আজ- মঙ্গলবার | ২৫ নভেম্বর, ২০২৫
১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ | রাত ১২:৫৫
২৫ নভেম্বর, ২০২৫
১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
২৫ নভেম্বর, ২০২৫, ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

স্মৃতিতে এনামুল হক দীনা : এক নক্ষত্রের পতন

*মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল*

নামে নয় কাজেই পরিচয়, এমনই একজন স্বজ্জন ব্যক্তি ছিলেন এনামুল হক দীনা। তিনি একাধারে নাট্যকার, প্রতিভাবান কবি, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক এবং নাট্যাভিনেতা। যিনি টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক লোকধারা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তারও আগে সাপ্তাহিক যুগধারা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। তবে নাট্যকার হিসেবে বেশিরভাগ সময় নিজেকে উপস্থাপন করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন- তার খ্যাতিও ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সদস্য এবং জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার টাঙ্গাইল জেলা ইউনিটের সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন। তার সাহিত্য ও সাংবাদিকতা জীবনে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে- যা তার বহুমুখী প্রতিভার পরিচায়ক।

 

 

 

 

 

 

 

 

এনামুল হক দীনা কবিতা, নাটক ও সাংবাদিকতা কর্মের মাধ্যমে তিনি টাঙ্গাইলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ স্থান অধিকার করেছিলেন। লোকধারা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সংবাদ পরিবেশন ও সাংস্কৃৃতিক কর্মকাÐে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। টাঙ্গাইল প্রেসক্লাব ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার সঙ্গে তার সক্রিয় সম্পৃক্ততা তাকে সাংবাদিক সমাজে সম্মানিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

টাঙ্গাইল প্রেসক্লাব আয়োজিত বার্ষিক আনন্দ ভ্রমণে গিয়ে ২০২৫ সালের ২১ জুন(শনিবার) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এনামুল হক দীনা কক্সবাজার জেনারেল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেসক্লাবের আনন্দ ভ্রমণ নিরানন্দে পরিনত হয়। সহকর্মীর শোক ও বেদনায় আহত হয়ে পড়েন সবাই। লাশবাহী গাড়িতে রাতেই তাকে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে পাঠানো হয়। প্রেসক্লাবের সকল কার্যক্রম স্থগিত করে তাৎক্ষণিকভাবে হোটেল কল্লোল এর কনফারেন্স হলে শোক সভার আয়োজন করা হয়।

 

 

 

 

টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বল্লা মধ্যপাড়ার মরহুম মোহাম্মদ আলী সরকারের ছেলে ছিলেন এনামুল হক দীনা। শিক্ষা জীবনে তিনি দুটি বিষয়ে এমএ এবং এলএলবি পাশ করেছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে সহ বহু শুভাকাঙ্খী ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। পরদিন সকালে টাঙ্গাইল গোডাউন এলাকা মসজিদে প্রথম ও নিজ গ্রাম বল্লার আল মোকারম কেন্দ্রীয় আহলে হাদীস জামে মসজিদে বাদ যোহর দ্বিতীয় জানাজা নামাজ শেষে তাকে সামাজিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। তার অকাল মৃত্যুতে টাঙ্গাইলের নাট্যাঙ্গণ, সাহিত্য ও সাংবাদিক সমাজ গভীর শোকাহত হয়েছে। তার স্মৃতিতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিক সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। তার সাহিত্যকর্ম ও সাংবাদিকতা আগামি প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

একজন সাংবাদিকের সঙ্গে আরেকজন সাংবাদিকের সম্পর্ক শুধুই পেশাগত নয়, তা আত্মিক, গভীর এবং দায়বদ্ধতার। আমরা যখন খবর সংগ্রহে বের হই, একই মাঠে লড়ি, সত্যের পক্ষে কলম চালাই- তখন এক অদৃশ্য বন্ধন গড়ে ওঠে। সেই বন্ধনই আজ গভীর শূন্যতা বোধ করায়, কারণ আমাদেরই এক সতীর্থ, এক সহযোদ্ধা, এক নির্ভীক সংবাদযোদ্ধা এনামুল হক দীনা আজ আর আমাদের মাঝে নেই।

 

 

 

 

 

এনামুল হক দীনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা শুধু একই এলাকার বাসিন্দা বলে ছিলনা- ছিল আত্মিক। আমরা একে অপরের ঘণিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম- যদিও দীনা আমার থেকে দুই বছরের বড়, তারপরও ‘তুমি’ পর্যায়েই ছিল আলাপচারিতা। আমি প্রায় সময়ই তাকে ‘ডবল’ সম্পাদক হিসেবে ডাকতাম। এনামুল হক দীনা সাপ্তাহিক যুগধারা পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালে প্রকাশকের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে নতুন করে সম্পাদক হিসেবে সাপ্তাহিক লোকধারা পত্রিকা বের করেন। ওই সময় কিছুদিনের জন্য তিনি দুটি পত্রিকারই সম্পাদক ছিলেন। এ কারণে তাকে আমি ‘ডবল’ সম্পাদক বলে ডেকেছি। এতে দুজনের মধ্যকার সম্পর্কটা কেন যেন আরো মজবুত হয়ে যায়।

 

 

 

 

 

 

প্রায়ই ওর সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো, আড্ডা হতো, হতো নানা খুনসুটি। কখনো সংবাদ বা সংবাদের কোনো বিষয় কিংবা হেড লাইন নিয়ে কথা হতো। আবার কখনো প্রতিবেদন বা সংবাদের গাঁথুনিটা ‘ওই রকম’ হলে ভালো হতো- কেন এভাবে লেখা হলো? এমনতর নানা আলোচনায় আমরা মেতে থেকেছি দীর্ঘ সময়। দীনার লেখা নাট্য সমগ্র বই নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে। বইটি পাঠক মহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। কথায় কথায় দীনা একদিন জানায়, তাঁর নাটক সমগ্র বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করা হচ্ছে। আগামি বইমেলায় ‘এনামুল হক দীনার নাটক সমগ্র’ বইটির ইংরেজি ভার্সনও প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল। এনামুল হক দীনা টাঙ্গাইলের বিভিন্ন নাট্য, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ওর স্বপ্ন ছিল- ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সদস্যপদ লাভ। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের বছরই যে তাকে পরলোকে পারি দিতে হবে- কে জানতো?

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এনামুল হক দীনার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে- যার মধ্যে কবিতা ও নাটক সংকলন রয়েছে। তিনি সাহিত্য, কবিতা ও নাটকের মাধ্যমে সমাজের নানা দিক তুলে ধরেছেন। তার রচিত নাটকগুলো সামাজিক বাস্তবতা ও মানুষের মানসিকতার সূ² দিকগুলোকে স্পর্শ করে। কবিতায় তিনি ভাষার সৌন্দর্য ও ভাবের গভীরতা প্রকাশ করতে সক্ষম হন। তার প্রকাশিত বইগুলো বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে- এমনটাই বিশ^াস করি। তিনি টাঙ্গাইলের সাংস্কৃতিক উন্নয়নে অবদান রেখে স্থানীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি টাঙ্গাইলকে ‘সাংস্কৃতিক নগরী’ প্রতিষ্ঠার এক যোদ্ধা ছিলেন। সবার মতো তিনিও স্বপ্ন দেখতেন, একদিন টাঙ্গাইল সাংস্কৃতিক নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোতে বাংলার লোকজ সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলার গ্রামীণ জীবন, বিশেষ করে অবহেলিত তাঁতিদের জীবন ঘণিষ্ঠতা, দৈনন্দিন সংগ্রাম ও সামাজিক বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি বাংলা লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্যের প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং তা তাঁর লেখায় স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়। তিনি বাংলা নাট্যচর্চায় নতুন ধারার সূচনা করতে চেয়েছেন- কতটুকু পেরেছেন তা সময়ই বলে দিবে। তিনি নাট্যাঙ্গনের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের মধ্যে নাট্যচর্চার আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন এবং বাংলা নাট্যের প্রসারে ভূমিকা রেখেছেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

টাঙ্গাইলের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এনামুল হক দীনার অবদান স্মরণীয়। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সম্পাদকীয় কাজের মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্বীয় অভিধায় সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কবিতা ও নাটকগুলোতে গ্রামবাংলার জীবন ও মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন ধরা পড়ে। তিনি সমাজের নানা অসঙ্গতি ও অন্যায়কে সাহিত্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন- যা পাঠক ও দর্শকের মনে গভীর ছাপ ফেলে। সাংবাদিকতার মাধ্যমে এনামুল হক দীনা স্থানীয় ও জাতীয় ইস্যুগুলো তুলে ধরতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি সাংবাদিক সমাজের উন্নয়নে কাজ করেছেন। টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সদস্য ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সাংবাদিকতায় সত্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের ছাপ স্পষ্ট ছিল- যা তাকে সাংবাদিক সমাজে সম্মানিত করেছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এনামুল হক দীনা ছিলেন টাঙ্গাইলের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি কবিতা, নাটক ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার মৃত্যুতে টাঙ্গাইলের সাংস্কৃতিক অঙ্গন একটি মূল্যবান ব্যক্তিত্ব হারিয়েছে। তার সাহিত্য ও সাংবাদিকতা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 

 

 

 

 

এনামুল হক দীনা সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন সত্যের পথপ্রদর্শক। সত্যের পক্ষে আপসহীন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাঁর কলম ছিল জনতার কণ্ঠস্বর, তাঁর প্রতিবেদন ছিল নিপীড়িতের ভাষা। দিনের শেষে যে গল্পগুলো তিনি শুনাতেন, তা ছিলো সংবাদকর্মের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ, হাসি-কান্না ও লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। সাংবাদিকতা তাঁর কাছে ছিল আদর্শের পথ। একবার বলেছিলেন ‘তথ্য শুধু দেওয়ার বিষয় নয়, সেটা দায়িত্বের প্রশ্নও’। এই দায়বদ্ধতাই তাঁকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছিল। বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা এবং সাহস ছিল তাঁর লেখনীর মূল শক্তি।

 

 

 

 

 

 

 

প্রয়াত সহকর্মী এনামুল হক দীনার মৃত্যু আমাদের ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। হৃদয়ের গভীরে যেন আজ একটুখানি নিস্তব্ধ, একটুখানি ফাঁকা। তাঁর কণ্ঠ নেই, চায়ের কাপ হাতে হাসিমাখা মুখ নেই, কিন্তু স্মৃতিগুলো রয়ে গেছে অক্ষয় হয়ে। কত বিতর্ক, কত আলোচনা, কত পথচলার অংশীদার ছিলেন তিনি- সবকিছু আজ হয়ে গেছে অতীত। তবে আমরা জানি, সাংবাদিক মরেন না, তিনি রয়ে যান তার লেখায়, তার রিপোর্ট-প্রতিবেদনে, তার আর্কাইভের প্রতিটি শব্দে। তাঁর পরিবার, শুভাকাঙ্খী ও সাংবাদিক সমাজের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা। তিনি না থাকলেও তাঁর আদর্শ ও কর্ম আমাদের চলার পথ আলোকিত করবে। ‘ওপারে ভালো থেকো, সহযোদ্ধা।’

 

 

 

 

 

 

 

 

শেয়ার করুন স্যোশাল মিডিয়াতে

Facebook
Twitter
LinkedIn
X
Print
WhatsApp
Telegram
Skype

সর্বশেষ খবর

এই সম্পর্কিত আরও খবর পড়