আজ- ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার  দুপুর ২:১৪

মুঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের কথা

 

দৃষ্টি ডেস্ক:

dristy-2
মুঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের জন্ম ১৫৭৭ সালের ৩১ মে। নূরজাহান হচ্ছে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেয়া নাম। কিন্তু তার আসল নাম ছিল মেহেরুন্নিসা। মেহেরের বাবা ছিল গিয়াস বেগ। তার বাবা গিয়াস বেগ ও মা যখন তেহেরান থেকে ভাগ্যের সন্ধানে হিন্দুস্তান আসছিলেন তখন পথের মধ্যেই নির্জন মরু প্রান্তে এক বাবলা গাছের তলায় জন্ম হয় মেহেরুন্নিসার। এই সময় গিয়াস বেগ ও তার পত্নী এমন দুর্দশায় পড়েছিলেন যে মেয়েকে বাঁচানোর কোনো উপায় না পেয়ে তারা পথের মাঝেই কচি মেয়েকে শুইয়ে রেখে রওনা হন। আশা ছিল কোনো সহৃদয় ব্যক্তি যদি তাকে পায় নিয়ে আশ্রয় দেবে। কিন্তু বাপ মায়ের মন। কিছুদূর যাওয়ার পরই শিশু কন্যার কান্না শুনে তারা আর থাকতে পারলেন না। ফিরে এসে মেয়েকে বুকে চেপে নিঃসহায়, নিঃসম্বল গিয়াস বেগ এসে পৌঁছালেন লাহোরে। এবার তার ভাগ্য পরিবর্তন হলো। আকবর বাদশার সুনজরে পড়লেন তিনি, আর ছোট মেয়ে মেহেরের স্থান হলো হেরেমে।
প্রথম বিয়ে : মেহেরের বিয়ে ঠিক হয় তুর্কিস্তানের খানদানি বংশের আলি কুলি বেগের সঙ্গে। আলি কুলি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, নির্ভীক ও সচ্চরিত্র যুবক। একলা খালি হাতে বাঘ মারার জন্য তার নাম হয় শের আফগান। শোনা যায় মেহের একবার যুবরাজ সেলিমের নজরে পড়ে যান। সেলিমও অমনি খেপে উঠলো মেহেরকে বিয়ে করার জন্য। বাদশাহ আকবরের কাছে আর্জি পৌছে গেল তার বিয়ের। কিন্তু নিজের বংশ মর্যাদার কথা ভেবে সেলিমকে নিষেধ করে আলি কুলির সঙ্গে মেহেরের বিয়ে দেন। মেহেরের বয়স তখন ষোলো। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে চলে যান বর্ধমান।
আলি কুলি প্রাণ হারান : ইতিহাসের পটপরিবর্তন হলো। আকবরের মৃত্যুর পর যুবরাজ সেলিম বসলেন সিংহাসনে। নাম নিলেন জাহাঙ্গীর। সম্রাট হয়েও জাহাঙ্গীর মেহেরকে ভুলতে পারলেন না। জাহাঙ্গীর ভেবেচিন্তে দেখলেন আলি কুলিকে যদি হত্যা (ঐতিহাসিক কোনো প্রমাণ নাই) করা যায় তবেই সে মেহেরকে বিয়ে করতে পারবে। তবে আলি কুলিকে হত্যা করা সহজ কাজ ছিল না। সম্রাট কৌশলের আশ্রয় নিলেন। শিকারে যাবার আমন্ত্রণ দিলেন আলি কুলিকে। সরল মনে আলি কুলি চললেন সম্রাটের সঙ্গে বাঘ শিকারে। ধূর্ত সম্রাট তাকে আদেশ দিলেন একটা ক্ষিপ্ত বাঘ মারার জন্য। কিন্তু সম্রাট তাজ্জব বনে গেলেন। আলি কুলি খালি হাতে বাঘটিকে হত্যা করল। এবার সম্রাট তাকে একটা পাগলা হাতির সামনে ফেলে দিল। কিন্তু এবারও আলি কুলি তার তলোয়ারের এক কোপে হাতির শুঁড় দু-ভাগ করে ফেলল। আলি বুঝতে পারল তাকে মারার ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি ফিরে গেলেন বর্ধমানে। জাহাঙ্গীর মরিয়া হয়ে বাংলার সুবেদার কুতুবকে নির্দেশ দিলেন আলি কুলিকে হত্যা করার জন্য। কুতুব তার মুঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের গল্পঅনুচরদের নিয়ে হত্যা করতে গিয়ে নিজে মারা পড়ল। হতভাগ্য আলি কুলি প্রাণ হারাল অনুচরদের গুলিতে।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিয়ে : শেরের মৃত্যুর পর মেহেরকে আগ্রাতে নিয়ে আসা হয়। তখন মেহেরের বয়স তেত্রিশ। ওই বয়সেও তিনি অপূর্ব রূপসী ছিলেন। মোঘল হেরেমে থেকেও দীর্ঘ চার বছর সম্রাটকে দেখেননি। তারপর আর পারলেন না সম্রাটকে ফেরাতে। সাঁইত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন জাহাঙ্গীরকে। জাহাঙ্গীর তার নাম দিলেন নূরজাহান বা জগতের আলো।
সম্রাজ্ঞী নূরজাহান : নূরজাহান শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলেন। তিনি প্রায়ই সম্রাটের সঙ্গে বাঘ শিকারে জেতেন। শক্তিশালী বাঘ শিকারি হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। কথিত আছে তিনি ৬টি গুলি দিয়ে ৪টি বাঘ শিকার করেছিলেন। তার বীরত্বের কবিতাও লিখেছেন অনেক কবি। ইংরেজ দূত টমাস রো লিখে গেছেন মেহের আসলে দেশ শাসন করত। জাহাঙ্গীর ছিল নামকাওয়াস্তে সম্রাট। সেই সময়কার মুদ্রাতে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নূরজাহানের ছবিও ছাপা হতো। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করতেন। জাহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষ দিকে যখন তার ছেলে খুররম ও সেনাপতি মহাব্বত খা বিদ্রোহ করেন তখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন নূরজাহান।
জিবনাবসান : নূরজাহানের শেষ জীবন সুখের হয়নি। তার বিরাট উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল এর জন্য দায়ী। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর নূরজাহানও লাহোরেই থেকে যান শেষ পর্যন্ত। অবশেষে বাহাত্তর বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ওই লাহোরেই। নূরজাহান নিজে ছিলেন কবি। তার কবরের গাঁয়ে তার রচিত দুটি লাইন দেখতে পাওয়া যায়। ফরাসিতে লেখা। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলায় অনুবাদ করেন
‘গরিব গোরে দ্বীপ জ্বেলো না,
ফুল দিও না কেউ ভুলে,
শ্যামা পোকার না পোড়ে পাখ,
দাগা না পায় বুলবুলে।’
নূরজাহানকে নিয়ে প্রচলিত গল্প: মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নাম শোনেনি এমন কোনো শিক্ষিত লোক পাকভারত-বাংলাদেশে আছে কিনা সন্দেহ। মহান সম্রাট আকবরের পুত্র সেলিম ৩৮ বছর বয়সে ১০৩৪ হিজরিতে জাহাঙ্গীর উপাধি নাম ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর জš§গতভাবে বহু গুণের অধিকারী ছিলেন। একদিকে যেমন ছিলেন বিরাট প্রভাবশালী সম্রাট, অপরদিকে তেমনি ছিলেন উš§ুক্ত হƒদয়ের প্রজা বৎসল শাসক। তিনি মনে প্রাণে সাধারণ প্রজাদের সুখ-শান্তি ও মঙ্গল কামনা করতেন। বাদশাহ জাহাঙ্গীর রাজ্যে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক ও তৎপর। সাধারণ প্রজারা যেন সহজে বিচার প্রার্থী হওয়ার সুযোগ লাভ করে ন্যায়বিচার লাভ করতে পারে এ লক্ষ্যে রাজদরবারে ইনসাফের জিঞ্জির ঝুলিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘সিংহাসনে উপবিষ্ট হওয়ার পরে সর্ব প্রথম যে নির্দেশ আমি জারি করেছি তা হলো ইনসাফের জিঞ্জির লটকানো হোক। উৎপীড়িত মজলুম জনগণের বিচারে বিচারালয় থেকে কোনো প্রকার ত্রুটি কিংবা অবহেলা পরিলক্ষিত হলে তারা যেন সরাসরি জিঞ্জিরের কড়া বাজিয়ে আমাকে অবগত করাতে পারে।’ এই জিঞ্জিরটির এক প্রান্ত ছিল আগ্রার শাহী মহলের চূড়ার উপরে অবস্থিত, আর অপর প্রান্ত ছিল যমুনা নদীর অপর পাড়ে পাথরের একটি স্তম্ভের ওপর লটকানো। এ শিকল টেনে বহু লোক জাহাঙ্গীরের ন্যায়পরায়ণতার প্রমাণ দিয়েছে। সম্রাট ন্যায়পরায়ণতা ছিল মায়া মমতার ঊর্ধ্বে। তিনি এ ব্যাপারেও এত কঠিন ছিলেন যে তা উপলব্ধি করা যায় সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের বিচারের কাহিনী থেকে। নূরজাহান ছিলেন জাহাঙ্গীরের চোখের জ্যোতি ও অন্তর মস্তিষ্কের মালিক। সম্রাট নিজে বলতেন, ‘নূরজাহান আমার মালিক কিন্তু আমার আদল ইনসাফের মালিক নয়।’ সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ছিলেন অপরূপ সুন্দরী, ভুবন মোহিনী চিত্তহারিণী সৌন্দর্যের অধিকারিণী। একদা বেগম নূরজাহান রাজপ্রাসাদের উপরে খোলা জায়গায় বসা ছিলেন। তাঁর সৌন্দর্যের জ্যোতি চারদিক আলোকিত করে ঠিকরে পড়েছিল। এমন সময় এক হতভাগা পথিকের দৃষ্টি পড়ে সম্রাজ্ঞীর ওপরে। নূরজাহান ব্যাপারটিকে সাধারণভাবে গ্রহণ করতে পারলেন না। তাঁর প্রতি পর পুরুষের নজরকে অপরাধজনক মনে করে রাগান্বিত হয়ে পথিকের প্রতি পিস্তলের গুলি ছুড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে হতভাগা পথিকটির মৃত্যু ঘটে।
কিন্তু এমন ঘটনাটি চাপা রইল না। খবরটি পৌঁছে যায় জাহাঙ্গীরের কানে। মহামতী সম্রাট ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিলেন। বেগম নূরজাহান অত্যন্ত খোলা মনে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করলেন। জাহাঙ্গীর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এ অপরাধের বিচারের ফয়সালা চেয়ে পাঠান মুফতি সাহেবের কাছে। মুফতি বিচারের রায়ে সম্রাজ্ঞী নূরজাহানকে হত্যার নির্দেশ দিলেন স্বয়ং সম্রাট জাহাঙ্গীর। সম্রাজ্ঞীর প্রতি এমন কঠোর আদেশ শুনে দরবারের সবার অন্তর কেঁপে উঠল।
বেগম নূরজাহান ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রাণপ্রিয়। তার নির্দেশেই প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো। সেই প্রতাপশালিনী প্রাণপ্রিয় রানীর বিরুদ্ধে শিরñেদের আদেশ। রাজদরবারের সবার অন্তরে বেদনার বান উথলে উঠল। কিন্তু হৃদয়ে ভাবান্তর হলো না একমাত্র জাহাঙ্গীরের। তিনি অন্দর মহলে প্রবেশ করে দাসীদের প্রতি হুকুম দিলেন নূরজাহানকে শিকল পরিয়ে রাজদরবারে হাজির করতে। যেই হুকুম সেই কাজ। অন্তরে ব্যথা নিয়ে দাসীরা তাদের প্রিয় সম্রাজ্ঞীকে বাদশার হুকুমে শিকল পরিয়ে রাজদরবারে হাজির করল। নূরজাহান এমন আচরণের কোনো বিরোধিতা করলেন না। বাদশাহর হুকুমে জল্লাদ এলো তলোয়ার নিয়ে নূরজাহানের শিরñেদ করতে। নূরজাহান অসহায়। বুদ্ধিমতী বেগম সাহস করে জাহাঙ্গীরের কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, ‘জাঁহাপনা, শরিয়তে বিধান রয়েছে খুনের বদলা পরিশোধ করার। আমি খুনের বদলা পরিশোধ করে মুক্তি পেতে পারি কি না?’
এ সওয়ালের জওয়াব দিতে জাহাঙ্গীর আবার মুফতির কাছে ফতোয়া চাইলেন। মুফতি জবাব দিলেন, হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তির অলিগণ যদি রাজি হয় তাহলে খুনের বদলা দেয়ার বিধান শরিয়তে রয়েছে। শরিয়তের বিধান অনুযায়ী বেগম নূরজাহান নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণকে এক লাখ দিরহাম দিয়ে খুশি করলেন। তারা এভাবে খুনের বদলা গ্রহণ করে সম্রাটকে বলল, ‘আমরা কিসাস চাই না। আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি সম্রাজ্ঞীর ওপর থেকে কিসাসের হুকুম বাতিল করুন।’ সম্রাট জাহাঙ্গীর তাদের এমন ব্যবহারে খুশি হয়ে প্রিয়তমা সম্রাজ্ঞীকে কঠিন শাস্তির হাত থেকে মুক্তি দিলেন। এমন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ হত্যার ইনসাফের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে সারা বিশ্বকে আলোকিত করে আজো মানুষের অন্তরে শ্রদ্ধাসিক্ত হয়ে বেঁচে আছেন। তিনি মারা যান ১৬৪৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর।

সূত্র: অনলাইন।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno