দৃষ্টি রিপোর্ট:
বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও অহংকারের মাস মার্চ। যে কয়টি মাস বাংলাদেশিদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, তার মধ্যে মার্চ মাস অন্যতম। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের মার্চেই ডাক এসেছিল বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনার এই মাসের ৭ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানের বিশাল সমাবেশে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ এ মাসের ২৫ তারিখে নিরীহ বাঙালির ওপর গণহত্যা চালায় তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক জান্তা। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের আপামর মানুষ স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেওয়ার চূড়ান্ত সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ রকম নানা আনন্দ-বেদনা-উত্তেজনায় একাত্তরের উত্তাল মার্চ বাংলাদেশিদের কাছে অত্যন্ত গর্বের মাস।
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার ‘একাত্তরের দশ মাস’ শীর্ষক গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন, ‘১৯৭১ সালের ১ মার্চ দুপুরে এক বেতার ঘোষণার মাধ্যমে ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ভাষণে তিনি বলেন, “পাকিস্তান আজ চরম রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন।… সে সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করার প্রয়োজন বোধ করছি। …আমি আমাদের জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের তারিখ ৩ মার্চ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলাম। বিগত কয়েক সপ্তাহ অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাকে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, ঐকমত্যে পৌঁছবার পরিবর্তে আমাদের কোনো কোনো নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছেন।… এছাড়া ভারত কর্তৃক সৃষ্ট সাধারণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে। অতএব, আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান পরবর্তী অন্য কোনো তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি (দৈ. পা.)।’
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এ ভাষণ রেডিওতে শোনামাত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-নেতাসহ সব শিক্ষার্থী দলে দলে ক্লাস থেকে, হল থেকে বেরিয়ে বটতলায় জড়ো হতে শুরু করেন। ছাত্র-সমুদ্রের একটি ঢেউ এসে ছড়িয়ে পড়ে বটতলায়। ছাত্রলীগ আর ডাকসু নেতারা সেদিন বিকাল ৩টায় পল্টনে প্রতিবাদ সভা করার সিদ্ধান্ত নেন।
ইয়াহিয়ার বেতার ঘোষণার পর ঢাকা এক মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। মতিঝিল হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে জড়ো হন বিক্ষুব্ধরা। ওই সময় সেখানে আওয়ামী লীগ পরিষদ দলের সভা চলছিল। বিক্ষুব্ধ জনতার ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি স্লোগানে ঢাকা মহানগরী আন্দোলিত হতে থাকে।
পহেলা মার্চ বিকালে হোটেল পূর্বাণীতে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পরদিন মঙ্গলবার ঢাকা শহরে হরতাল, বুধবার সারাদেশে হরতাল এবং ৭ মার্চ (রোববার) রেসকোর্স ময়দানে জনসভা করার ঘোষণা দেন। ৭ মার্চের জনসভায় পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচির রূপরেখা দেওয়ার কথা জানান তিনি।
দৈনিক পাকিস্তানের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১ মার্চ বিকালে পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় তোফায়েল আহমেদ, আবদুল মান্নান, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, নুরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ ছাত্র ও শ্রমিক নেতারা বক্তব্য দেন। নেতারা শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও নির্দেশ মতো আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
‘ইত্তেফাক’ সূত্রে জানা যায়, শেখ মুজিব এদিন ছাত্র-নেতাদের ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ নেতা নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন- এই চারজন এক গোপন বৈঠকে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন।
মূলত, এভাবেই ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে বাঙালির ধারাবাহিক স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষধাপের প্রতিরোধ শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দুই যুগের ধারাবাহিক শোষণের বলয় থেকে বের হয়ে মুক্তির স্বাদ নিতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে পুরো দেশ। স্ফুলিঙ্গের মতো ঝলসে ওঠে মুক্তির সংগ্রাম।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ১ মার্চের ঘোষণার দিন থেকেই সারাদেশে শুরু হওয়া সর্বাত্মক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সূত্রপাত ঘটে অসহযোগ আন্দোলনের। এক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিমা সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, রচিত হচ্ছিল বাঙালি নিধন আর তাদের চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার নীলনকশা। নানা কূটকৌশলে সময়ক্ষেপণের পর পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই বাংলায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৫ মার্চ পৃথিবীর ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ও বর্বরোচিত গণহত্যা চালায়। তবে অকুতোভয় বীর বাঙালিও দমে যাবার পাত্র নয়।
গণহত্যার মধ্যরাতেই শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি, ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র প্রতিরোধে।
অগ্নিঝরা মার্চকে বরণ করে নিতে মাসব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হবে। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হবে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জনকারী সূর্যসন্তানদের।
তথ্যসূত্র : একাত্তরের দশ মাস, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, গতিধারা ১৯৯৭, ঢাকা।