আজ- রবিবার | ৯ নভেম্বর, ২০২৫
২৪ কার্তিক, ১৪৩২ | রাত ১০:৫৭
৯ নভেম্বর, ২০২৫
২৪ কার্তিক, ১৪৩২
৯ নভেম্বর, ২০২৫, ২৪ কার্তিক, ১৪৩২

মিছিলের শহরে পরিণত টাঙ্গাইল

বুলবুল মল্লিক:

বিএনপির দলীয় মনোনয়নকে ঘিরে টাঙ্গাইল এখন এক প্রাণচঞ্চল রাজনৈতিক শহরে পরিনত। প্রায় প্রতিদিন সকাল-বিকাল মিছিল, শোভাযাত্রা, পথসভা আর মোটরসাইকেল শোডাউনে সরব হয়ে উঠেছে পুরো শহর। ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুনে ঢেকে গেছে রাস্তাঘাট, মোড়, দোকানের ছাউনি, এমনকি গৃহস্থ বাড়ির দেয়ালও। স্থানীয়দের ভাষায়- ‘টাঙ্গাইল এখন মিছিলের শহর’।

 

 

 

 

 

 

দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল এবং জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ও যুবদলের সাবেক সভাপতি খন্দকার আহমেদুল হক সাতিল। এ তিন নেতার পক্ষেই প্রতিদিন শহরজুড়ে চলছে কর্মী-সমর্থকদের শোডাউন। মিছিল, মানববন্ধন, দোয়া মাহফিল ও পথসভা এখন টাঙ্গাইলের নিত্যদিনের চিত্র।

 

 

 

 

 

 

 

 

টাঙ্গাইল শহরের নিরালার মোড়, শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যান, প্রেসক্লাব চত্তর, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, কলেজপাড়া, বেবি স্ট্যান্ড ও জেলা সদর মসজিদ রোড এলাকা এখন কার্যত রাজনীতির পোস্টার ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে। প্রতি রাতে দলীয় কর্মীরা পোস্টার লাগাচ্ছে, সকালে আবার অন্য প্রার্থীর সমর্থকরা নতুন পোস্টার সাটাচ্ছে। কেউ কেউ মজা করে বলছেন, ‘দেওয়ালই এখন ভোট চায়!’
শহরের বিভিন্ন জায়গায় মোটরসাইকেল মিছিল প্রতিদিনই চলছে। পোস্টার-ব্যানারে লেখা হচ্ছে ‘টাঙ্গাইলের প্রিয় মুখ টুকু ভাই- ধানের শীষের টিকিট চাই’, ‘মাঠের নেতা ফরহাদ ভাই- ত্যাগী নেতার মনোনয়ন চাই’, ‘যুবশক্তির বিকল্প নাই- সাতিল ভাইয়ের যোগ্য কেউ নাই’ ইত্যাদি ইত্যাদি নানা স্লোগান।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দলীয় মনোনয়ন নিয়ে টাঙ্গাইলে বিএনপির রাজনীতিতে এখন তিনটি শিবির স্পষ্ট। এরমধ্যে সুলতান সালাউদ্দিন টুকু কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক। তিনি জাতীয় রাজনীতির দীর্ঘদিনের পরিচিত মুখ। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন ছাত্রদলের সভাপতি। পরে কেন্দ্রীয় জাতীয়তাবাদী যুব দলের সভাপতি হন। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তার পরিচিতি ও সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রার্থী হিসেবে শক্ত অবস্থানে রেখেছে। তাঁর অনুসারীরা প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন এলাকায় লিফলেট বিতরণ, দোয়া মাহফিল ও পথসভা আয়োজন করছেন। সদর উপজেলার ১২টি ইউনিনের একই সঙ্গে নানা স্থানে কর্মসূচি পালন করছেন। টুকুর সমর্থকদের দাবি, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অভিজ্ঞ এবং জনবান্ধব হিসেবে টুকুই এখন টাঙ্গাইল-৫(সদর) আসনের যোগ্য প্রার্থী।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

অন্যদিকে, অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল বর্তমানে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। ছাত্র জীবন থেকে তিনি জাতীয়তাবাদী শক্তির ধারক-বাহক। তাঁর পক্ষে শহরে ব্যাপক সাড়া দেখা যাচ্ছে। আইনজীবী হিসেবে পেশাগত পরিচিতির পাশাপাশি দলের দীর্ঘ সংগঠনিক ভূমিকার কারণে তিনি মাঠে শক্ত অবস্থানে আছেন। শহর ছাড়াও সদর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে বিশেষ করে চরাঞ্চলে তাঁর জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। এরআগেও তিনি একাধিকবার দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি। কিন্তু দলের প্রার্থীর পক্ষে সরব থেকেছেন। বিগত ১৭ বছরে হামলা-মামলা ও শত নির্যাতন-কারাভোগ করেও তিনি দলীয় কর্মসূচি থেকে বিচ্যূত হননি। দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে তিনি পরীক্ষিত ত্যাগী নেতা হিসেবে পরিচিত। তাঁর সমর্থকরা প্রতিদিন মিছিল, ৩১ দফার লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ করছেন। তাঁদের দাবি, ‘যাঁর ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন জাতীয়তাবাদী ঘরাণার রাজনীতি, তিনি দলীয় মনোনয়ন না পেলে মানুষ রাজনীতি করবে কেন? এবার ফরহাদ ইকবালই বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রথম পছন্দ বলে বিবেচিত হয়ে দলের মনোনয়ন পাবেন’।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এদিকে, খন্দকার আহমেদুল হক সাতিল জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাবেক সভাপতি ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হিসেবে তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। তাঁর নেতৃত্বে মোটরসাইকেল শোডাউন শহরের মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে। বিগত সময়ে তিনি জীবন বাঁচাতে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাঁর সমর্থকদের দাবি, ‘সাতিল ভাই তরুণ নেতৃত্বের প্রতীক, তিনিই পরিবর্তনের কণ্ঠস্বর’।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

টাঙ্গাইল শহর ঘুরে দেখা গেছে, এ তিন প্রার্থীর পক্ষে তাদের অনুসারীরা প্রতিদিনই শহরের বিভিন্ন এলাকায় শোভাযাত্রা, পথসভা ও মিছিল করছে। শহরের প্রতিটি এলাকায় এ তিন মনোনয়ন প্রত্যাশীর পোস্টার, ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। দোকানের টিনের ছাউনি, দেয়াল, সেতু, এমনকি বৈদ্যুতিক খুঁটিও বাদ পড়েনি। শহরের বেবি স্ট্যান্ড মোড় থেকে নিরালার মোড় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় টানা ব্যানার-ফেস্টুনে অনেক দোনের সাইনবোর্ডও আড়াল হয়ে গেছে। ব্যানার টানানো এবং মোটরসাইকেল শোডাউন এখন নিত্যদিনের চিত্র। শুধু শহরই নয় সদর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ও চরাঞ্চলেও শোভা পাচ্ছে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন। এসব এলাকার প্রায় চা-স্টলেই চলছে বক্সে পছন্দের প্রার্থীর গান আর সামাজ মাধ্যমে প্রচারিত মিছিল-সমাবেশে প্রিয় নেতার দেওয়া বক্তৃতা।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

টাঙ্গাইল শহরের কয়েকজন দোকানদার জানান, প্রতিদিন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে ব্যবসার কিছুটা ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদেরও তো রাজনীতিটা করতে হবে- তাই তারা কিছু মনে করেন না। তবে রাস্তা আটকে কর্মসূচি পালনের কড়া সমালোচনা করেন তারা। তাদের মতে, ব্যস্ততম সড়ক আটকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কয়েকগুন বেড়ে যায়। টাঙ্গাইল শহরটি জনবসতির তুলনায় অত্যন্ত ছোট। প্রধান প্রধান সড়কে এমনিতেই প্রতিদিন যানজট লেগে থাকে। তার উপর রাস্তা আটকে বা রাস্তার উপর কর্মসূচি পালন করলে ভোগান্তির অন্ত থাকেনা- এতে সাধারণ মানুষ আগ্রহী হওয়ার বদলে বিরক্ত হন। তবে শহরটা রাজনীতি মুখর হয়ে উঠেছে- এ আনন্দও আছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

অন্যদিকে, কলেজছাত্র শামীম হোসেন, ইশতিয়াক আল মামুন, রাজিব বড়–য়া, গৌতম কর্মকার, রাজিয়া আক্তার, মৌসুমী খন্দকার, দীপলী চক্রবর্তী, বর্ষা রাণী দাস সহ অনেকেই জানান, তারা যারা নতুন ভোটার তাদের কাছে এই প্রতিযোগিতা শিহরণ জাগাচ্ছে। কবে তারা ভোট দিতে পারবেন- এই আশায় আগ্রহ নিয়ে প্রহর গুণছেন। তাদের কাছেও বিএনপির দলীয় মনোনয়নের বিষয়টি আগ্রহের। তারা তী²দৃষ্টিতে প্রার্থীদের কর্মসূচিগুলো বিশ্লেষণ করছেন এবং দৃষ্টি রাখছেন। কে মনোনয়ন পাবেন- সেটা দেখার অপেক্ষা করছেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি এখনো টাঙ্গাইল-৫(সদর) আসনে আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন ঘোষণা করেনি। তবে প্রতিটি সম্ভাব্য প্রার্থীই নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। টাঙ্গাইল বিএনপির এই তিন শীর্ষ নেতাই দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনকে সক্রিয় রাখার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কেন্দ্র থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন না এলেও, সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নিজেদের জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক অবস্থান তুলে ধরতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছেন। এরই অংশ হিসেবে শহরে চলছে প্রার্থীদের শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা। মনোনয়ন ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতা চলবে বলেই মনে করছেন স্থানীয় নেতারা।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

জেলা বিএনপির ৩-৪ জন সিনিয়র বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করে জানান, টাঙ্গাইল জেলা বিএনপি এখন অনেক সক্রিয়। কেন্দ্র যদি সঠিক ভারসাম্য বজায় রেখে প্রার্থী ঠিক করে- তাহলে এই আসনে বিএনপি প্রার্থী নির্বাচিত হবে।

 

 

 

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন পর টাঙ্গাইল জেলা বিএনপি এমন প্রাণবন্ত প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়েছে। একদিকে এটি সংগঠনের পুনর্জাগরণ ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভবিষ্যতে ভেতরে বিভক্তির ঝুঁঁকিও তৈরি করতে পারে।

 

 

 

জেলার এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক জানান, মনোনয়ন প্রত্যাশীদের প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। তবে নেতারা যদি সেটিকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখেন- সেটি বিএনপির পক্ষে ইতিবাচক হবে।
টাঙ্গাইলের সাধারণ মানুষে মধ্যে এই রাজনৈতিক তৎপরতা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে একে ‘গণতন্ত্রের উচ্ছ্বস’ বলে স্বাগত জানালেও, কেউ কেউ শহরের যানজট, শব্দদূষণ ও ব্যানারে ভরা রাস্তাকে বিরক্তিকর বলছেন।

 

 

 

 

 

 

টাঙ্গাইল পৌরসভার স্থায়ী বাসিন্দা নাজমা বেগম, খাদিজা আক্তার, ইশরাত জাহান সহ অনেকেই জানান, আগে শহরটা শান্ত ছিল। এখন প্রতিদিন হর্ন, স্লোগান- কখনও ভালো লাগে, কখনও বিরক্তিও লাগে। তবে তরুণ সমাজের একাংশ মনে করছে, এই প্রতিদ্ব›িদ্বতা বিএনপি কর্মীদের আবার রাজনীতিতে ফিরিয়ে এনেছে। টাঙ্গাইলের রাজনীতি এখন আগের মতো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মিছিল মানেই এখন তাদের শক্তির প্রদর্শন।

 

 

 

 

 

সব মিলিয়ে বলা যায়, বিএনপির মনোনয়নকে ঘিরে টাঙ্গাইল এখন এক ব্যস্ত, উচ্ছ¡সিত ও উত্তপ্ত রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত হয়েছে। কে পাবেন দলীয় প্রতীক ধানের শীষ- এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আগ্রহী শহর ও গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি মানুষ। রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের আগে শহরের প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি স্লোগান যেন সাক্ষী হয়ে থাকছে- টাঙ্গাইল বিএনপির অভ্যন্তরীণ প্রাণচাঞ্চল্যের। দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার মধ্য দিয়ে বোঝা যাবে- মিছিলের এই শহর শেষ পর্যন্ত কার বিজয়ের হাসিতে মুখর হবে।

 

 

 

 

 

টাঙ্গাইল জেলা নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, পুলিশের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলার বিষয়ে সতর্ক করছে।

 

 

 

 

 

 

টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, তারা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। এখন পর্যন্ত কোনো সংঘর্ষ বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচারণা যাতে শান্তিপূর্ণ থাকে- সে বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

 

 

 

 

 

 

প্রকাশ, গত ৬ নভেম্বর(সোমবার) বিকালে কেন্দ্রীয় বিএনপির মহাসচিব টাঙ্গাইলের ৮টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৭টিতে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন। শুধুমাত্র টাঙ্গাইল-৫(সদর) আসনে দলীয় মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়নি।

 

 

 

 

 

 

 

 

শেয়ার করুন স্যোশাল মিডিয়াতে

Facebook
Twitter
LinkedIn
X
Print
WhatsApp
Telegram
Skype

সর্বশেষ খবর

এই সম্পর্কিত আরও খবর পড়