমান মাসুদ ও জেলা সেচ্ছাসেবকলীগের সাবেক নেতা নুর উদ্দিন নুরুর পক্ষে ‘ডিফেন্স ল’ইয়ার’ নিয়োগেরও আদেশ দেন আদালত।
এ সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত পিপি মনিরুল ইসলাম খান, অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের, বাদী নাহার আহমদ এবং বিবাদী পক্ষে অ্যাডভোকেট আব্দুল বাকী মিয়া, অ্যাডভোকেট ফায়জুর রহমান, অ্যাডভোকেট মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম রিপন, অ্যাডভোকেট ফায়কুজ্জামান নাজিব, এমপি রানার বাবা আতাউর রহমান খান সহ উভয় পক্ষের অন্যান্য আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।এমপি রানার পক্ষে কৌঁসুলিদের দাখিলকৃত পুনতদন্তের ৩ পাতার আবেদনে উল্লেখ করা হয়, “সাংসদ আমানুর রহমান খান রানা ও তার ভাইয়েরা আওয়ামীলীগ নেতা ফারুক হত্যাকান্ডের সঙ্গে কোনভাবেই জড়িত নন। পুলিশ কথিত স্বাক্ষী ও কতিপয় অভিযুক্তকে সীমাহীন অত্যাচার নির্যাতন করে স্বাক্ষ্য আদায় করেছে। মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যার দিন(২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি) সাংসদ আমানুর রহমান খান রানা তাঁর নির্বাচনী এলাকা ঘাটাইলে পুলিশ প্রহরায় একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সন্ধ্যা থেকে রাত সোয়া ১১টা পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। সে সময়ে পুলিশ প্রটেকশনের জিডির কপিই তার প্রমাণ বলে দাবি করা হয়। কৌঁসুলীরা দাবি করেন, এমপি রানার ভাই পরিবহন নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি সপরিবারে ভারতে অবস্থান করছিলেন এবং ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা জেলা ছাত্রলীগ অফিসে সন্ধ্যা থেকে ফারুক হত্যার খবর পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন।”
এদিকে, টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-১ এর বিচারক আবুল মনসুর মিয়া চার্জ গঠন না করে আগামী ৯ নভেম্বর চার্জ গঠনের পাশাপাশি বিবাদী পক্ষের পুনতদন্তের আবেদনের ওপর শুনানীর তারিখ নির্ধারণের পরপরই ‘নির্যাতিত আওয়ামী পরিবার’ এর ব্যানারে বাদীপক্ষের আইনজীবী, জেলা আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের সহ¯্রাধিক নেতা কর্মী এমপি রানা ও তার তিন ভাই সহ সকল আসামীর ফাঁসির দাবিতে আদালত এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে। পরে তারা জেলা প্রশাসকের কার্যলয়ের সামনে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের, যুগ্ম-সম্পাদক ও মামলার বাদী নাহার আহমদ, জেলা আওয়ামীলীগের বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক তানভীর হাসান ছোট মনি, জেলা ছাত্রলীগের নেতা মনির সিকদার প্রমুখ।
চাঞ্চল্যকর বীরমুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা ও তার তিনভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সহিদুর রহমান খান মুক্তি, জেলার সাবেক ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পাসহ অপর আসামীরা হচ্ছেন, কবির হোসেন, সাবেক কমিশনার মাসুদ মিয়া, চাঁনে, নুরু, সানোয়ার হোসেন ও দাত ভাঙ্গা বাবু। এরা বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৩০২/৩৪/১২০ বি ধারায় হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে আসামী আনিসুল ইসলাম রাজা, মোহাম্মদ আলী ও সমির হোসেন আগেই গ্রেপ্তার হয়ে টাঙ্গাইল কারাগারে রয়েছেন। আসামী ফরিদ হোসেন কিছুদিন আগে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। আর আসামি আবদুল হক পলাতক অবস্থায় কয়েক মাস আগে দুস্কৃৃতকারীদের হাতে নিহত হন।
টাঙ্গাইল গোয়েন্দা পুলিশের(ডিবি) ওসি অশোক কুমার সিংহ জানান, দীর্ঘ সময় চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হয়েছে। সংক্ষুব্ধরা নানা রকম কথা বললেও তা আদৌ সত্য নয়।
প্রকাশ, ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি রাতে ফারুক আহমদের গুলিবিদ্ধ লাশ টাঙ্গাইলের কলেজপাড়া এলাকায় তাঁর বাসার সামনে পাওয়া যায়। ঘটনার তিন দিন পর তাঁর স্ত্রী নাহার আহমদ টাঙ্গাইল মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। প্রথমে থানা পুলিশ ও পরে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মামলার তদন্ত শুরু করে। ২০১৪ সালের আগস্টে ওই মামলার আসামি আনিছুল ইসলাম ওরফে রাজা ও মোহাম্মদ আলী গ্রেপ্তার হন। আদালতে তাঁদের স্বীকারোক্তিতে সাংসদ রানা ও তাঁর তিন ভাইয়ের এ হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়টি বের হয়ে আসে। এরপর থেকে সাংসদ ও তাঁর ভাইয়েরা আতœগোপনে চলে যান। টাঙ্গাইলের তথাকথিত প্রতাপশালী ‘খান সামাজ্যের’ পতন ঘণ্টা শুরু হয়।
এ বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সাংসদ রানা ও তাঁর তিন ভাইসহ ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়। ৬ এপ্রিল আদালত মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক সাংসদ রানাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। ১৭ মে ওই ১০ জনের বিরুদ্ধে হুলিয়া ও মালামাল জব্দ করার নির্দেশ দেন আদালত। ২০ মে পুলিশ সাংসদ ও তাঁর তিন ভাইয়ের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মালামাল জব্দ করে, তবে সেখানে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। ১৬ জুন আদালত আসামিদের হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার নির্দেশ দেন। সাংসদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি চিঠি দিয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে জানানো হয়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর সাংসদ রানা আদালতে আতœসমর্পন করেন। পরদিন তাকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে মামলার অন্যতম দুই আসামি সাবেক কাউন্সিলর মাসুদুর রহমান মাসুদ ও জেলা সেচ্ছাসেবকলীগ নেতা নুরউদ্দিন নুর আদালতে আতœসমর্পন করেন। আদালত তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সর্বশেষ ২৬ সেপ্টেম্বর এমপি রানার জামিন আবেদনের উপর শুনানী শেষে জামিন নামঞ্জুর করা হয়।