*মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল*

‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম’ এক সাধারণ সালাম হলেও মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠেছিল একটি আহ্বান, একটি প্রতিজ্ঞা- যে সালামটি ছিল সর্বনিম্ন মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার দ্যুতি, সংগ্রামের প্রত্যয়ের প্রতীক। তাঁর জীবনের প্রতিটি রূপায়ণে আমরা দেখতে পাই- জমিদারী শোষণ, ঋণচক্র, ভূমিহীন কৃষক, রুক্ষ শ্রমিক, মহল-শাসিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার চিরন্তন প্রতিহিংসা। এ প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে ভাসানীর প্রতিরোধ শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না- এটা ছিল মানবতার অভ্যুত্থান।
১৯৫৭ সালের ৬ থেকে ১০ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত টাঙ্গাইলের কাগমারী নামক স্থানে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ঐতিহাসিক ‘কাগমারী’ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম’ বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। ‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম’- আরবি এই অভিবাদনের মর্মার্থ ‘আপনার ওপরও শান্তি বর্ষিত হোক’। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর এ সম্ভাষণ শুধু ধর্মীয় সৌজন্য নয় বরং এক হুঙ্কারে পরিনত হয়েছিল।
ভাসানীর সমগ্র জীবনদর্শনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তাঁর উচ্চারিত এই শব্দবন্ধে ছিল একদিকে আধ্যাত্মিক শান্তির বার্তা, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিবাদের রূপান্তরিত রূপ। ভাসানী ছিলেন কৃষক-শ্রমিকের নেতা, দরিদ্রের কণ্ঠস্বর, অবদমিতের আশা। যখন তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতেন, তাঁর প্রতিবাদে রাগ নয়- থাকত নৈতিক দৃঢ়তা।
আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার মেহনতি ও নির্যাতিত মানুষের নেতা মওলানা ভাসানীর আসল নাম আব্দুল হামিদ খান। তিনি ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পাবনা জেলা বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার সয়া-ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হাজী শরাফত আলী এবং মজিরন বিবি বা মাজিরান্নেসা বিবির তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ও একমাত্র জীবিত সন্তান। ছেলে-মেয়ে বেশ ছোটো থাকা অবস্থায় হাজী শারাফত আলী মারা যান। কিছুদিন পর এক মহামারীতে মজিরন বিবি বা মাজিরান্নেসা বিবি ও দুই ছেলে মারা যায়। বেঁচে থাকেন ছোট্ট শিশু আব্দুল হামিদ খান। তাকে ছোটবেলায় ‘চেগা মিয়া’ নামে ডাকা হতো। কারণ তার পিতা হাজী শরাফত আলী এই নামে ডাকতেন।
‘চেগা’ শব্দটি এসেছে প্রমিত অসমিয়া-বাংলা উপভাষা থেকে। এর অর্থ- ফাটা কাপড় পরা বালক বা ছেঁড়া জামা পরা শিশু। কারণ, ছোটবেলায় আব্দুল হামিদ খানের পরনের কাপড় প্রায়ই ছিল ছেঁড়া, পুরনো ও জোড়াতালি দেওয়া। তিনি ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন না বরং এক সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন। সেই কারণে গ্রামবাসীও স্নেহভরে ও কখনো কখনো মজা করে তাঁকে ‘চেগা মিয়া’ বলে ডাকতেন।
পিতৃ-মাতৃহীন আব্দুল হামিদ প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থাকেন। বাল্যকালে মক্তব হতে শিক্ষাগ্রহণ করে কিছুদিন মক্তবেই শিক্ষকতা করেন আব্দুল হামিদ। ওই সময় ইরাকের এক আলেম ও ধর্ম প্রচারক সৈয়দ নাসির উদ্দীন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। হামিদ তার আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে ১৮৯৩ সালে তিনি পাঁচবিবির জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাররেসের কাজ করেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে পীর সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের সাথে আসাম গমন করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ইসলামি শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে আব্দুল হামিদ অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
আব্দুল হামিদ খান ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং দশ মাস কারাদÐ ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ‘স্বরাজ্য পার্টি’ গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৬ সালে আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। সেখানেই সর্বপ্রথম তাঁর নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়। ১৯৩১-এ টাঙ্গাইলের সন্তোষের কাগমারীতে এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশাল বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন।
ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের ধারা ছিল সংগঠন-রাজনীতির। তিনি দলে দলে, জনসভায় যুক্ত হন, আদিবাসী, কৃষক, ভূমিহীন, শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলতেন। ১৯৩০-এর দশকে আসামে ‘লাইন সিস্টেম’ নামে এমন এক আইন প্রণয়ন করা হয়, যার ফলে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম কৃষক-শ্রমিকদের অধিকারে বড় ধরনের বাঁধা সৃষ্টি হয়। ভাসানী সেই আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে ছিলেন।
১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ‘বাঙ্গাল খেদাও’ আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। তিনি ওই দাঙ্গার বিরুদ্ধে ‘ওয়া আলাইকুম আস্ সালাম’ বলে গর্জে ওঠেন। তবে তিনি সাধারণত ‘খামোশ’ বলে ধমক দিতেন বা কড়া প্রতিবাদ করতেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জনবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলির রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ওই সম্মেলনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের গোড়াপত্তন হয় এবং প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও শামসুল হক। পরবর্তীকালে সংগঠনটির নাম ছিল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের অধিকতর প্রতিফলন ঘটানোর উদ্দেশে এর নামকরণ করা হয় ‘আওয়ামীলীগ’। তবে সেই সঙ্ঘবদ্ধতায় ভাসানীর নীতি ছিল- শাসকের বিরুদ্ধে, প্রান্তিকের পক্ষে। তাঁর আদর্শ ধরে রাখলে ‘আওয়ামীলীগ’কে আজকের পরিনতি ভোগ করতে হতো না।
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ৩০ জানুয়ারি তাঁর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার কারণে গ্রেপ্তার হয়ে ১৬ মাস কারানির্যাতন ভোগ করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের মুক্তি দাবি করেন। আইয়ুব খান সরকারের পতনের পর নির্বাচনের পূর্বে ‘ভোটের আগে ভাত চাই, ইসলামিক সমাজতন্ত্র কায়েম’ ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৫৭ সালের ৬ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টাঙ্গাইলের কাগমারী নামক স্থানে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ঐতিহাসিক ‘কাগমারী’ সম্মেলনেও তিনি ‘ওয়াআলাইকুম আসসালাম’ বলে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্বপাকিস্তানের সম্পর্কচ্ছেদের কথা বলেছেন। পাকিদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘খামোশ’ বলে হুঙ্কার দিয়েছেন।
১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেন এবং ১৮ জানুয়ারি ১৯৭১ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তাঁর প্রতি আহ্বান জানান। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মওলানা ভাসানী অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ভারত যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। মহান মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেওয়ার উদ্দেশে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন- তাজউদ্দীন আহমদ, মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ।
বুজুর্গ মওলানা ভাসানীর জন্য রাজনীতিই ছিল সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জনের মাধ্যম। তিনি প্রায়শই বলতেন- ‘জমি, পরিশ্রম, শান্তি’ এই তিনই হলো মানুষের জীবনের মৌলিক অধিকার। তাঁর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে দেখা যায়- ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য জমির অধিকার-লড়াই, ঋণ-চক্র নির্মূল ও সুদখ্যাত হিংস্রতা প্রতিরোধ, শ্রমিক ও ভাড়াটে কৃষক, পরিবেশ-সচেতন ভাবনা, সামাজিক উন্নয়নকর্ম ইত্যাদি। এই ভাবনায় ভাসানীর মানবতা-চেতনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনিই একজন রাজনৈতিক নেতা যিনি ক্ষমতা অর্জন করেননি, করেছিলেন মানুষের জীবনের পরিসর পরিবর্তনের সাধনা। তাঁর বিশ্বাস ছিল, সত্যিকারের স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক ভাবেই নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবেই নিশ্চিত হতে হবে। তিনি কখনও ক্ষমতার পেছনে দৌড়াননি; বরং ‘শোষিত’ শব্দটির সঙ্গে নিজেকে এক করেছেন। ভাসানীর আদর্শ ও মূল্যবোধের মধ্যে সহিংসতা-বর্জিত প্রতিরোধ ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনকে শুধু রোষ প্রকাশের মাধ্যম মনে করেননি বরং সংগঠন, সচেতনতা, সংগ্রামের মাধ্যমে পরিবর্তনের রাস্তা খুঁজেছিলেন। তিনি সব সময় সাধারণ জীবন করতেন। ভোগবিলাস ত্যাগ করে শোষিত-উপেক্ষিতের পাশে দাঁড়ানো এসব ছিল তাঁর জীবনের ব্রত।
মহান স্বাধীনতার পর ভারতের ফরাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গা-পদ্মা-যমুনায় ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ছিল বাংলাদেশে। ভাসানী নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ কর্মসূচি পালিত হয়। ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গা-পদ্মা-যমুনা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশের বঞ্চনার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। যেখানে মওলানা ভাসানী পানি-অধিকার ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে প্রতিবাদ উত্থাপন করেন। এটি শুধু বহির্বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক বিষয় ছিল না, ভাসানীর কাছে এটি মানবতার বিষয় ছিল- ছিল ন্যায়বিচার ও স্বাধিকারের প্রশ্নও।
আজ আমরা যখন বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক চিত্র দেখি- ভূমিহীনতা, কৃষক সংকট, পরিবেশের অবনতি, সামাজিকবৈষম্য এসবই ভাসানীর জীবনের মূল বিষয় ছিল। তাই তাঁর জীবনের পাঠ আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আজও বাংলাদেশের প্রায় ১৩ কোটি মানুষ কৃষিতে যুক্ত, কিন্তু তাদের মধ্যে ভূমিহীন বা জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করেন বা বর্গা চাষি- এমনদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
রাজনীতির পাশাপাশি মওলানা ভাসানী সমাজ সংস্কারের রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। আসামে ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। টাঙ্গাইলের সন্তোষে তিনি ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রায় ১২টি কল্যাণমূলক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সন্তোষে একটি ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের ভিত্তিস্থাপন করেন তিনি- যেটি তার স্বপ্ন ছিল। সেখানে আজ তাঁর নামে ‘মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
মওলানা ভাসানী ছিলেন দেশের সংগ্রাম ও সংকটে বিশাল সহায়। কখনোই কোনো পদমর্যাদা, লোভ-লালসা এবং মোহ তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। সরল-সহজ জীবনযাপন করেছেন তিনি, একই সঙ্গে সরল প্রাণের কৃষক-মজুর তার প্রিয় ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও যখন গণতন্ত্রের নামে এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল একের পর এক, যখন কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা, তখনও সিংহের মতো গর্জে উঠেছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। আদর্শ থেকে কখনও তিনি বিচ্যুত হননি। তিনি লড়াই করেছেন সব কালাকানুনেরও বিরুদ্ধে। আজ যখন সারাদেশে সংঘাত, বিভেদ, বিভাজন, পরস্পর হানাহানি তখন মওলানা ভাসানী হতে পারতেন সংহতির কণ্ঠস্বর। মিলিত প্রাণের সংগ্রাম। অবিশ্বাস আর হতাশার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। এই প্রেক্ষাপটে ‘ওয়া আলাইকুম আস্ সালাম’ বলে গর্জে ওঠা ছিল খুবই প্রত্যাশিত। এটি এখন শুধু সালামের জবাব নয়, এটি দায়িত্বের আহ্বান, চেতনার প্রতিফলন। যদি আমরা ভাসানীর আদর্শকে আজ বাস্তবায়ন করি- তাহলে এটিই হবে মানবতার মহাপাঠ।
মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সংকটগুলো সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই অবহিত ছিলেন। তাই তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই। তিনি বলেছিলেন- ‘শোষণ যদি মানুষের প্রকৃত জীবনের অংশ হয়, তাহলে প্রতিরোধই জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়াবে’। তাঁর জীবন, তাঁর সংগ্রাম, তাঁর আদর্শ- সবই আমাদের এই কথা বলে যায়। আজ কোটি মানুষের জন্য ‘ওয়া আলাইকুম আস্ সালাম’ শুধু একটি শব্দ নয়- ভাসানীর গর্জে ওঠায় এটি হয়ে ওঠেছে এক প্রতিজ্ঞা। ১৯৭৬ সালে ১৭ নভেম্বর এই মহান মজলুম নেতার সংগ্রামী মহাকব্যের শেষ অধ্যায় রচিত হয়। এদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ বরণ করেন। পরে তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়। তাঁর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের অতল শ্রদ্ধা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
