দৃষ্টি নিউজ:

আফ্রো, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার মেহনতি বুভুক্ষ মানুষের অধিকার আদায়ের পথিকৃৎ মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৯তম ওফাতবার্ষিকী আগামিকাল সোমবার(১৭ নভেম্বর)। বঙ্গীয় এ দ্বীপে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের এই দিনে ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়।
ভাসানীর ওফাতবার্ষিকী উপলক্ষে টাঙ্গাইলের সন্তোষে মরহুমের মাজার প্রাঙ্গণে তার পরিবার, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মুরিদান, ভক্ত, রাজনীতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে। এদিন টাঙ্গাইল শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা শাখা আয়োজিত ‘গণঅভ্যুত্থান-২৪ পরবর্তীতে বর্তমানেও বাংলাদেশে মওলানা ভাসানীর প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। এছাড়া এ উপলক্ষে ভাসানীর মাজার প্রাঙ্গনে সাত দিনব্যাপী মেলা চলছে।
মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী অধিকার বঞ্চিত, অবহেলিত ও মেহনতি মানুষের অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় আজীবন নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করে গেছেন। জাতীয় সংকটে জনগণের পাশে থেকে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি দেশ ও জনগণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন।
বুজুর্গ পীর মওলানা ভাসানী সবসময় ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন। ক্ষমতার কাছে থাকলেও তাকে কখনো ক্ষমতার মোহ আবিষ্ট করেনি। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন নির্মোহ, অনাড়ম্বর ও অত্যন্ত সাদাসিধে। তার সাধারণ জীবনযাপন দেশ ও জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রতিফলন। শোষণ ও বঞ্চনাহীন, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের জন্য মওলানা ভাসানী আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পাবনা জেলা বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার সয়া-ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হাজী শরাফত আলী এবং মজিরন বিবি বা মাজিরান্নেসা বিবির তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ও একমাত্র জীবিত সন্তান। ছেলে-মেয়ে বেশ ছোটো থাকা অবস্থায় হাজী শারাফত আলী মারা যান। কিছুদিন পর এক মহামারীতে মজিরন বিবি বা মাজিরান্নেসা বিবি ও দুই ছেলে মারা যায়। বেঁচে থাকেন ছোট্ট শিশু আব্দুল হামিদ খান। তাকে ছোটবেলায় ‘চেগা মিয়া’ নামে ডাকা হতো। কারণ তার পিতা হাজী শরাফত আলী এই নামে ডাকতেন।
‘চেগা’ শব্দটি এসেছে প্রমিত অসমিয়া-বাংলা উপভাষা থেকে। এর অর্থ- ফাটা কাপড় পরা বালক বা ছেঁড়া জামা পরা শিশু। কারণ, ছোটবেলায় আব্দুল হামিদ খানের পরনের কাপড় প্রায়ই ছিল ছেঁড়া, পুরনো ও জোড়াতালি দেওয়া। তিনি ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন না বরং এক সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন। সেই কারণে গ্রামবাসীও স্নেহভরে ও কখনো কখনো মজা করে তাঁকে ‘চেগা মিয়া’ বলে ডাকতেন।
পিতৃ-মাতৃহীন আব্দুল হামিদ প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থাকেন। বাল্যকালে মক্তব হতে শিক্ষাগ্রহণ করে কিছুদিন মক্তবেই শিক্ষকতা করেন আব্দুল হামিদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে ১৮৯৩ সালে তিনি পাঁচবিবির জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাররেসের কাজ করেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে পীর সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের সাথে আসাম গমন করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ইসলামি শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে আব্দুল হামিদ অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ‘স্বরাজ্য পার্টি’ গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৬ সালে আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। সেখানেই সর্বপ্রথম তাঁর নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়।
দীর্ঘদিন তিনি তৎকালীন বাংলা-আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ১৯৫৭ সালের ৬ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টাঙ্গাইলের কাগমারী নামক স্থানে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ঐতিহাসিক ‘কাগমারী’ সম্মেলনে তিনি ‘ওয়াআলাইকুম আসসালাম’ বলে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্বপাকিস্তানের সম্পর্কচ্ছেদের ইঙ্গিত দেন এবং পাকিদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘খামোশ’ বলে হুঙ্কার ছাড়েন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে গঠিত প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামন্ডলীর সভাপতি ছিলেন।
সিরাজগঞ্জে জন্ম হলেও তার জীবনের বড় অংশই কাটিয়েছেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। তিনি তার কৈশোর-যৌবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জীবদ্দশায় মওলানা ভাসানী তিনটি বিয়ে করেন। প্রথম বিয়ে করেন, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি জমিদার কন্যা আলেমা খাতুন ভাসানীকে। প্রথম ঘরে ৪ সন্তান দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। দ্বিতীয় বিয়ে করেন, টাঙ্গাইলের কাগমারী এলাকার আকলিমা খান ভাসানীকে। আকলিমা খান ভাসানীর দাম্পত্য জীবন মাত্র ছয় মাস স্থায়ী হওয়ার পর তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তৃতীয় বিয়ে করেন বগুড়া জেলার আদমদীঘির হামিদা খান ভাসানীকে। হামিদা খান ভাসনীর প্রকৃত নাম ছিল উসিলা খাতুন। বাসর রাতে আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আদর করে তার নাম রাখেন হামিদা খান ভাসানী। হামিদা খান ভাসানীর ঘরের ৩ সন্তান বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত।
মওলানা ভাসানীর ৪৯তম ওফাতবার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার(১৭ নভেম্বর) সকালে তাঁর মাজারে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়েও পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে। কিছুদিন আগে থেকেই মওলানা ভাসানীর ভক্ত-অনুসারী ও মুরিদানরা সন্তোষে এসেছেন। এদিকে ভাসানীর ওফাতবার্ষিকী উপলক্ষে মওলানা ভাসানী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সাত দিনব্যাপী ‘ভাসানী মেলা’ চলছে। মঙ্গলবার(১১ নভেম্বর) সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলের পৌর এলাকার সন্তোষ মাজার প্রাঙ্গনে সাত দিনব্যাপী ভাসানী মেলা-২০২৫ এর উদ্বোধন করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য(ভিসি) অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল আজীম আখন্দ।
এ উপলক্ষে এদিন টাঙ্গাইল শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা শাখা আয়োজিত ‘গণঅভ্যুত্থান-২৪ পরবর্তীতে বর্তমানেও বাংলাদেশে মওলানা ভাসানীর প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।
সভাপতিত্ব করবেন, জেলা শাখার সভাপতি সাইফুর রহমান রেজা ও সঞ্চালনা করবেন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা আওয়াল মাহমুদ। সভায় বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, বহ্নিশিখা জামালী, বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু সহ অন্যান্য নেতারা বক্তব্য রাখবেন।
মওলানা ভাসানী ফাউন্ডেশন ও খোদা-ই-খেদমতগার এর আয়োজনে মওলানা ভাসানীর ওফাতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছরের ন্যায় দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ, ওরশ, স্মরণ সভা, গণভোজসহ সাত দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
