ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
বুলবুল মল্লিক:
টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উপজেলা নিয়ে গঠিত আটটি সংসদীয় আসনের মধ্যে সাতটিতেই বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশি সক্রিয়ভাবে গণসংযোগ করছেন। ফলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্য রূপ পাচ্ছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইলে বিএনপির শক্ত অবস্থান থাকলেও গত ১৬ বছর দলটি চাপে ছিল। মূল শহরে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। নেতা-কর্মীরা মামলায় জর্জরিত ছিলেন। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর চিত্র পাল্টে গেছে। পুরো টাঙ্গাইলে রাজনীতির মাঠ এখন পুরোপুরি বিএনপির নিয়ন্ত্রণে।
ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিভিন্ন কর্মসূচির পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামী জেলার আটটি আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জেলায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কমিটি গঠন করেছে। গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, খেলাফত মজলিস মাঠে থাকলেও তাদের নির্বাচনী তৎপরতা নেই। তবে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর (বীর উত্তম) কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ জেলার কয়েকটি উপজেলায় তৎপরতা চালাচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বাম দলগুলোর তেমন তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছেনা।
টাঙ্গাইল জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলা নিয়ে টাঙ্গাইল-১ আসন গঠিত। গোপালপুর ও ভূঞাপুর উপজেলা নিয়ে টাঙ্গাইল-২। ঘাটাইল উপজেলা নিয়ে টাঙ্গাইল-৩, কালিহাতী নিয়ে টাঙ্গাইল-৪, সদর উপজেলা নিয়ে টাঙ্গাইল-৫, নাগরপুর উপজেলা নিয়ে টাঙ্গাইল-৬, মির্জাপুর উপজেলা নিয়ে টাঙ্গাইল-৭ আসন এবং বাসাইল ও সখীপুর উপজেলা নিয়ে টাঙ্গাইল-৮ আসন গঠিত।
সূত্রমতে, জেলার আটটি আসনে মোট ভোটার ৩১ লাখ ৮৪ হাজার ৫২৯ জন। এরমধ্যে পুরুষ ১৬ লাখ ৭৭৬জন, নারী ১৫ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩১জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের(হিজরা) ভোটার রয়েছে ২২ জন।
সরেজমিনে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০২২ সালের ১ নভেম্বর। ওই সম্মেলনে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে হাসানুজ্জামিল শাহীন সভাপতি ও ফরহাদ ইকবাল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় তিন বছরেও দলটির পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি গঠিত হয়নি। এই জেলায় দলের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে একমত হতে পারেননি- ফলে দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদিত হয়নি। টাঙ্গাইলে জেলা বিএনপির কোনো কার্যালয় নেই।
একেক নেতা একেক স্থানে ব্যক্তিগত অফিস করেছেন। সেখান থেকে নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ অবৈধ বালুর ঘাট, হাটবাজার, পরিবহন খাতসহ আয়ের বিভিন্ন উৎস দখলে রেখেছিল। ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতা-কর্মীরা সেই জায়গা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন ব্যবসায়িক, পেশাজীবী, সামাজিক সংগঠনের কমিটিও বিএনপির নেতা-কর্মীরা দখলে নিয়েছেন।
জেলা বিএনপিতে বর্তমানে দুটি ধারা স্পষ্ট। এক পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আযম খান। অপর পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বড় ভাই কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু। তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে ১৭ বছর কারাগারে ছিলেন। উচ্চ আদালতের আদেশে গত ডিসেম্বরে তিনি মুক্তি পান। সালাম পিন্টুর মুক্তির পর টুকুর অনুসারীরা চাঙা হয়েছে। দুই পক্ষের বিভক্তি মূল দল বিএনপি সহ সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেও প্রভাব পড়েছে। প্রতিটি সংসদীয় আসনে এই বিভক্তি স্পষ্ট। এ ছাড়া দলের ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বেনজীর আহমেদ টিটোরও একটি পক্ষ রয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। দলের জেলা ও উপজেলার কার্যালয়গুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেনসহ কয়েকশ’ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় দলের জেলা শাখার সভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খান গত অক্টোবরে ইন্তেকাল করেছেন। সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলাম(ভিপি জোয়াহের) সহ বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ভারতে অবস্থান করছেন বলে ঘনিষ্ঠজনরা নিশ্চিত করেছেন।
টাঙ্গাইলে জাতীয় পার্টির তৎপরতা তেমন একটা দেখা যায় না। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে দলটির নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যেই রয়েছেন। জেলার আটটি আসনের একটিতেও এ দলের কোনো প্রার্থী তৎপর নয়। তবে দল নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় পার্টি জেলার প্রতিটি আসনে প্রার্থী দেবে বলে নেতা-কর্মীরা অভিমত দিয়েছে।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সরকারের প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচনী পরিবেশ থাকলে জেলার প্রতিটি আসনে প্রার্থী দেবে বলে জানাগেছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনে দলীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাঁর বড় ভাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী কৃষক শ্রমিক জনতা লীগে যোগদান না করলেও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। লতিফ সিদ্দিকী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
৫ আগস্টের পর টাঙ্গাইলে খুবই তৎপরতা দেখাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কয়েকটি বড় বড় সমাবেশ করেছে দলটি। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দলটির নেতা-কর্মীরা কাজ করছেন। দলীয় প্রার্থীরা নিজ নিজ আসনে নির্বাচনী তৎপরতা শুরু করেছে।
নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি(এনসিপি) ইতোমধ্যে জেলা কমিটি এবং ১০টি উপজেলায় কমিটি গঠন করেছে। দলীয়ভাবে আগামি নির্বাচনে আটটি আসনে প্রার্থী ঠিক করা না হলেও চারটি আসনে চারজন কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।