আজ- বৃহস্পতিবার | ৬ নভেম্বর, ২০২৫
২১ কার্তিক, ১৪৩২ | রাত ১১:৫৬
৬ নভেম্বর, ২০২৫
২১ কার্তিক, ১৪৩২
৬ নভেম্বর, ২০২৫, ২১ কার্তিক, ১৪৩২

গারোদের ‘দিদি’ প্রতিভা সাংমা বাড়ির আঙিনায় সমাধিস্থ

বুলবুল মল্লিক:

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গারো জনগোষ্ঠীর ‘দিদি’ হিসেবে পরিচিত প্রতিভা সাংমাকে ইদিলপুরে নিজ বাড়ির আঙিনায় বৃহস্পতিবার(৬ আগস্ট) বিকালে সমাধিস্থ করা হয়েছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার দিকে ৮৭ বছর বয়সে মধুপুর উপজেলার ইদিলপুরের বাড়িতে গারো নারীদের বাতিঘর প্রতিভা সাংমা তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তার মৃত্যুতে গড়াঞ্চলের পুরো এলাকার গারো সমাজে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রিয় ‘দিদি’কে এক নজর দেখতে হাজারো গারো নারী-পুরুষসহ অনেকে ছুটে আসেন।

আনুষ্ঠানিকতা শেষে বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় বাড়ির আঙিনায় তাকে সমাহিত করা হয়।

১৯৯১ সালে মধুপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে অবসর নেয়া মহিয়সী নারী প্রতিভা সাংমা ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ে করেননি।

এতদাঞ্চলের সব শিশুকে তিনি সন্তান মনে করতেন। তিনি ইদিলপুরের বাড়িতে তার পালকপুত্র জেনেট মৃ, পুত্রবধূ এবং পাঁচ নাতি-নাতনিকে নিয়ে থাকতেন।

মধুপুর অঞ্চলের গারো সম্প্রদায়ের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে ও গারো নারী জাগরণে অনন্য অবদান রেখে এতদাঞ্চলের গারোদের কাছে তিনি সার্বজনীন ‘দিদি’তে পরিণত হন।

গারো সমাজে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বেশ কয়েকবার সম্মাননায় ভূষিত হন প্রতিভা সাংমা।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর হাত থেকে তিনিসহ সাত মহিয়সী নারী ‘আনসাং ওমেন ন্যাশন বিল্ডার্স- ২০১৮’ সম্মাননা গ্রহণ করেন।

এবারও(২০২০ সাল) দেশের অন্যতম পুরস্কার পেয়েছিলেন। করোনা সঙ্কটে তার সম্মননা গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছিল।

এর আগে ১৯৯৬ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস এবং ২০০২ সালে জয়েনশাহী আদিবাসি উন্নয়ন পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। তাকে নিয়ে গণমাধ্যমে বহুবার বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত-সম্প্রচারিত হয়েছে।

অরণ্যানী সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠা গারো সমাজে দু-একজন সাহসী নারীর অন্যতম প্রতিভা সাংমা।

তিনি শত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথপ্রদর্শক আজীবন সংগ্রামী সাহসী নারী ছিলেন।

মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের মা বংগবালা চাম্বুগং ও বাবা সনাতন মৃ’র কোল জুড়ে ১৯৩২ সালের ২২ ডিসেম্বর তার জন্ম হয়।

গারোদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা প্রতিভা সাংমা মায়ের প্রেরণা আর উৎসাহে ১৯৩৮ সালে ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে লেখাপাড়ায় প্রাতিষ্ঠানিক হাতে খড়ি নেন।

হোস্টেলে থেকেই লেখাপড়ায় তার প্রাথমিক ধাপ শুরু। পরে ১৯৪৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিকুলেশন শেষ করেন।

’৫১ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটের পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা থাকলেও মায়ের নির্দেশে ১৯৫২ সালে প্রথমে ময়মনসিংহ শহরের হলিফ্যামিলি এবং পরে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার সেন্টমেরি মিশনারি হাইস্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দেন।

মধুপুর বনাঞ্চলের গারো সমাজ সে সময় শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে ছিল। নিজ সম্প্রদায়ের কথা ভেবে ১৯৬৫ সালে হালুয়াঘাটের সেন্টমেরি মিশনারি হাইস্কুলের চাকুরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন।

মিশনারিদের সৌজন্যে গড়ে ওঠা ভুটিয়া প্রাইমারি স্কুলে বিনা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন। একইসঙ্গে তিনি আশপাশের দু’টি মিশন স্কুলের অতিথি শিক্ষক ছিলেন।

ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও যাতে স্কুলে আসে, সেজন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে গারো নারীদের শিক্ষায় উদ্বুব্ধ করতেন।

তিনি মধুপুরের গারো পল্লীতে মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হেডম্যান ও পাদ্রিদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। তার স্বপ্ন পরে সফল হয়। মধুপুর বনাঞ্চলে মিশনারির শতাধিক প্রাথমিক ও তিনটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

এছাড়া ২০-২২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে এখন শ’ শ’ গারো শিশু পড়ালেখা করে।

সত্তরের দশকে তার হাতে গড়া গারো অনেক নারী উচ্চশিক্ষা নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, নারী ও আদিবাসী আন্দোলনে নিরন্তর ভূমিকা রাখছেন। স্বীকৃতি হিসেবে তারাও পুরস্কৃত হচ্ছেন।

জলছত্র কর্পোস খিস্ট্রি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিক মারিয়া চিরান তাদের অন্যতম। তিনিও সম্প্রতি ভ্যাটিকানসিটির পোপের কাছ থেকে সম্মাননা পেয়েছেন।

পীরগাছা সেন্ট পৌলস্ (মিশন) হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নীলিমা থিগিদি এবং গারো নারী সংগঠন আচিকমিচিক সোসাইটির প্রধান সুলেখা ম্রং সহ অনেকে প্রতিভা সাংমার অনুসারী ও শিক্ষার্থী।

বহু প্রতিভার অধিকারী প্রতিভা সাংমার সংস্কৃতি চর্চার প্রতি আগ্রহ দেখে ১৯৫৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আদিবাসী কোটায় গার্লস গাইডের নেত্রী হিসেবে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে পাঠিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা পরে তিনি কাজে লাগিয়েছেন স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে।

মুক্তিযুদ্ধে মধুপুর বনাঞ্চলের গারোরাও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। দেশে পুরোমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হলে প্রতিভা সাংমা আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন।

জলছত্রের ফাদার ইউজিন হোমরিক সিএসসি(সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমেরিকার মিশিগানে মারা গেছেন) গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন।

দেশের ওই দুর্দিনে প্রতিভা গার্লস গাইডের প্রশিক্ষণ কাজে লাগান। জলছত্র ধর্মপল্লীতে(মিশনারী) নার্স হিসেবে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিতেন।

তিনি স্বাধীনতার পর আবার শিক্ষকতায় ফিরে যান। ১৯৭২ সালে মধুপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রাখেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শুরু করে ১৯৯১ সালে এখান থেকেই অবসর নেন।

শেয়ার করুন স্যোশাল মিডিয়াতে

Facebook
Twitter
LinkedIn
X
Print
WhatsApp
Telegram
Skype

সর্বশেষ খবর

এই সম্পর্কিত আরও খবর পড়