আজ- মঙ্গলবার | ২১ অক্টোবর, ২০২৫
৫ কার্তিক, ১৪৩২ | সন্ধ্যা ৬:৫৬
২১ অক্টোবর, ২০২৫
৫ কার্তিক, ১৪৩২
২১ অক্টোবর, ২০২৫, ৫ কার্তিক, ১৪৩২

আজন্ম শিকলে বন্দি সাইফুলের জীবন

ঘাটাইলে এক মানসিক প্রতিবন্ধী ভিক্ষায় নির্ভরশীল

দৃষ্টি নিউজ:

টিনের ঘরের বারান্দায় সিমেণ্টের খুঁটির সঙ্গে লম্বা শিকলে বাঁধা এক যুবক। নাম সাইফুল ইসলাম। শিকলে সর্বক্ষণ তালা দেওয়া। ঘরের মেঝেতে বেতেরপাটি বিছানো। মন চাইলে ওখানেই সাইফুল ঘুমিয়ে যায়। নয়তো বড় বড় চোখ মেলে অন্ধকারে চেয়ে থাকেন। দিনের আলোয় পায়ে শিকল বন্দি অবস্থায় আশপাশের পরিচিত মানুষের দেখা পাওয়া যায়। মানুষ দেখলে বড় বড় চোখ করে চেয়ে থাকেন আর নাগালে পেলেই জাপটে ধরেন, খামচি কিংবা কামড়ে দেন। তার মুখের কোনো ভাষা নেই। হাউ মাউ করে যা বলেন তা কেউ বুঝতে পারেন না। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে একটি ঘরে লোহার শিকলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন সাইফুল। জন্মের পর থেকে অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত তিনি। মানসিক সমস্যায় জর্জরিত সাইফুলের সুস্থতার কোনো লক্ষণ নেই। বাবা বহর আলী মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। সাইফুলের বিধবা মা রহিমা বেগম জমিজমা হারিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনের ঘানি টানছেন। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ধারিয়াল গ্রামের বহর আলী ও রহিমা বেগমের সংসারে ১৯৮৮ সালের ২৯ মার্চ সাইফুল জন্মগ্রহণ করেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রতিবন্ধী সাইফুল ইসলামের মা রহিমা বেওয়া জানান, জন্মের পর থেকে সাইফুল যেকোনো মানুষ দেখলেই ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকত। ধীরে ধীরে সাইফুল হাঁটাচলা শিখতে থাকে। এক অন্যরকম পরিবেশে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। সাইফুল কথা ঠিকমত বলতে পারতো না। ওর বয়সী কিংবা অন্য কোনো মানুষ দেখলেই বড় বড় করে চেয়ে থাকতো- এটা যে অসুস্থতার লক্ষণ ছোটবেলায় তা তারা বুঝতে পারেননি। সাত বছর বয়স থেকে মানুষের দিকে শুধু চেয়ে থাকা নয়, মানুষ দেখলে তাদের খামচি ও কামড় দেওয়ার চেষ্টা করত। এসব কাজ থেকে সাইফুলকে ফেরানোর চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে এলাকাবাসী তার আচরণে ভয় পেতে শুরু করে। এলাকাবাসী ও নিজেদের রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে ৮ বছর বয়সে ১৯৯৫ সালে ওর পায়ে লোহার শিকল পড়িয়ে দেন- যা এখন পর্যন্ত বহাল রয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

তিনি জানান, শিকল খুলে দিলেই বড় বড় চোখ করে মানুষের দিকে তেড়ে যায়। ওর জীবন শিকলবন্দি জীবন, এই জীবনে ওর শান্তি নাই। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন ডাক্তার-কবিরাজের পেছনে ঘুরে ঘুরে রহিমা বেওয়া তার ছেলে সাইফুলের চিকিৎসা করিয়েছেন- কিন্তু সুস্থ করতে পারেন নাই। ডাক্তার-কবিরাজরা রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হওয়ায় পাবনা মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রে(পাগলাগারদ) নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পাগলাগারদে কীভাবে নিয়ে যাবেন তা ভেবে কূল-কিনারা না পাওয়ায় সেখানে নেওয়া হয়নি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ধারিয়াল গ্রামের বহর আলী ও রহিমা বেগমের সংসারে সাইফুল ছাড়া রহিজ ও বাচ্চু নামে আরো দুটি ছেলে আছে। বয়সে তারা সাইফুলের বড়। বিয়ে করে গাড়ি চালনায় যুক্ত দুই ভাই অল্পআয়ে পৃথকভাবে সংসার পেতেছেন। ছেলে অসুস্থ ও ভূমিহীন থাকায় সাইফুলের মা রহিমা বেওয়া সরকারের দেওয়া বাড়িতে বসবাস করছেন। সরকার থেকে ছেলের নামে ২৫০০ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা এবং মায়ের নামে ১৮০০ টাকা বিধবা ভাতা দেওয়া হয়। ওই টাকায় তাদের সংসার চলে না। ফলে ছেলের চিকিৎসা বন্ধ রেখে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এ বেঁচে থাকার মানে কী? সাইফুল তা জানে না। সাইফুল জানে ক্ষুধা পেলে খেতে হবে।

সাইফুলকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় খাবার দেওয়া ও বেতেরপাটির বিছানায় শোবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিকলবন্দি অবস্থায়ই তাকে গোছল করানো হয়। সবার মত সকালে দাঁত ব্রাস বা মাঝা কিংবা মুখ ধোয়া কখনও হয়না। মানুষ দেখলেই বড় বড় চোখে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে! মানুষের প্রতি তার কি রাগ- তা জানা যায়নি। অদ্ভুত রোগাক্রান্ত সাইফুল কথাই বলতে পারেনা।

 

 

 

 

 

 

 

স্থানীয় ধারিয়াল জামে মসজিদের সাধারণ সম্পাদক সুমন আল মামুন বলেন, সাইফুল একজন নিরীহ ও অভাবগ্রস্ত অসুস্থ মানুষ। মানুষ দেখলেই বড় বড় চোখ করে তেড়ে আসে। নাগালে পেলে খামচি ও কামড় দেয়, ঝাপটে ধরে। এসব কারণে বাধ্য হয়ে ওর মা তাকে শিকলে বেঁধে রাখে। এলাকাবাসীর সাহায্য ও সহযোগিতায় ওরা মা ছেলেকে নিয়ে বেঁচে আছেন।

 

 

 

 

 

 

 

ঘাটাইল পৌরসভার ৬নং বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. জালাল হোসেন জানান, সাইফুল তার সমবয়সী হবে। ছোটবেলা থেকেই তারা সাইফুলকে দেখছেন। ছোটকাল থেকেই ওর মানসিক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু দারিদ্রতার কারণে সঠিক সময়ে ওর চিকিৎসা করানো হয়নি। অদ্ভুত রোগটা নিয়ে ধীরে ধীরে সাইফুল বড় হলে- এটা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। ওকে ছেড়ে দিলেই মানুষকে কামড় দিতে যায়। যাকে সামনে পায়, তাকেই ঝাপটে ধরে। সুযোগ পেলে শরীরের কাপড় খুলে ফেলে। তাই এলাকাবাসী বাধ্য হয়ে এই অভাবী পরিবারের সন্তানকে শিকলে বেঁধে রাখতে বাধ্য করেছেন। এছাড়া অন্য কোনো উপায় তাদের কাছে নেই।

 

 

 

 

 

 

 

এ বিষয়ে ঘাটাইল উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান সরকার জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি জানেন না। তিনি দ্রæত তথ্য নিয়ে কিভাবে সহায়তা করা যায়- সে চেষ্টা করবেন।

 

 

 

 

 

 

 

ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবু সাঈদ জানান, এ বিষয়ে তিনি এখনও পর্যন্ত কিছু জানেন না। তবে সরকার থেকে প্রাপ্ত ভাতায় যদি তাদের অভাব সংকুলান না হয় তাহলে তাদের পরিবারকে সহযোগিতার জন্য এলাকাবাসীকে উদ্বুদ্ধ করবেন।

 

 

 

 

 

 

শেয়ার করুন স্যোশাল মিডিয়াতে

Facebook
Twitter
LinkedIn
X
Print
WhatsApp
Telegram
Skype

সর্বশেষ খবর

এই সম্পর্কিত আরও খবর পড়