আজ- শুক্রবার | ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
২৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ভোর ৫:৩০
১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
২৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১
১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

শাকিল ও শাহীন স্মরণেঃ এ ভার বড় কষ্টের

*মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল*

untitled-1-copy
হৃদপিন্ডের পাঁজরগুলো চেপে বসছে, চোখের কোণ ঝাপসা হয়ে নোনতা জল বেড়িয়ে জানান দিচ্ছে ‘আমি শোকসন্তপ্ত’। এই তো সেদিন না ফেরার দেশে যাত্রা করলো সতীর্থ-সহমর্মী এহসানুল হক খান শাহীন। ক’দিন আগে ঢাকা মেডিকেলে দীর্ঘ ১২দিন আইসিউতে থেকে ৩০ নভেম্বর সকালে চলে যান পরলোকে। শোক ও স্মৃতির বেগে ঝলসে গিয়েছিল ভিতরটা। মাত্র এক সপ্তার ব্যবধানে আমার(বয়সের ব্যবধান সত্তেও) পরমবন্ধু-শ্রদ্ধার পাত্র, যেকোন ভাল কাজে সহযোগী প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী, বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক মাহবুবুল হক শাকিল না ফেরার দেশে পাড়ি জমালো। তাঁর অকাল মৃত্যু আমাকে চমকে দিয়েছে। একে একে ছোটরা সবাই চলে যাচ্ছে- এ ভার বড় কষ্টের, বড় যন্ত্রণার।

মৃত্যু তো মৃত্যুই, একে বিশেষায়িত করা যায়- লঙ্ঘণ নয়। প্রতিটি পরিবার প্রিয়জনকে হারিয়ে সমানভাবেই বিলাপ করে। কিন্তু কিছু মৃত্যু কাউকে কাউকে নির্বাক করে দেয়। পেশাদার সতীর্থের চোখের পানি চোখেই শুকায়। পথহারা পাখিরাও অনেক সময় খাবি খায়। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও গুনী সাহিত্যিক মাহবুবুল হক শাকিল এবং টাঙ্গাইলের সাংবাদিকতায় দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলা এহসানুল হক খান শাহীনের প্রস্থানে আমরা বিচলিত। বলে নেই, এ লেখাটি আমাকে কেউ লিখতে বলেনি, মানে কোন সম্পাদক বা প্রকাশক তাগিদ দেননি- হৃদপিন্ডের শিরা-উপশিরাগুলোতে প্রবাহমান রক্তকণিকা বিদ্যমান ’রিপু’কে স্পর্শ করায় এলেখার অবতারনা।

ব-দ্বীপের এই জনপদের মানুষ এবং প্রাণি প্রজাতি পরস্পরের সাথে এতই ঘনিষ্ঠভাবে সঙ্ঘবদ্ধ যে, এখানে টিকে থাকার সংগ্রাম সবাই মিলেই। এভাবেই আমরা হাজার হাজার বছর ধরে এই জনপদে টিকে আছি। এখানকার মানুষ কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এখানে পাহাড় আছে, বিশাল সমুদ্র সৈকত আছে। লড়াইয়ের ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। তাই বলে সব মানুষ পদ্মা বা যমুনায় মাছ ধরতে যায়নি। কিন্তু ইলিশ আমাদের রসনা তৃপ্তির উপপদ। সব মানুষ চিনিগুঁড়া চাল ফলায় না। কিন্তু উৎসব আয়োজনে আমরা সবাই কিনি। যারা ইলিশ ধরে কিংবা চিনিগুঁড়া ফলায়, তারা আমাদের নিকট আত্নীয়। তাদের অনেকের সঙ্গেই আমাদের দেখা-সাক্ষাত হয়নি। কিন্তু তাদের ছাড়া আমাদের চলে না। দেশের নদী ও মনুষ্য প্রাণির মধ্যে রয়েছে পরস্পর নির্ভরশীলতা। বাংলাদেশের নদীতে অবিরাম ভাঙা-গড়ার খেলা চলে। ‘নদী এপার ভাঙে, ওপার গড়ে/এই তো নদীর খেলা।’ গানটি শোনেনি এমন লোক পাওয়া ভার! প্রতি বছর নদ-নদীগুলো শত শত জনপদ তছনছ করে দিয়ে যায়। সাজানো সংসার, গরু-বাছুর, শস্যত্রে সবকিছু গ্রাস করে নেয় নদী। যারা জীবিত থাকেন, তারা পরস্পরে সহযোগিতায় ওপারের নতুন চরে গড়ে তোলেন নতুন বসতি। বসতি গড়ে তোলার েেত্র বিনা মজুরিতে এই জনপদের মানুষ একে অপরের জন্য শ্রম দেন। এ হাজার বছর ধরে চলে আসছে। শৈশব-কৈশোরে দেখেছি, আষাঢ় মাসে শুকনো খালে কোথা থেকে যেন বন্যার পানি এসে ভরিয়ে দিত। সে পানির সাথে আসত তিতপুঁটি, ট্যাংরা, ছোট টাকি মাছ। আমরা গামছা দিয়ে কিংবা হাত বড়শি দিয়ে সেসব মাছ ধরে আনন্দে খলবল করতাম। কিন্তু এই পানির সাথে নতুন বিপদও আসত। তা হলো, পাকা, আধাপাকা কিংবা থোড় ধানের জমি ডুবে যাওয়া। এই পরিস্থিতি যখন হতো, তখন হিন্দু, মুসলমান, ব্রাক্ষ্মণ, শুদ্র, মুচি, চাড়াল তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য বংশীয় পার্থক্য ভুলে সবাই একযোগে ওই ফসল কেটে জমির মালিকের ঘরে তুলে দিত। বিনিময়ে সাধ্য থাকলে মালিক পাতলা ঝোলের গরু কিংবা মুরগির গোশত দিয়ে, সাধ্য না থাকলে ডাল-ভাত দিয়ে এবং আরো দরিদ্র হলে কিছুই না দিয়ে শুধু পরস্পরকে আলিঙ্গন করে অশ্রুসিক্ত হৃদয়ে বিদায় দিতো। মুসলমানের শস্যত্রে ডুবলে যেমন হিন্দু হাত লাগাত, তেমনি হিন্দুর জমি ডুবলে মুসলমান হাত লাগাত। কোন কোন এলাকায় এখনো লাগায়। এটাই আমাদের স্বদেশ। এক অমিয় সম্প্রীতির বন্ধনের বাংলাদেশ।

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মাহবুবুল হক শাকিল আর টাঙ্গাইলের পলাশতলীর এহসানুণ হক শাহীন একই বৃক্ষের এ ডাল- সে ডাল।
ময়মনসিংহে স্থানীয় ছাত্র ইউনিয়নের পরে ছাত্রলীগ এবং এক সময়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিনিয়র সহ-সভাপতি শাকিল’র সঙ্গে আমার পরিচয় রাজধানীর নিউ মার্কেটের আজিজ প্লাাজায়। তারপর আরো বেশ কয়েকবার দেখা-সাাতে মোগলাই-আইসক্রিম ছাড়াও ভারি খাবার গলধকরণ করেছি। সে সময়ে সরকারের অবস্থান, স্থায়িত্ব, বর্তমান রাজনীতি, আগামীর রাজনীতি, কবিতা ও সাহিত্যের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ এসব বিষয়ে বিস্তর কথা হয়েছে- কথা হয়েছে বাংলা ভাষায় ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রভাব নিয়েও; স্মৃতি চারণে আমি টাঙ্গাইলের আমঘাট রোড আর শাকিল গফরগাঁওয়ের পাশাপাশি ময়মনসিংহের গাংঙ্গিনার পাড়কে বাদ দিয়ে কথা বলেছি এমনটি হয়নি। এসবই এখন স্মৃতি, শাকিল অকাল।

শহরের পলাশতলীর এহসানুল হক খান শাহীন সর্বশেষ দৈনিক আমাদের সময় ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি ছিলেন। বর্তমানে মানবকণ্ঠ ও মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি একরামুল হক খান তুহীন আর আমি একত্রে অধুনালুপ্ত আজকেরকাগজে কাজ করেছি, অথচ শাহীনের কাছ থেকেই প্রথম জেনেছি তুহীন তার বড় ভাই। সাংবাদিকতা ও বয়য়ে বড় হলেও আমাদের সম্পর্ক ছিল চমৎকার। সাংগঠনিক বা অন্য কোন কারণে শাহীনকে আমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হয়নি, আমারও তাই। টাঙ্গাইল প্রেসকাবের প্রায় সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক থাকলেও শাহীনের সাথে আমার ‘ভাব’টা বেশি ছিল। দেখা হলেই চমৎকার একটা হাসি দিয়ে কুশল বিনিময় করতেন।

কতো ছোটখাট বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে ইয়ত্বা নেই। সংবাদ বিবরণীতে কখন ি -কার হবে আর কখন ী-কার, কেন বিকাল না হয়ে বিকেল- সন্ধ্যার স্থলে সন্ধ্যে লিখবে, তাহলে কেন সকাল-এর স্থলে সকেল হবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথামালা। সামসময়িক রাজনীতিও বাদ যায়নি আলোচনা থেকে ‘খান’দের অবস্থানের কোন পরিবর্তন ঘটবে কি-না, মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যাকান্ডের পরিণতি কি? লতিফ সিদ্দিকীকে আওয়ামীলীগে ফিরিয়ে নিতে কোন প্রক্রিয়া চলছে কি-না, কাদের সিদ্দিকী কৃষক শ্রমিক দল নিয়ে দেশে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন প্রভৃতি। টাঙ্গাইলের মিডিয়ায় যে হারে জামায়াত-বিএনপি মতাদর্শের লোকজন প্রভাব বিস্তার করছে তা নিয়ে বিচলিত বোধ করতেন, অবলীলায় এসব নানা বিষয় শেয়ার করতেন শাহীন।

মৃত্যু তো অমোঘ, অবধারিত। এই কঠিন সত্যকে স্বীকার করে নিয়েই মানুষের পথচলা। জীবনের এক সিংহদ্বার থেকে আর এক সিংহদ্বারে পৌঁছে যাওয়া। মৃত্যুকে মেনে নিয়েই জীবনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য লড়াই করা। কিন্তু তারপরও এমন কিছু মৃত্যু আছে, যাকে সহজ মনে মেনে নেয়া যায় না। পূর্ণতার প্রান্তে পৌঁছে পরিণত বয়সে মৃত্যু প্রকৃতিরই দাবি। কিন্তু অপূর্ণ জীবনের অসময়োচিত মৃত্যু কখনই অভিপ্রেত হতে পারে না।

সদা বিনয়ী, মিশুক শাকিল আর শাহীন মাত্র এক সপ্তার ব্যবধানে লোকান্তরে। তাঁদের এই চলে যাওয়া, বলা যায় সময়ের একটু আগেই এই প্রস্থান তাঁদের স্বজন, সান্নিধ্য পাওয়া মানুষদের জন্য অত্যন্ত বেদনার। এ আমারও হৃদয়-মস্তিস্কে এক চরম আঘাত। তাঁদের অতল শ্রদ্ধা ও জান্নাত কামনা করছি।

শেয়ার করুন স্যোশাল মিডিয়াতে

Facebook
Twitter
LinkedIn
X
Print
WhatsApp
Telegram
Skype

সর্বশেষ খবর

এই সম্পর্কিত আরও খবর পড়