আজ- বুধবার | ১ অক্টোবর, ২০২৫
১৬ আশ্বিন, ১৪৩২ | দুপুর ২:০৫
১ অক্টোবর, ২০২৫
১৬ আশ্বিন, ১৪৩২
১ অক্টোবর, ২০২৫, ১৬ আশ্বিন, ১৪৩২

এক সপ্তায় পাঁচটি চাঞ্চল্যকর ধর্ষণ ॥ সামাজিক অস্থিরতা দায়ী, দাবি বিশেষজ্ঞদের

বুলবুল মল্লিক:

টাঙ্গাইলে একসপ্তাহে পাঁচটি চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর দুটিতে সৎ’বাবা ও চাচা কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছেন, একটি অপহণের পর ধর্ষণ এবং অপর দুটিতে স্কুলছাত্রী ধর্ষিত হয়েছেন। চারটি ঘটনাই যৌন লালসা চরিতার্থ করার হীন মানসে সংঘটিত হয়েছে। একটি ঘটনায় পালাক্রমে তিন যুবক ধর্ষণে অংশ নিয়েছে। সামাজিক অস্থিরতা ও পারিবারিক অশান্তিতে নৈতিক বৈকল্যকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানাগেছে, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার যদুনাথপুর ইউনিয়নের বারইপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণিতে পড়–য়া মেধাবী ছাত্রীকে সোহেল রানা(৩৭) নামে এক লম্পট মুখে গামছা বেঁধে ধর্ষণ করে। শুক্রবার(৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় বাড়ির পাশে একা পেয়ে মুখে গামছা বেঁধে পাশের বাড়ির গোয়াল ঘরে নিতোকে ধর্ষণ করা হয়। মেয়েটির কান্না-কাটিতে আশপাশের লোকজন এসে মেয়েটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে এবং ধর্ষক সোহেল রানাকে হাতে নাতে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। ন্যাক্কারজনক এ ঘটনার ধর্ষক সোহেল রানা একই উপজেলার পাইস্কা ইউনিয়নের গাড়াখালী গ্রামের মফিজ উদ্দিনের ছেলে।
এ ঘটনায় এলাকায় নিন্দার ঝড় উঠেছে। প্রতিবাদে সহপাঠী শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নিন্দার ঝড় উঠেছে। ধর্ষণের ঘটনায় ধনবাড়ী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করে ধর্ষক সোহেল রানাকে আদালতের মাধ্যমে জেল-হাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার মালিরচালা(বাগামারি পাড়া) গ্রামে সৎ’বাবার যৌন লালসার শিকার হয়ে মেয়ে আমিনা খাতুন(১৮) এখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এ ঘটনায় আমিনা খাতুন বাদী হয়ে সৎ’বাবা কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেছেন।
জানা যায়, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কালাইপাড় গ্রামের আমির হোসেনের সাথে বিয়ে হয় বানেছা বানুর। তাদের ঘরে আমিনা খাতুন নামে এ কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। মেয়েটির বয়স যখন ৩-৪ বছর তখন আমির হোসেনের সাথে বানেছা বানুর বিচ্ছেদ হয়। ফলে মায়ের সাথেই শিশু কন্যা আমিনা চলে আসে নানার বাড়ি ঘাটাইলের সাগরদিঘী এলাকার ফুলমালীরচালা গ্রামে। ওই বাড়িতে লম্পট কামরুল ইসলামের যাতায়াতের এক পর্যায়ে বানেছা বানুর সাথে সক্ষতা হয়। সখ্যতার এক পর্যায়ে বানেছা বানুকে বিয়ে করে কামরুল। বিয়ের শর্ত থাকে বানেছা বানুর মেয়ে আমেনাকে কামরুল মেয়ে হিসেবে দেখভাল করবে। পরে বানেছা বানু জানতে পারে তার স্বামী কামরুল ইসলাম এর আগেও একাধিক বিয়ে করেছিল। তারপরও দ্বিতীয় বিয়ে হওয়ায় আশায় বুক বেধে ঘর-সংসার করতে থাকে বানেছা বানু। প্রথম কয়েক বছর ভালই চলছিল তাদের সংসার। কিছুদিন পর মেয়ে আমিনার উপর লম্পট কামরুলের কু-দৃষ্টি লক্ষ্য করে তার মা বানেছা বানু মেয়ে আমিনাকে নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এ নিয়ে লম্পট কামরুলকে সতর্কও করে দেয় বানেছা বানু। এতে তার উপর পাশবিক নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। নানা ছল-ছুতোয় বানেছাকে মারধর করে কামরুল। এমতাবস্থায় গত ২ ফেব্রুয়ারি আমেনা খাতুন তার মাকে দেখতে যায়। সে রাতে বানেছা বানু ঘুমিয়ে পড়লে আমেনা খাতুনকে সৎ’বাবা কামরুল ইসলাম ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় টাঙ্গাইলের আদালতে মামলা দায়ের করলেও মামলা তুলে নিতে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমিনা খাতুন বর্তমানে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এদিকে, টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ডুমনী বাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির একছাত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণের তিন দিন পর শনিবার(৫ আগস্ট) মামলা নিয়েছে পুলিশ।
মেয়েটির পরিবারের অভিযোগ, এ ঘটনায় ধর্ষকের সহযোগী সখীপুর উপজেলার কালিয়ান গ্রামের শাকিল ও মাসুদ নামে দুইজনকে আটক করা হলেও মোটা অংকের টাকা লেনদেনের মাধ্যমে তাদের পুলিশ ছেড়ে দেয়। ধর্ষিতার পরিবার জানায়, গত ১ আগস্ট সকালে স্কুলে যাওয়ার পর পাশের সখীপুর উপজেলার কালিয়ান গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে আশিকের নেতৃত্বে ২-৩জন যুবক মেয়েটিকে প্রথমে বাসাইল হয়ে নলুয়ার মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরের দিন দেলদুয়ার উপজেলার পেরাকজানী গ্রামে মেয়েটির এক আত্মীয়র বাড়ির সামনে তাকে ফেলে রেখে চলে যায়। স্বজনদের অভিযোগ, ৩ আগস্ট(বৃহস্পতিবার) সকালে বাসাইল থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত মেয়ে ও মেয়ের বাবাকে পুলিশ থানায় রাখে। পরে শনিবার(৫ আগস্ট) মামলাটি রেকর্ড করে ধর্ষিতার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। এ ঘটনায় শনিবার(৫ আগস্ট) সকালে সখীপুর উপজেলার কালিয়ান গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে আশিক (১৮) কে মুল আসামী এবং আশয়দাতা মোস্তাফিজুর রহমান (৩৫) ও তার স্ত্রী ইতি বেগমের বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড হয়েছে। এ ঘটনায় কাউকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ধর্ষিতা মেয়েটির মা অভিযোগ করেন, এ ঘটনায় দুই সহযোগীকে শুক্রবার(৪ আগস্ট) আটক করা হলেও রাতে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া সুলতানা দিবাকে (১৭) অপহরণ করে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার(১ আগস্ট) বিকালে প্রতিদিনের ন্যায় সুমাইয়া কোচিং করার জন্য ফসলান্দিস্থ ভাড়াবাসা থেকে বের হয়ে প্রভাতী কিন্ডার গার্টেনের কাছে পৌঁছলে ইমন ও হৃদয় তাকে জোরপূর্বক সিএনজি চালিত অটোরিকশায় তুলে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায়। সুমাইয়ার নিকট আত্মীয়রা সারারাত তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরদিন বুধবার(২ আগস্ট) সকালে সুমাইয়ার মা বাদি হয়ে ইমন, তার মা আছমিনা সুলতানা ও বন্ধু হৃদয় মন্ডলকে আসামি করে ভূঞাপুর থানায় একটি অপহরণ করে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ তাৎক্ষনিক অভিযান চালিয়ে ইমন ও হৃদয়কে আটক করে। তবে অপহৃত সুমাইয়াকে উদ্ধার করতে পারেনি।
সুমাইয়ার পারিবার সূত্রে জানাগেছে, ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া সুলতানা দিবাকে গোপালপুর উপজেলার গোলপেচা গ্রামের ওয়াজেদ আলীর ছেলে ইয়ামিন ইসলাম ইমন দীর্ঘদিন যাবৎ প্রেম নিবেদন ও বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। সুমাইয়ার বিয়ে অন্যত্র পাকাপাকি হওয়ার খবর পেয়ে গত ৪ জুলাই ইমন, তার বন্ধু স্থানীয় ছাব্বিশা গ্রামের কামরুজ্জামান মন্ডল ওরফে কামুর ছেলে হৃদয় মন্ডল ও অপর একসহযোগিকে নিয়ে সুমাইয়াদের ভাড়া বাসায় যায়। তারা সুমাইয়ার মাকে বিয়ে বন্ধ করতে বলে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে চলে যায়। পরে সুমাইয়াকে অপহরণ করে।
অপরদিকে, সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার হাতীবান্ধা ইউনিয়নের রতনপুর কাশেম বাজার এলাকায়। ওই এলাকায় জঙ্গলের ভিতরে নির্জন ঘরে এক কিশোরীকে ছয় মাস ১৭দিন আটকে রেখে নিয়মিত ধর্ষণ করেন দুরসম্পর্কীয় চাচা। কিশোরীর মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎ’মায়ের কাছে বড় হয়েছেন কিশোরী। ওই কিশোরীর সঙ্গে একটি ছেলের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ছেলেটিকে বিয়ে করতে ওই কিশোরী সহযোগিতা চান এলাকার দুরসম্পর্কের চাচা বাদল মিয়ার কাছে। চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি বাদল মিয়া বিয়ের কথা বলে এলাকার নির্জন স্থানে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ওই কিশোরীকে আসতে বলেন। পরে তাকে সেখানে আটকে রেখে প্রায় সাত মাস ধরে নির্যাতন চালান। গত ২৯ জুলাই কিশোরীকে উদ্ধার করে সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিশোরীর ভাই বাদী হয়ে ৩১ জুলাই বাদল মিয়ার বিরুদ্ধে সখীপুর থানায় মামলা দায়ের করেন।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত বাদল মিয়াকে মির্জাপুর বাজার থেকে শুক্রবার(৪ আগস্ট) দুপুরে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বাদল মিয়া শনিবার(৫ আগস্ট) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বাদল মিয়া (৩৫) ওই কিশোরীকে ৬ মাস ১৭ দিন আটকে রেখে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। টাঙ্গাইলের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আবদুল্লাাহ আল মাসুদ তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। পরে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান জানান, বাংলাদেশ এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি, নগরায়ন, নতুন প্রযুক্তি সমাজে হঠাৎ করেই কিছু পরিবর্তন এনেছে। আর এর সঙ্গে মানুষ খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে অস্বস্তি, অস্থিরতা ও অসঙ্গতি। তিনি আরও বলেন, বাল্য বিয়ে, বয়ঃসন্ধিকালের অজ্ঞতা ও পারিবারিক অভাব-অভিযোগ-বিরোধ সরাসরি সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত। সমাজের অস্বস্তি, অসঙ্গতি ও অস্থিরতা থেকে মানসিক বৈকল্যতা বৃদ্ধি পায়। নৈতিক বৈকল্যতার কারণে ধর্ষণের মতো লোমহর্ষক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমদ জানান, দেশে পরিবারে বড় পরিবর্তন ঘটছে। পারিবারিক নানাবিধ অসঙ্গতি মানসিক বৈকল্যতায় রূপ নেয়। পারিবারিক হতাশা থেকে আগ্রাসী হয়ে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে সমাজে। এটা শুধু টাঙ্গাইলে বাড়ছে তাই না, দেশে ধর্ষণ একটি সামাজিক অপরাধ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তিনি আরও জানান, সামাজিক বৈষম্য চরমভাবে বেড়ে গেছে। এর ফলে ক্ষুব্ধ মানুষটি হতাশ হয়ে অপরাধে জড়াচ্ছে।
দু’বিশেষজ্ঞের মতে, এসব থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার চটজলদি কোনো সমাধান নেই। হেলাল উদ্দিন আহমদ মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হলো দারিদ্র দূর করতে হবে। পারিবারিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে। সন্তানকে গুণগত সময় দিলে পারিববারিক অন্যান্য সহিংসতা রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। অধ্যাপক জিয়া রহমান মনে করেন, অর্থনীতি পুঁজিবাদী ভাবধারার হলেও নব্য পুঁজিবাদী এ ধারা এখনো মানবিক হয়ে উঠতে পারেনি। এখন দরকার নতুন সৃষ্টি হওয়া সামাজিক অস্থিরতা প্রশমনকারী প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানে মানবিকতা, নৈতিকতা ও সামাজিক ভিত্তি মজবুত হবে।

শেয়ার করুন স্যোশাল মিডিয়াতে

Facebook
Twitter
LinkedIn
X
Print
WhatsApp
Telegram
Skype

সর্বশেষ খবর

এই সম্পর্কিত আরও খবর পড়